
২০১১-২০২০ একটি ফ্যাসিস্ট সরকারের চরিত্র অনুযায়ী সামরিক বাহিনীকে কবজা করার যে প্রক্রিয়া দিল্লির সহায়তাক্রমে শেখ হাসিনা ২০০৯ সালে বিডিআর ম্যাসাকারের পর শুরু করেছিলেন, সেটি এই দশকে ভয়াবহ রূপ ধারণ করে। ডিজিএফআই এবং র্যাবে কর্মরত সিনিয়র সামরিক কর্মকর্তারা গুম, বিচারবহির্ভূত হত্যা এবং নানা প্রকার দুর্নীতিতে জড়িয়ে পড়েন। শেখ মুজিবের ছোট মেয়ে, শেখ রেহানার দেবর, মেজর জেনারেল (অব.) তারেক সিদ্দিকের নির্দেশে বাংলাদেশ সেনাবাহিনী পরিচালিত হতে থাকে। তাকে নিরাপত্তা উপদেষ্টার পদ দেওয়া হয়।
সামরিক বাহিনীতে রাজনীতিকরণ ব্যাপকভাবে বিস্তার লাভ করে। বিরোধী রাজনৈতিক দল এবং ভিন্ন মতের বিরুদ্ধে নিপীড়ন ভয়ানক পর্যায়ে পৌঁছায় এবং মানবাধিকার লঙ্ঘন চরমে ওঠে। এ অবস্থায় শেখ হাসিনা ২০১৪ সালে একদলীয় নির্বাচনের বন্দোবস্ত করেন। সব বিরোধী দল নির্বাচন বর্জন করলে, বাংলাদেশ সরকার আন্তর্জাতিক বিরূপ পরিস্থিতিতে পতিত হয়। শেখ হাসিনার পক্ষ হয়ে ভারত সরকার পশ্চিমা রাষ্ট্রসমূহে সরাসরি লবি করতে নেমে পড়ে। ভারতীয় পররাষ্ট্র সচিব সুজাতা সিং ঢাকায় এসে জেনারেল এরশাদকে নির্বাচনে অংশগ্রহণ করতে বাধ্য করেন। (Hasan, M. “What was Sujatha Singh’s message?”, The Daily Star, December 11, 2011. https://www.thedailystar.net ) জনশ্রুতি আছে, তদানীন্তন ডিজিএফআই প্রধান জেনারেল আকবর অস্ত্রের মুখে বারিধারা বাসভবন থেকে জেনারেল এরশাদকে পাকড়াও করে সিএমএইচে বন্দি করে রাখেন।
বর্ণিত অবস্থায় বাংলাদেশ সেনাবাহিনী তার পেশাদারিত্ব এবং প্রাতিষ্ঠানিক স্বকীয়তা পুরোপুরি হারিয়ে ফেলে। দেশ-বিদেশে সবাই বিশ্বাস করতে থাকেন, ভারতীয় গোয়েন্দা সংস্থা ‘র’ বাংলাদেশের বিভিন্ন ক্যান্টনমেন্টে অবস্থান করে সেনাবাহিনীকে নিয়ন্ত্রণ করছে। সামরিক বাহিনীর শীর্ষ কর্মকর্তাদের ঢালাও দুর্নীতির সুযোগ করে দেওয়া হয়। বিদেশে ভাবমূর্তির সংকট দেখা দিলে সরকার ইসলামিক জঙ্গি কার্ড ব্যবহার করতে থাকে। জেনারেল আজিজকে শেখ হাসিনা সেনাপ্রধান নিয়োগ করলে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর ভাবমূর্তি একেবারে তলানিতে নেমে আসে। জেনারেল আজিজ এবং তার সন্ত্রাসী ভাইদের দুর্নীতি নিয়ে মধ্যপ্রাচ্যের আল-জাজিরা ‘All the Prime Minister’s Men’ শিরোনামে সংবাদ প্রচার করলে সারা বিশ্বের নজর বাংলাদেশের দিকে পতিত হয়। সেনাপ্রধান হওয়ার প্রতিযোগিতায় পরাজিত জেনারেল সোহরাওয়ার্দী সোশ্যাল মিডিয়ার টকশোতে দাবি করেন, বাংলাদেশের সেনাপ্রধান কে হবেন সে বিষয়টি দিল্লি থেকে নির্ধারিত হয়। জেনারেল আজিজের একসময়ের বন্ধু এবং মেজর জেনারেল তারেক সিদ্দিকের ব্যবসায়িক অংশীদার, কর্নেল শহিদ খানের সঙ্গে সাবেক সেনাপ্রধানের টেলিফোন আলাপ সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে লিক হলে দেশ-বিদেশে সবাই বাংলাদেশে গুম ও বিচারবহির্ভূত হত্যায় শেখ হাসিনা এবং মেজর জেনারেল তারেক সিদ্দিকের সম্পৃক্ততার বিষয়ে নিশ্চিত হয়।
