
জুলাই বিপ্লবে রাজধানীর রামপুরার মেরাদিয়াহাট এলাকায় পুলিশের গুলিতে শহীদ হন মায়া ইসলাম। দিনটি ছিল ২০২৪ সালের ১৯ জুলাই। বেলা ৩টার দিকে নাতি বাসিত খান মুসাকে আইসক্রিম কিনে দিতে ছয়তলার বাসা থেকে নিচে নামেন ৫২ বছর বয়সি মায়া। কিন্তু কী নির্মম বাস্তবতা তাদের জন্য অপেক্ষা করছিল তা হয়তো তারা বুঝতেই পারেননি।
বাসার মূল গেট বন্ধ থাকায় গেটের ভেতরেই দাঁড়িয়ে ছিলেন দাদি-নাতি। ঠিক তখনই বাইরে থেকে ছোড়া পুলিশের একটি গুলি সাত বছর বয়সি নাতি মুসার মাথায় বিদ্ধ হয়ে পেছনে থাকা মায়া ইসলামের তলপেটে ঢুকে যায়। মুসা গুরুতর আহত হলেও বেঁচে যায়, কিন্তু প্রাণ হারান মায়া ইসলাম।
সেদিন রাজধানীর রামপুরা থানার সামনে কোটা সংস্কার আন্দোলনকে কেন্দ্র করে পুলিশের সঙ্গে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র-জনতার সংঘর্ষ চলছিল। পুলিশ নির্বিচারে গুলি চালাচ্ছিল। এ সময়ে নাতির আবদার রাখতেই মায়া ইসলাম বাসার নিচে নামেন। কিন্তু হঠাৎ করেই ওই গুলি এসে নাতি মুসাকে আহত করে এবং দাদি মায়ার প্রাণ কেড়ে নেয়।
মায়ার স্বামী মাহবুব ইসলাম আমার দেশকে বলেন, ‘আমার স্ত্রী ও নাতির ওপর যে জুলুম হলো, তার বিচার চাই। আল্লাহর কাছে বিচার চাই। এ ঘটনার পর আমাদের সংসার এলোমেলো হয়ে গেছে। আমার নাতিটাকে সিঙ্গাপুর থেকে চিকিৎসা করিয়ে আনার পরেও তার মুখে ভাষা নেই। ছেলে ও পুত্রবধূকে সারাক্ষণ নাতিকে নিয়ে হাসপাতালে থাকতে হয়। আমি একা হয়ে গেছি। আমরা ভালো নেই।’
এই হত্যার ঘটনায় মায়া ইসলামের ছেলে মোস্তাফিজুর রহমান ১ নভেম্বর খিলগাঁও থানায় একটি মামলা দায়ের করেন। মামলায় শেখ হাসিনাসহ ৮৭ জনকে আসামি করা হয়েছে। এর মধ্যে সাবেক সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের ও সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামালও রয়েছেন।
মাহবুব ইসলাম বলেন, ‘আমার নাতি মুসা চব্বিশের গণঅভ্যুত্থানের সবচেয়ে ছোট যোদ্ধা। এক বুলেটে তার দাদি শহীদ হয়েছে। আর মুসা আহত হয়েছে। এখনো তার বেঁচে থাকাটা যেন এক অলৌকিক ঘটনা। বেঁচে থাকলেও স্বাভাবিক জীবনে ফিরতে পারবে কি না, তা জানি না।’
গুলিবিদ্ধ মুসাকে শুরুতে ঢাকা মেডিকেলের আইসিইউতে রাখা হয়। অবস্থার উন্নতি হলে সাধারণ ওয়ার্ডে নেওয়া হয়, কিন্তু ফের জটিলতা দেখা দিলে তাকে লাইফ সাপোর্টে নেওয়া হয়। অবশেষে অন্তর্বর্তী সরকারের সহায়তায় উন্নত চিকিৎসার জন্য ২২ অক্টোবর মুসাকে সিঙ্গাপুরে পাঠানো হয়। সেখান থেকে তাকে ৩ এপ্রিল দেশে ফেরত আনা হয়েছে। কিন্তু সিঙ্গাপুরে চিকিৎসা করালেও তার মুখের ভাষা ফিরে আসেনি। এখনো সে অসুস্থ। ৩ এপ্রিল বিমানবন্দর থেকেই ফের সিএমএইচে নেওয়া হয়েছে মুসাকে।
মাহবুব ইসলাম মালিবাগ বাজারে একটি ইলেক্ট্রনিক পণ্যের দোকান চালান। তাদের গ্রামের বাড়ি টাঙ্গাইলের মির্জাপুরে। ছেলে মোস্তাফিজুর রহমান তার স্ত্রী ও একমাত্র সন্তান মুসাকে নিয়ে রাজধানীর রামপুরার মেরাদিয়া হাট এলাকায় ছয়তলার একটি ভাড়া বাসায় থাকতেন। সেখানেই থাকতেন মায়া ইসলাম ও তার স্বামীও।
মুসার বাবা মোস্তাফিজুর রহমান জানান, গুলি লাগার পরপরই ছেলেকে কোলে তুলে নিয়ে ছুটে যান হাসপাতালে। প্রথমে মুসাকে নেওয়া হয় বনশ্রী এলাকার একটি হাসপাতালে। পরে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে স্থানান্তর করা হয়। অন্যদিকে, মায়া ইসলামকে বনশ্রী হাসপাতালে নেওয়া হলেও অবস্থার অবনতি হলে ২০ জুলাই সকালে ঢাকা মেডিকেল নেওয়ার পথে তিনি শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন।
মাহবুব ইসলাম বলেন, ‘আমার স্ত্রীকে হারিয়েছি। মায়া মারা যাওয়ার পর হাসপাতালে তার লাশ নিয়ে নানা ঝামেলা করেছে পুলিশ। সকালে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নেওয়া হয়েছে। আর নানা ঝামেলা করে সেই লাশ সন্ধ্যায় ছেড়েছে পুলিশ।’
মাহবুব ইসলাম আরো বলেন, ‘সেসব দুর্ভোগের কথা বলে আর কি হবে। এখন নাতিকে বাঁচানোর লড়াই করছি। চিকিৎসা চলছে। তবে সে পুরোপুরি সুস্থ হবে কি না, তা এখনো নিশ্চিত নই। এই শিশু এক বুলেটের আঘাতে তার দাদিকে হারিয়েছে, নিজেও মৃত্যুর সঙ্গে লড়াই করছে।’