
দেশে প্রবীণ জনগোষ্ঠী বাড়ছে। এর সঙ্গে বাড়ছে পারকিনসন্স রোগী। তবে চিকিৎসায় আশানুরূপ অগ্রগতি নেই। পারকিনসন্স মস্তিষ্কের ক্ষয়জনিত রোগ, যা সাধারণত ৫০ থেকে ৬০ বছর পার হলে দেখা দেয়।
স্নায়ুরোগ বিশেষজ্ঞরা বলছেন, দেশে পারকিনসন্স রোগ ও চিকিৎসা নিয়ে কোনো গবেষণা কখনো হয়নি। এতে রোগটির সব তথ্য নিয়ে সঠিক পরিসংখ্যান কারো জানা নেই।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, দেশে প্রবীণ নাগরিকের সংখ্যা বাড়লেও তাঁদের যত্ন ও সহায়তার জন্য স্বাস্থ্যসেবা ব্যবস্থা এবং বিদ্যমান সুযোগ-সুবিধা যথেষ্ট নয়। স্বাস্থ্য সুরক্ষাসহ যথাযথ যত্ন দ্রুত নিশ্চিত করতে না পারলে ভবিষ্যতে সংকট তৈরি হতে পারে।
ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব নিউরোসায়েন্সেস হাসপাতালের ইন্টারভেনশনাল নিউরোলজি বিভাগের সহকারী অধ্যাপক ডা. হুমায়ুন কবীর হিমু কালের কণ্ঠকে বলেন, দুর্ভাগ্যজনক হলেও সত্য, এই রোগের সঙ্গে দেশের অনেকে পরিচিত নন। বার্ধক্যজনিত সমস্যা মনে করে বেশির ভাগ মানুষ চিকিৎসার জন্য আসেন না। ষাটোর্ধ্ব ব্যক্তিদের মধ্যে যাঁরা হাসপাতালে বা চেম্বারে চিকিৎসার জন্য আসেন, তাঁদের মধ্যে ১০ শতাংশ পারকিনসন্স রোগী পাচ্ছি। ৮০ বছরের বেশি বয়সীদের প্রায় অর্ধেক এ রোগে আক্রান্ত।
ডা. হুমায়ুন কবীর হিমু বলেন, বিশ্বে পারকিনসন্স রোগের প্রাদুর্ভাব বেড়েছে। কারণ প্রবীণ মানুষের সংখ্যা বাড়ছে। বাংলাদেশে প্রবীণ মানুষের সংখ্যা বাড়লেও তাঁদের স্বাস্থ্য সুরক্ষা ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে না। জাতীয় পর্যায়ে এ বিষয়ে এখনই পদক্ষেপ নেওয়া দরকার।
এমন পরিস্থিতির মধ্যে বিশ্বের অন্যান্য দেশের মতো আজ বাংলাদেশে পালিত হচ্ছে ‘বিশ্ব পারকিনসন্স দিবস’। ১৮১৭ সালে জেমস পারকিনসন্স নামের ইংরেজ শল্যচিকিৎসক রচিত ‘শেকিং পালসি’ নামে পারকিনসন্স রোগ নিয়ে প্রথম প্রবন্ধ প্রকাশিত হয়। তাঁর জন্মদিন ১১ এপ্রিল পারকিনসন্স দিবস পালিত হয়। তাঁরই নামানুসারে এই রোগের নামকরণ হয়েছে। দিবসটির এবারের প্রতিপ্রাদ্য বিষয়— ‘বিজ্ঞানী ও চিকিৎসকদের ক্ষমতায়ন : আবিষ্কার এবং যত্ন উদ্ভাবন ত্বরান্বিত করুন’।
পারকিনসন্স রোগের লক্ষণ : সাধারণত হাতের কাঁপুনির মাধ্যমে এই রোগের লক্ষণ প্রকাশ পায়। ধীরে ধীরে তা বাড়তে থাকে। হাঁটাচলা করতে সমস্যা দেখা দেয়। রোগী সামনের দিকে ঝুঁকে ছোট ছোট পায়ে হাঁটতে থাকে। মাংসপেশি শক্ত হয়ে যায়। এ রোগে আক্রান্তদের চেহারা দেখে মনে হবে তাদের কোনো আবেগানুভূতি নেই। গলার স্বর ভারী ও একঘেয়ে হয়ে থাকে। কথায় জড়তা আসে। হাঁটার সময় হাত শরীরের সঙ্গে লেগে থাকে। বিষণ্নতায় বেশি ভোগে। রাতে ঘুমের ঘোরে হাত-পা ছোড়া, ঘুমের ব্যাঘাত ঘটা, কোষ্ঠকাঠিন্য হওয়া, ঘ্রাণশক্তি কমে যাওয়া—এসব সমস্যা দেখা দিতে পারে।
রোগটি হওয়ার কারণ : স্নায়ুরোগ বিশেষজ্ঞরা বলছেন, পারকিনসন্স রোগের নির্দিষ্ট কোনো কারণ এখনো জানা যায়নি। তবে বংশপরম্পরা, দীর্ঘকাল ধরে সার ও কীটনাশকের মতো রাসায়নিক পদার্থের সংস্পর্শে থাকা, মস্তিষ্কে জড় পদার্থের কণা জমা হওয়া ইত্যাদি কারণে পারকিনসন্স হতে পারে।
বিশেষজ্ঞদের তথ্য মতে, মস্তিষ্কের ছোট একটি অংশ, যেটিকে চিকিৎসাবিজ্ঞানের ভাষায় ‘সাবস্ট্যানশিয়া নাইগ্রা’ বলা হয়, এই অংশের স্নায়ুকোষ বা নিউরন শুকিয়ে যাওয়ার কারণে ডোপামিন নামক নিউরোট্রান্সমিটার (এক ধরনের রাসায়নিক পদার্থ) নষ্ট হয়ে যায় অথবা এর ঘাটতি দেখা দেয়। ডোপামিন যেহেতু একটি প্রোটিন, তাই রক্তে এর কার্যকর শোষণ নিশ্চিত করতেও বিভিন্ন ওষুধ দরকার হয়। তবে একসময় এই ডোপামিন প্রয়োগেও কোনো কাজ হয় না। তখন প্রয়োজন হতে পারে অস্ত্রোপচারের।
ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব নিউরোসায়েন্সেস হাসপাতালের ক্লিনিক্যাল নিউরোলজি বিভাগের অধ্যাপক ডা. এম এস জহিরুল হক চৌধুরী কালের কণ্ঠকে বলেন, পারকিনসন্স রোগের নির্দিষ্ট চিকিৎসা নেই, তবে ওষুধের মাধ্যমে রোগীর কিছুটা উন্নতি হতে পারে। ক্ষেত্রবিশেষে মস্তিষ্কে আক্রান্ত অংশে সার্জারির মাধ্যমে সামান্য উন্নতি করা সম্ভব।
জহিরুল হক চৌধুরী বলেন, দুঃখের বিষয় হচ্ছে, এই রোগ কখনো পুরোপুরি ভালো হয় না। ওষুধ প্রয়োগে লক্ষণগুলো হয়তো দীর্ঘ সময়ের জন্য নিয়ন্ত্রণ করা যায়। এক পর্যায়ে রোগ নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যেতে পারে। তবে রোগীর চিকিৎসা কখনো বন্ধ করা উচিত নয়। কারণ নিয়মিত চিকিৎসা নিলে একজন রোগী শয্যাশায়ী হতে ২০ বছর সময় লাগতে পারে। চিকিৎসা না নিলে তিন-চার বছরে শয্যাশায়ী হয়ে পড়ে।