জেনারেল আজিজ ২০১৮ সালের মধ্যরাতের নির্বাচনে সহযোগিতা করে শেখ হাসিনার প্রতি তার আনুগত্যের প্রমাণ দেন। এ অবস্থায় শেখ হাসিনার সঙ্গে বিচার বিভাগে তার সব অপকর্মের সাথি, প্রধান বিচারপতি এস কে সিনহার সঙ্গে ক্ষমতার দ্বন্দ্ব শুরু হলে ডিজিএফআই আবারও দৃশ্যপটে হাজির হয়। গোয়েন্দাপ্রধান জেনারেল আকবর অস্ত্রসজ্জিত হয়ে এস কে সিনহাকে চরমভাবে অপমানিত করেন এবং তাকে প্রধান বিচারপতি থাকা অবস্থাতেই দেশ ছাড়তে বাধ্য করেন। (Sinha, S.K, “A Broken Dream: rule of law, human rights, and democracy”, CreateSpace independent Publishing Platform, September 26, 2018. ) বাংলাদেশ সেনাবাহিনী শেখ হাসিনা এবং দিল্লির সম্পূর্ণ বশ্যতা মেনে নেওয়ার ফলে ২০১০ থেকে ২০২০ সালের মধ্যে বাংলাদেশ একটি ভয়ংকর ফ্যাসিস্ট ও মাফিয়া রাষ্ট্রে পরিণত হয়। অতএব, দেশের এই পরিণতির দায় সেই সময়কার কোনো ডিজিএফআই এবং সেনাপ্রধানই এড়াতে পারেন না। ২০২০ সালের ডিসেম্বরে মানবাধিকারের গুরুতর লঙ্ঘনের অভিযোগে র্যাবের কিছু সামরিক কর্মকর্তা, পুলিশপ্রধান বেনজীর আহমেদ এবং খোদ র্যাবের বিরুদ্ধে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র নিষেধাজ্ঞা আরোপ করলে শেখ হাসিনা সরকার প্রথমবারের মতো আন্তর্জাতিক চাপ অনুভব করতে পারে। ডিজিএফআইয়ের কর্তারাও আতঙ্কিত হয়ে ওঠেন। কারণ, জাতিসংঘ শান্তি মিশনে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর অংশগ্রহণে খানিকটা অনিশ্চয়তার সৃষ্টি হয়। র্যাবে দায়িত্ব পালন করেছে এমন সামরিক অফিসারদের শান্তি মিশনে গ্রহণ করার আগে জাতিসংঘ বিশেষ যাচাই-বাছাই প্রক্রিয়া শুরু করে। ২০১০-এর দশক বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর পেশাদারিত্ব ও ভাবমূর্তির নিরিখে একটি নিন্দনীয় অধ্যায় হিসেবেই ইতিহাসে বর্ণিত হবে।
২০২০-২০২৫
যেকোনো মূল্যে বাংলাদেশকে অলিখিত উপনিবেশ রূপে ধরে রাখার ভারতীয় নীতিতে কোনো পরিবর্তন না ঘটায় শেখ হাসিনা তার বেপরোয়া কার্যক্রম অব্যাহত রাখতে উৎসাহিত হন। জেনারেল আজিজের পর জেনারেল শফিউদ্দিন আহমেদ সেনাপ্রধান হলেও ফ্যাসিস্ট শাসনব্যবস্থার প্রতি সেনাবাহিনীর বশ্যতার কোনো পরিবর্তন হয়নি। তিনি সৈনিকদের দুবেলা ভাত খাওয়ার জন্য শেখ হাসিনার প্রতি কৃতজ্ঞতার নতুন তত্ত্ব হাজির করে ফ্যাসিস্ট শাসকের প্রতি তার আনুগত্য প্রমাণ করেন। নানারকম ব্যবসার সুযোগ করে দিয়ে দিল্লির অনুগত সরকার সামরিক বাহিনীকে দেশের সার্বভৌমত্ব রক্ষার মহান মিশন থেকে বিচ্যুত করে ক্রমেই এটিকে একটি বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানে রূপান্তর করার আত্মঘাতী পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করতে থাকে। ভারতীয় সমর্থন এবং সামরিক বাহিনীর বশ্যতা সম্পর্কে নিশ্চিত হয়ে শেখ হাসিনা আবারও একটি একদলীয় নির্বাচন সম্পন্ন করার জন্য উৎসাহিত হয়ে ওঠেন। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং ইউরোপীয় ইউনিয়নের মৃদু আপত্তি উপেক্ষা করে পতিত সরকার ২০২৪ সালের ৬ জানুয়ারি আর এক নির্বাচনী নাটক মঞ্চস্থ করে জনগণের ভোটাধিকার টানা তৃতীয়বারের মতো হরণ করে।
উপরোক্ত পরিস্থিতিতে হতাশাগ্রস্ত দেশবাসী মনে করছিল যে, দিল্লির হেজিমনি এবং শেখ হাসিনার ফ্যাসিবাদী শাসন থেকে সহসা মুক্তি মিলবে না, সে সময় বাংলাদেশের তরুণ ছাত্র-জনতা সারা বিশ্বকে চমকে দিয়ে ইতিহাস বদলকারী মহান জুলাই বিপ্লব সংঘটিত করে। মাত্র ৩৬ দিনের রক্তস্নাত বর্ষাবিপ্লবে নিরস্ত্র কোটি তরুণ পুলিশ, র্যাব এবং সেনাবাহিনীর বুলেট অগ্রাহ্য করে হাসিনার তখতে তাউস ভেঙে চুরমার করে দেয়। কোনো ধরনের বিদেশি সহায়তাবর্জিত বিপ্লবের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশের জনগণ রাষ্ট্রব্যবস্থায় এমন এক বিস্ময়কর পরিবর্তন আনতে সক্ষম হয়েছে, যা ভবিষ্যতের সব সরকারের জন্য সতর্কবার্তা হিসেবে কার্যকর থাকবে বলে আমি মনে করি। সফল বিপ্লবের পরিণতিতে বাংলাদেশের ইতিহাসের নিকৃষ্টতম জালিম সরকারের প্রধান শেখ হাসিনা পালিয়ে দিল্লিতে আশ্রয় নিতে বাধ্য হয়েছেন। এবার আমাদের রাষ্ট্র সংস্কারের পালা যাতে করে আর কখনো বাংলাদেশে বিগত সরকারের মতো কোনো ফ্যাসিবাদ মাথাচাড়া না দিতে পারে, সেই কাঙ্ক্ষিত সংস্কার অর্থবহ এবং টেকসই করতে হলে দেশের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্বের অন্যতম স্তম্ভ, সামরিক বাহিনীকে সব ধরনের রাজনৈতিক অপচ্ছায়া ও প্রভাব থেকে মুক্ত করা আবশ্যক। আমার পরবর্তী আলোচনা তারই পন্থা নিয়ে।
রাজনীতিমুক্ত সেনাবাহিনী গঠন প্রস্তাবনা
স্বাধীনতা-পরবর্তী ৫৪ বছরের ইতিহাসের দীর্ঘ আলোচনা থেকে আমরা সম্ভবত এই সিদ্ধান্তে পৌঁছাতে পারি যে, সেনাবাহিনীর রাজনীতিকরণের দায় কোনো একপক্ষের শুধু ছিল না। দেশের সার্বভৌমত্ব রক্ষা করার মহান দায়িত্ব যে ইনস্টিটিউশনের ওপর ন্যস্ত, সেটিকে বিতর্কিত করতে রাজনীতিবিদ এবং উচ্চাকাঙ্ক্ষী সামরিক অফিসার, উভয় শ্রেণি নিজেদের ব্যক্তি ও গোষ্ঠীস্বার্থে ভূমিকা রেখেছেন। এ অবস্থা থেকে উত্তরণের জন্য বৈপ্লবিক পরিবর্তন প্রয়োজন। আমি যে প্রস্তাব করতে যাচ্ছি, সেটি সবার কাছে গ্রহণযোগ্য নাও হতে পারে। তবে আমি দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করি, এই প্রস্তাব নিয়ে রাষ্ট্রের সব স্টেকহোল্ডারের মধ্যে সুচিন্তিত বিতর্ক এবং আশু সিদ্ধান্ত গ্রহণ প্রয়োজন। আমার প্রস্তাবের দুটি অংশ আছে। প্রথমটি, সামরিক বাহিনীর অফিসারদের দেশের রাজনীতিতে অংশগ্রহণের সঙ্গে সম্পর্কিত এবং দ্বিতীয়টি রাজনীতিবিদদের আপন স্বার্থে সামরিক বাহিনীকে ব্যবহার করার সঙ্গে সম্পর্কিত। আমি আশা করি, সিভিল-মিলিটারি সম্পর্কবিষয়ক বিশেষজ্ঞ, রাজনৈতিক দলগুলো, সামরিক বিশেষজ্ঞ এবং সামরিক বাহিনী আমার প্রস্তাব নিয়ে অর্থবহ বিতর্ক শেষে দেশের স্বার্থে ঐকমত্য প্রতিষ্ঠিত করতে সক্ষম হবেন।
১. সামরিক বাহিনীর রাজনীতিতে হস্তক্ষেপ প্রতিরোধ
স্বাধীনতার পর থেকে বাংলাদেশে দুই দফা প্রত্যক্ষ সামরিক শাসন এবং এক দফা পরোক্ষ সামরিক শাসনের অভিজ্ঞতা হয়েছে। সেনাবাহিনীর একাংশের অভ্যুত্থানে ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট একদলীয় বাকশাল শাসনের অবসান ঘটলেও প্রথম ফর্মাল সামরিক শাসন ব্রিগেডিয়ার খালেদ মোশাররফ তার মাত্র ৭২ ঘণ্টার শাসনকালে ১৯৭৫ সালের ৩ নভেম্বর জারি করেছিলেন। ৭ নভেম্বর সিপাহি-জনতার এক ঐতিহাসিক অভ্যুত্থানে আওয়ামী লীগ এবং ভারতপন্থি খালেদ মোশাররফের পতন হলে, যথাক্রমে জাস্টিস আবু সাদাত মোহাম্মদ সায়েম এবং মেজর জেনারেল জিয়াউর রহমান বাংলাদেশের দ্বিতীয় এবং তৃতীয় চিফ মার্শাল ল অ্যাডমিনিস্ট্রেটরের পদ গ্রহণ করেছিলেন। জেনারেল জিয়া ১৯৭৯ সালে প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হলে বাংলাদেশের প্রথম দফার সামরিক শাসনের অবসান ঘটে।
১৯৮২ সালের ২৪ মার্চ জেনারেল হুসেইন মুহাম্মদ এরশাদ বিএনপির অভ্যন্তরীণ কোন্দলের সুযোগ নিয়ে মাত্র তিন মাস আগে সরাসরি জনগণের ভোটে নির্বাচিত প্রেসিডেন্ট জাস্টিস সাত্তারকে হটিয়ে সামরিক অভ্যুত্থান ঘটালে বাংলাদেশে দ্বিতীয় দফায় সামরিক শাসন শুরু হয়। দ্বিতীয় দফায় সামরিক শাসন ১৯৮৬ সাল পর্যন্ত চার বছর স্থায়ী হয়। এরপর ১৯৯৬ সালে তৎকালীন সেনাপ্রধান জেনারেল আবু সালেহ মোহাম্মদ নাসিম আওয়ামী লীগের ইন্ধনে সামরিক অভ্যুত্থানের চেষ্টা করলে ২৪ ঘণ্টার মধ্যে দেশপ্রেমিক সেনাবাহিনী সেটি ব্যর্থ করে দেয়। বাংলাদেশে দুই বছরব্যাপী পরোক্ষ সামরিক শাসন ২০০৭ সালের ১১ জানুয়ারি জেনারেল মইন ইউ আহমেদের ভারত এবং মার্কিন সমর্থিত ক্যু দেতার মাধ্যমে শুরু হয়েছিল। সে সময় অবশ্য চিফ মার্শাল ল অ্যাডমিনিস্ট্রেটরের কোনো পদ সৃষ্টি না করে সেনাসমর্থিত সরকারের তত্ত্ব হাজির করা হয়েছিল। ২০০৯ সালের ৬ জানুয়ারি শেখ হাসিনা ক্ষমতা গ্রহণ করলে সেই পরোক্ষ সামরিক শাসনের অবসান ঘটে। এখানে উল্লেখ করা যেতে পারে, সেনা অভ্যুত্থানের মাধ্যমে সামরিক বাহিনীর রাজনীতিতে প্রবেশ করার যে সংস্কৃতি বিগত শতাব্দীর পঞ্চাশ থেকে আশির দশক পর্যন্ত বাংলাদেশসহ এশিয়া, আফ্রিকা এবং লাতিন আমেরিকার অনুন্নত দেশগুলোয় আমরা দেখেছি, বর্তমান বিশ্বব্যবস্থায় তার সুযোগ নেই যদি না জাতিসংঘের পাঁচ মোড়ল দেশ তাদের স্বার্থপূরণে সেই সামরিক অভ্যুত্থানকে সমর্থন করে। বর্তমান শতকে আমরা মিসর এবং মিয়ানমারে নির্বাচিত সরকারকে হটিয়ে যথাক্রমে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং চীনের সমর্থনে সামরিক অভ্যুত্থানের নজির দেখেছি।
বাংলাদেশের বর্তমান অবস্থায় ভারত থেকে সামরিক অভ্যুত্থানের দৃশ্যমান উসকানি থাকলেও জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদের স্থায়ী সদস্যদের মধ্যে কোনো দেশ সেই হঠকারিতা সমর্থন করবে বলে আমি মনে করি না। তদুপরি, বাংলাদেশে সামরিক অভ্যুত্থান হলে জাতিসংঘের নিষেধাজ্ঞা এবং শান্তি মিশনে অংশগ্রহণ বন্ধ হয়ে যাওয়ার ঝুঁকি নিতে হবে। ভূরাজনৈতিক বাস্তবতার নিরিখে আমি বাংলাদেশে সামরিক অভ্যুত্থান ঘটানোর সম্ভাবনা নাকচ করে দিয়েই রাষ্ট্র সংস্কারে আমার প্রস্তাব প্রস্তুত করেছি। তা ছাড়া, শেখ হাসিনা তার ফ্যাসিস্ট শাসনকালে সংবিধানের যেসব সংশোধন করেছেন, তার মধ্যে একটি হলো আর্টিকেল ৭ক, যেখানে প্রচ্ছন্নভাবে সামরিক শক্তি প্রয়োগের মাধ্যমে সংবিধান স্থগিত করাকে রাষ্ট্রদ্রোহের অপরাধ হিসেবে বিবেচনা করা হয়েছে। এমতাবস্থায়, সামরিক অফিসারদের প্রাতিষ্ঠানিকভাবে রাজনীতিতে হস্তক্ষেপের তেমন কোনো সুযোগ আমি দেখতে পাচ্ছি না, যদি না রাজনীতিবিদরা নিজেরাই সেই সুযোগ সৃষ্টি কিংবা উচ্চাকাঙ্ক্ষী কোনো জেনারেলকে উৎসাহিত করেন। আমার উপরোক্ত আশাবাদ সত্ত্বেও বাংলাদেশ সেনাবাহিনীকে রাজনীতিমুক্ত রেখে একটি পেশাদার এবং দেশপ্রেমিক বাহিনীতে রূপান্তরের লক্ষ্যে নিম্নোক্ত সুপারিশগুলো সবার বিবেচনার জন্য উল্লেখ করছি :
১-১ : জাতীয় নিরাপত্তা নীতিমালা প্রণয়ন : দেশের অভ্যন্তরীণ রাজনীতি থেকে বিমুক্ত রেখে শুধু রাষ্ট্রের সার্বভৌমত্ব রক্ষা এবং বহিঃশত্রুর মোকাবিলাকে লক্ষ্য স্থির করে একটি জাতীয় নিরাপত্তা নীতিমালা প্রণয়ন (National Defence Doctrine) করা অত্যন্ত জরুরি।
১-২ : সামরিক বাহিনীতে পদোন্নতি নীতিমালা প্রণয়ন : শুধু পেশাদারিত্ব, সততা, সাহস এবং দেশপ্রেমকে উপজীব্য করে এমন একটি স্বচ্ছ নীতিমালা প্রণয়ন করা আবশ্যক, যেখানে রাজনৈতিক বিবেচনা, অনুগ্রহ, আনুকূল্য, পৃষ্ঠপোষকতা এবং পক্ষপাতিত্বের কোনো সুযোগ থাকবে না (Meritocracy over patronage)।
১-৩ : বাণিজ্য সম্পর্ক রহিতকরণ : স্বার্থের সব ধরনের সংঘাত দূরকরণের লক্ষ্যে যতদূর সম্ভব সামরিক কর্মকর্তাদের বাণিজ্য সম্পর্ক থেকে পৃথক রাখতে হবে। যেসব বাণিজ্যিক প্রকল্পে সামরিক বাহিনীর সম্পর্ক অত্যাবশ্যক, সেখানে কর্মরত অফিসারদের পরিবর্তে অবসরপ্রাপ্তদের নিয়োগ দেওয়া যেতে পারে।
১-৪ : বেসামরিক দায়িত্ব থেকে পৃথককরণ: যতদূর সম্ভব, সেনাবাহিনীকে বেসামরিক দায়িত্ব পালন থেকে বিরত রাখা আবশ্যক। উদাহরণস্বরূপ, র্যাব থেকে সামরিক বাহিনীর সব সদস্যকে প্রত্যাহারের জন্য আমি সুপারিশ করছি। প্রয়োজনে পুলিশের বিশেষ বাহিনীর সদস্যদের সেনাবাহিনীতে নির্ধারিত সময়ের জন্য প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা যেতে পারে।
১-৫ : স্বচ্ছ সামরিক বাজেট : যতদূর সম্ভব সামরিক বাজেটে স্বচ্ছতা নিশ্চিত করা আবশ্যক। সামরিক বাহিনীর দেখভালের জন্য বিশেষ সংসদীয় কমিটি গঠন করে স্বচ্ছতা এবং জবাবদিহি নিশ্চিতের ব্যবস্থা করা যেতে পারে।
১-৬ : সাংস্কৃতিক শিক্ষা প্রদান : বাংলাদেশের জনগণের জীবন পদ্ধতি, ধর্ম, জাতিগত পরিচয়, ইতিহাস এবং ঐতিহ্যের আলোকে সামরিক বাহিনীর সদস্যদের প্রশিক্ষিত করার জন্য সব সেনাসদস্যের এ বিষয়ে পাঠদান আবশ্যক।
১-৭ : প্রশিক্ষণে আন্তর্জাতিক মান অর্জন : বিশ্বের বিভিন্ন দেশের অভিজ্ঞতার আলোকে সেরা অনুশীলন পদ্ধতি (International best practice) অনুসরণ করা আবশ্যক।
২. রাজনৈতিক নেতৃত্বের সেনাবাহিনীকে ব্যবহার প্রতিরোধ
শেখ হাসিনা তার পনেরো বছরের ফ্যাসিস্ট শাসনকালে অবৈধ শাসন অব্যাহত রাখার জন্য নগ্নভাবে সামরিক বাহিনীকে ব্যবহার করেছেন। তার শাসনের বিভিন্ন পর্যায়ে সামরিক বাহিনীর নৈতিকতা, সাহস এবং দেশপ্রেমের অবক্ষয় পরিলক্ষিত হয়েছে। তিনি দেশের নির্বাচন প্রক্রিয়া ধ্বংস করে তার অবৈধ ক্ষমতা দীর্ঘায়িত করতে প্রতিটি ভুয়া নির্বাচনে সেনাবাহিনীকে ব্যবহার করার অপচেষ্টা করেছেন। জনগণের ওপর ভয়াবহ জুলুম চালাতেও র্যাব ও ডিজিএফআইকে নানাভাবে ব্যবহার করা হয়েছে। ডিজিএফআই কর্মকর্তারা, বিশেষ করে সংস্থাটির প্রধানরা ব্যক্তিস্বার্থে পেশাদারিত্ব জলাঞ্জলি দিয়ে এক ফ্যাসিস্ট শাসনের ক্রীড়নক হয়ে কাজ করেছেন। এর ফলে সেনাবাহিনীর সঙ্গে দেশের জনগণের অনাকাঙ্ক্ষিত দূরত্ব সৃষ্টি হয়ে রাষ্ট্রের নিরাপত্তা ক্রমেই হুমকির মুখে পড়েছে। বিগত ফ্যাসিস্ট সরকার শুধু রাজনৈতিক স্বার্থ উদ্ধারে দেশের সার্বভৌমত্বের প্রতীক সামরিক বাহিনীকে বিতর্কিত করেছে। আমি মনে করি, রাষ্ট্রব্যবস্থার গুরুত্বপূর্ণ সংস্কার ব্যতিরেকে শুধু সেনাবাহিনীর অভ্যন্তরীণ সংস্কার করে বাংলাদেশে রাজনীতিমুক্ত ও পেশাদার সামরিক বাহিনী গঠন করা সম্ভব নয়। এমতাবস্থায়, রাষ্ট্র সংস্কারে আমার প্রস্তাব নিম্নরূপ :
২-১ : প্রেসিডেন্সিয়াল পদ্ধতি প্রবর্তনের প্রস্তাব : স্বাধীন বাংলাদেশের যাত্রা রাষ্ট্রপতি-শাসিত ব্যবস্থার মধ্য দিয়ে শুরু হয়েছিল। স্বাধীনতার প্রথম ঘোষণায় মেজর জিয়া নিজেকে অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি হিসেবে পরিচয় দিয়েছিলেন। বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতির পরিচয়েই শেখ মুজিবুর রহমান ১৯৭২ সালের ১০ জানুয়ারি পাকিস্তান থেকে স্বদেশে প্রত্যাবর্তন করেছিলেন। এরপর তিনি ব্রিটিশ ধাঁচের সংসদীয় রীতি অনুযায়ী প্রধানমন্ত্রীর পদ গ্রহণ করে তিন বছরের মাথায় একদলীয় বাকশাল সরকারে কোনো নির্বাচন ছাড়াই আবার রাতারাতি রাষ্ট্রপতি বনে গিয়েছিলেন। তারপর বাংলাদেশে ১৬ বছর রাষ্ট্রপতি-শাসিত ব্যবস্থা ছিল। ১৯৯১ সালে সংবিধান সংশোধনের মাধ্যমে রাষ্ট্রপতি শাসন থেকে আমরা আবার ওয়েস্টমিনস্টার ব্যবস্থায় ফিরে এসেছি।
দুর্ভাগ্যজনকভাবে, ওয়েস্টমিনস্টার শাসনব্যবস্থা গণতন্ত্রের পরিবর্তে বাংলাদেশকে ফ্যাসিবাদের জোয়াল পরিয়েছে। সংসদীয় পদ্ধতিতে যেহেতু আমৃত্যু ক্ষমতা দখলে রাখার সুযোগ আছে, সেই সুযোগ নিয়েই শেখ হাসিনা পুলিশ, র্যাব এবং ডিজিএফআইকে ব্যবহার করে বিরোধী রাজনৈতিক শক্তি এবং ভিন্ন মতকে দমন করেছেন, জনগণের ভোটাধিকার ছিনিয়ে নিয়েছেন, দেশের সার্বভৌমত্ব বিকিয়ে দিয়েছেন এবং ফ্যাসিবাদ কায়েম করেছেন। সামরিক বাহিনীও যখন দেখেছে, শেখ হাসিনার ক্ষমতা থেকে যাওয়ার কোনো সম্ভাবনা নেই, তখন ব্যক্তি ও গোষ্ঠীস্বার্থে তারাও বশ্যতা স্বীকার করেছে। সামরিক বাহিনী বশীভূত হওয়ায় প্রতিষ্ঠান থেকে পেশাদারিত্ব বিদায় নিয়ে সেখানে সুযোগ-সুবিধার বিনিময়ে দুর্নীতিপরায়ণ শাসকশ্রেণির সঙ্গে সহাবস্থানের এক রাষ্ট্রবিনাশী সিস্টেম গড়ে উঠেছিল। তদুপরি, বাংলাদেশের প্রধান দুটি দল যেহেতু পরিবারকেন্দ্রিক, তাই শেখ হাসিনারও দানব শাসক হয়ে ওঠা বেশ সহজ হয়েছে। সুতরাং, বর্তমান শাসনব্যবস্থা অপরিবর্তিত রাখলে, দেশের রাজনৈতিক বাস্তবতায় ভবিষ্যতে নতুন ফ্যাসিবাদের উত্থানের আশঙ্কা থেকে যাবে বলেই আমি মনে করি।
সার্বিক পরিস্থিতি বিবেচনায়, বাংলাদেশে যুক্তরাষ্ট্রের আদলে প্রেসিডেন্সিয়াল পদ্ধতি প্রবর্তনের বিভিন্ন দিক পর্যালোচনার সময় এসেছে। আমার প্রস্তাব হলো, জনগণের প্রত্যক্ষ ভোটে সর্বোচ্চ দুবার পাঁচ বছরের মেয়াদের জন্য একজন নাগরিক প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হতে পারবেন। এই দুই মেয়াদ উপর্যুপরি হওয়ার কোনো বাধ্যবাধকতা নেই। উদাহরণস্বরূপ, যুক্তরাষ্ট্রের বর্তমান প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প ২০১৬ সালে নির্বাচিত হয়েছেন, ২০২০ সালে নির্বাচনে হেরে গেছেন এবং ২০২৪ সালে দ্বিতীয় মেয়াদে নির্বাচিত হয়েছেন। অনেকে যুক্তিসংগতভাবেই তর্ক তুলতে পারেন যে, অতীতে বাংলাদেশে প্রেসিডেন্সিয়াল পদ্ধতির সময়েও সামরিক বাহিনীতে রাজনীতিকরণ হয়েছে। এই অভিযোগের বিষয়ে আমার জবাব হলো, বাংলাদেশে কখনোই যুক্তরাষ্ট্রের মতো অবাধ এবং নিরপেক্ষ নির্বাচনের মাধ্যমে প্রেসিডেন্ট নির্বাচন হয়নি। স্বাধীনতা-উত্তরকালে প্রথম প্রেসিডেন্ট শেখ মুজিব কোনো নির্বাচন ছাড়াই ১৯৭৫ সালের ২৫ জানুয়ারি নিজেকে প্রেসিডেন্ট ঘোষণা করেছিলেন। এরপর খন্দকার মোশতাক সামরিক অভ্যুত্থানের পরিপ্রেক্ষিতে প্রেসিডেন্ট হয়েছিলেন। পরে জেনারেল জিয়া এবং জেনারেল এরশাদ চিফ মার্শাল ল অ্যাডমিনিস্ট্রেটর থেকে প্রেসিডেন্ট হয়েছেন এবং সেই পদে থেকে আবার প্রেসিডেন্ট নির্বাচন করেছেন। জেনারেল জিয়ার বিরুদ্ধে জেনারেল ওসমানী প্রতিদ্বন্দ্বিতা করলেও জেনারেল এরশাদের পাতানো নির্বাচন সব বিরোধী দল বয়কট করেছিল। বেসামরিক ব্যক্তি হিসেবে একমাত্র জাস্টিস সাত্তার জনগণের সরাসরি ভোটে প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হয়েছিলেন। তবে তিনিও প্রেসিডেন্ট পদে থেকেই নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেছিলেন। সুতরাং, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের সঙ্গে বাংলাদেশের তুলনা অযৌক্তিক। দ্বিতীয়ত, আমি যে প্রেসিডেন্ট পদ্ধতির কথা প্রস্তাব করছি, সেখানে নির্বাচিত সংসদের সঙ্গে প্রেসিডেন্টের ক্ষমতার যথেষ্ট ভারসাম্য থাকতে হবে। আমার প্রস্তাবিত প্রেসিডেন্ট শেখ মুজিব, জিয়াউর রহমান কিংবা এরশাদের মতো একক ক্ষমতাশালী হবেন না। প্রেসিডেন্ট এবং সংসদের মধ্যকার ক্ষমতার ভারসাম্যের রূপরেখা প্রস্তাব করার জন্য আমাদের সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞদের কাছ থেকে একাধিক প্রস্তাব, সেমিনারে বিতর্ক এবং রাজনৈতিক ঐকমত্যের প্রয়োজন হবে। তবে, ভারসাম্যটি কী প্রকার হতে পারে, তার একটি উদাহরণ ভবিষ্যতে আলোচনার সুবিধার জন্য আমি আজকের সেমিনারে ব্যাখ্যা করে রাখছি।
উদাহরণটি বার্ষিক বাজেট সম্পর্কিত :
১. প্রেসিডেন্ট সংসদের কাছে প্রাথমিকভাবে তার প্রস্তাবিত বাজেট পেশ করবেন।
২. সংসদে প্রেসিডেন্টের প্রস্তাবিত বাজেট সম্পর্কে আলোচনা শেষে বিশেষ সংসদীয় কমিটি সেই বাজেট প্রয়োজনীয় কাটছাঁট সাপেক্ষে সংসদে অনুমোদনের জন্য আবার পেশ করবে।
৩. সংসদ সংশোধিত এবং অনুমোদিত বাজেট প্রেসিডেন্টের কাছে ফেরত পাঠাবে।
৪. প্রেসিডেন্ট সেই সংশোধিত বাজেটে সম্মত হলেই শুধু বাজেট গৃহীত এবং বাস্তবায়িত হবে।
৫. সংশোধিত বাজেটে প্রেসিডেন্টের সম্মতি না থাকলে তিনি ভেটো ক্ষমতা প্রয়োগ করে সংসদের পুনর্বিবেচনার জন্য বাজেট আবার প্রস্তাব আকারে সংসদে ফেরত পাঠাতে পারবেন। বাজেট নিয়ে সংসদে আবার বিতর্ক অনুষ্ঠিত হবে।
৬. বাজেট পাস হতে হলে প্রেসিডেন্ট এবং সংসদ, উভয় অনুমোদন বাধ্যতামূলক হবে।
আমি মনে করি, প্রেসিডেন্টের দুই মেয়াদের বেশি ক্ষমতাসীন থাকার সুযোগ যদি সংবিধানে রহিত করা থাকে এবং প্রেসিডেন্ট ও সংসদের মধ্যে যদি ক্ষমতার ভারসাম্য নিশ্চিত করা যায়, তাহলেই ফ্যাসিবাদের উত্থানের সুযোগ আমরা বন্ধ করতে সক্ষম হব।
২-২ : নির্বাচনকালীন কেয়ারটেকার সরকার পদ্ধতি সংবিধানে পুনঃসংযোজন : বাংলাদেশে নির্বাচন নিয়ে বিতর্ক পরিহার এবং গণতন্ত্র সুসংহত করতে হলে প্রেসিডেন্ট এবং সংসদ নির্বাচনকালীন কেয়ারটেকার সরকার পদ্ধতি সংবিধানে অন্তর্ভুক্তির কোনো বিকল্প বিদ্যমান পরিস্থিতিতে নেই। তবে, আমরা দেখেছি, সর্বশেষ প্রধান বিচারপতিকে নির্বাচনকালীন সরকার প্রধান করার পদ্ধতি রাজনীতিবিদদের অসততা এবং অসহযোগিতার কারণে শুধু ব্যর্থই হয়নি, সেই সঙ্গে বিচার বিভাগও কলুষিত হয়েছে। সুতরাং, আমাদের নতুন কোনো পদ্ধতির কথা চিন্তা করতে হবে। আমি রাষ্ট্রীয় এবং রাজনৈতিক পর্যায়ে আলোচনা শুরুর জন্য কেয়ারটেকার সরকারের একটি প্রাথমিক প্রস্তাব উত্থাপন করছি। আমার প্রস্তাব অনুযায়ী ৯০ দিনের মেয়াদের নির্বাচনকালীন সরকারে ১১ জন সদস্য থাকবেন। নির্বাচিত সংসদের সরকারি ও বিরোধী দল পাঁচজন করে এবং প্রধান বিচারপতি একজন সদস্যের নাম প্রেসিডেন্টের কাছে প্রস্তাব করবেন। অন্তর্বর্তী সরকারের এই ১১ জন সদস্য গোপন ব্যালটের মাধ্যমে প্রধান উপদেষ্টা নির্বাচন করবেন। আমার এই প্রস্তাবকে আপনারা জাতীয় পর্যায়ে প্রারম্ভিক আলোচনা শুরুর পদক্ষেপ হিসেবে বিবেচনা করতে পারেন। যুক্তরাষ্ট্র কিংবা যুক্তরাজ্যের মতো বাংলাদেশে গণতন্ত্র প্রাতিষ্ঠানিক রূপ নিলে আমাদের আর নির্বাচনকালীন বিশেষ সরকারের প্রয়োজন হবে না।
২-৩ : জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা নিয়োগ : সেনাবাহিনীর সঙ্গে সরকার এবং রাষ্ট্রপ্রধানের সঙ্গে সমন্বয় করার উদ্দেশ্যে জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টার পদ সৃষ্টির জন্য আমি প্রস্তাব করছি। এই পদে যিনি আসবেন, তার আধুনিক ও সার্বিক রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তা সম্পর্কে জ্ঞান থাকার পাশাপাশি বিশ্ব ভূরাজনীতি বিষয়েও ব্যুৎপত্তি থাকতে হবে। ভারত এবং যুক্তরাষ্ট্রসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশে ন্যাশনাল সিকিউরিটি অ্যাডভাইজারের পদ রয়েছে। এই পদে সামরিক কিংবা বেসামরিক ব্যক্তি বিবেচিত হতে পারবেন।
২-৪ : মানবাধিকার লঙ্ঘনে অভিযুক্ত সামরিক অফিসারদের বিচার : যেসব সেনা অফিসার শেখ হাসিনার আমলে মানবাধিকারের গুরুতর লঙ্ঘনের দায়ে, বিশেষ করে আয়নাঘর সৃষ্টি এবং মহান জুলাই বিপ্লবে গণহত্যায় সম্পৃক্ত থেকেছেন, তাদের অবশ্যই বিচারের সম্মুখীন করতে হবে। এরা শুধু যে মানবাধিকার লঙ্ঘন করেছেন ও বিভিন্ন ধরনের দুর্নীতিতে জড়িয়েছেন, তাই নয়, তাদের অনৈতিক কর্মকাণ্ডের ফলে বাংলাদেশ সামরিক বাহিনী আজ প্রশ্নবিদ্ধ হয়েছে। তাদের এসব কর্মকাণ্ড দেশদ্রোহীমূলক হিসেবে বিবেচিত হওয়া উচিত বলেও আমি মনে করি। ওপরের নির্দেশের কথা বলে আয়নাঘর সৃষ্টি, রাজনৈতিক নেতাদের হুমকি প্রদান ও অপহরণ, প্রধান বিচারপতিকে হেনস্তা ও দেশত্যাগে বাধ্য করা, ভুয়া নির্বাচনের তদারকি, বিদেশি শক্তির তাঁবেদারি এবং অর্থনৈতিক দুর্নীতির অপকর্মকে জায়েজ করার কোনো সুযোগ একটি প্রকৃত দেশপ্রেমিক সেনাবাহিনীতে থাকতে পারে না।
আজকের এই নিবন্ধে বাংলাদেশে রাজনীতিবিদ এবং সামরিক বাহিনীর মধ্যকার সম্পর্ক আমি ইতিহাসের আলোকে বিশ্লেষণের চেষ্টা করেছি। আমার বিশ্লেষণের সঙ্গে সবাই একমত না হলেও আমি সম্পূর্ণ সততার সঙ্গে এবং কোনো ধরনের পক্ষপাতিত্ব ব্যতিরেকে নির্মোহভাবে প্রকৃত ইতিহাস তুলে ধরার চেষ্টা করেছি। ইতিহাস সাক্ষ্য দিচ্ছে, স্বাধীনতার পর থেকে বিভিন্ন আমলে সামরিক বাহিনীতে যে রাজনীতিকরণ হয়েছে, তার জন্য কোনো একপক্ষ দায়ী নয়। কখনো ঊর্ধ্বতন সামরিক অফিসাররা ব্যক্তিস্বার্থে রাজনীতিতে হস্তক্ষেপ করেছেন, আবার কখনো রাজনীতিবিদরাও নিজেদের অবৈধ ক্ষমতা টিকিয়ে রাখতে সামরিক বাহিনীকে ব্যবহার করেছেন। দেশের জন্য ক্ষতিকর এই অশুভ পরিস্থিতির অবসান হওয়া জরুরি। জাতি হিসেবে আমরা অনেক মূল্য দিয়ে ফেলেছি। আমি বিশ্বাস করতে চাই, দেশের সার্বভৌমত্বের স্বার্থে সামরিক বাহিনীকে আমরা সবাই সব বিতর্কের ঊর্ধ্বে রাখতে সংকল্পবদ্ধ। জাতীয় নিরাপত্তার অতি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় নিয়ে খোলা মনে আলোচনা শুরুর অতীব গুরুত্বপূর্ণ কাজটির আয়োজক রাওয়াকে আজকের এই উদ্যোগ গ্রহণের জন্য আমি ধন্যবাদ জানাচ্ছি। ইতিহাস এবং রাষ্ট্রবিজ্ঞানের একজন গবেষক হিসেবে আমি বেশ কিছু প্রস্তাব আজ উত্থাপন করেছি। আশা করব, দেশের স্বার্থে আমার প্রস্তাব নিয়ে অর্থবহ বিতর্ক শেষে আমরা সবার কাছে গ্রহণযোগ্য ও দেশের জন্য সর্বোত্তম একটি পদ্ধতি প্রণয়ন করতে সক্ষম হব। আপনাদের সবাইকে ধন্যবাদ।