
বিশ্বের অর্ধেকের বেশি মানুষের প্রধান খাদ্য চাল। প্রতিদিন এই শস্য গ্রহণ করে কোটি কোটি মানুষ। কিন্তু নতুন এক গবেষণা বলছে, জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে চালের মধ্যে আর্সেনিকের পরিমাণ বাড়তে পারে—যা ভবিষ্যতে বৈশ্বিক জনস্বাস্থ্যের জন্য বড় হুমকি হয়ে উঠতে পারে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, কার্বন নিঃসরণ বৃদ্ধি ও পৃথিবীর তাপমাত্রা বাড়ার সঙ্গে চালে আর্সেনিকের মাত্রা বাড়তে পারে। গবেষণাটি দ্যা ল্যানসেট প্লানেটারি হেলথ জার্নালে প্রকাশিত হয়েছে। এতে যুক্ত ছিলেন জনস হপকিন্স ব্লুমবার্গ স্কুল অব পাবলিক হেলথ ও চাইনিজ একাডেমি অব সায়েন্সের গবেষকরা। খবর বিবিসি।
চাল বা ধানে আর্সেনিকের উপস্থিতি নতুন কোনো বিষয় নয়। প্রায় সব ধরনের চালেই কিছু পরিমাণে আর্সেনিক থাকে। এই ক্ষতিকর প্রাকৃতিক রাসায়নিক পদার্থ ধানখেতের মাটিতে জমা হয়। সেখান থেকে ধানের দানায় প্রবেশ করে।
অজৈব আর্সেনিক জমা হওয়া নিয়ে একটি নতুন গবেষণায় দেখা গেছে, জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে এটি আরো বড় সমস্যা হয়ে উঠতে পারে। গবেষকরা চীনের চারটি ভিন্ন স্থানে ১০ বছর ধরে ২৮টি ভিন্ন ধানের জাত পরীক্ষামূলকভাবে চাষ করেছেন। তারা দেখেছেন, বায়ুমণ্ডলে কার্বন ডাই-অক্সাইড ও তাপমাত্রা বাড়ার সঙ্গে চালে আর্সেনিকের মাত্রাও বেড়েছে। এরপর মহামারিবিদরা মডেল তৈরি করে দেখেছেন, বর্তমান হারে ভাত খাওয়া হলে এই আর্সেনিকের মাত্রা মানুষের স্বাস্থ্যে কী প্রভাব ফেলতে পারে। তাদের অনুমান, শুধু চীনেই এই বৃদ্ধির কারণে অতিরিক্ত প্রায় ২ কোটি ক্যান্সার রোগী দেখা দিতে পারে।
গবেষণায় বলা হয়েছে আমরা যে চাল খাই তাতে অজৈব আর্সেনিক রয়েছে। এটি মূলত শিলাসমৃদ্ধ মাটি, শিল্পবর্জ্য এবং কয়লা পোড়ানোর ফলে জমিতে জমা হয়। ধানগাছ তার শিকড় দিয়ে এটি শোষণ করে। একবারে গ্রহণ করলে এটি ততটা বিষক্রিয়ামূলক নয়, কিন্তু দীর্ঘদিন ধরে সামান্য পরিমাণ গ্রহণ করলে মারাত্মক স্বাস্থ্যঝুঁকি তৈরি করতে পারে। যার মধ্যে সবেচেয় বেশি ঝুঁকি রয়েছে ক্যান্সারের। এছাড়া আর্সেনিক শুধু ক্যানসার নয়, হৃদরোগ এবং টাইপ-২ ডায়াবেটিসের ঝুঁকিও বাড়ায়। গবেষণাটিতে আরো উঠে এসেছে, গর্ভবতী নারীরা যদি আর্সেনিকযুক্ত চাল গ্রহণ করেন, তবে গর্ভস্থ সন্তানের স্বাস্থ্যঝুঁকি বহুগুণে বেড়ে যায়। শিশুর কম ওজন নিয়ে জন্ম, শিশু মৃত্যুর হার বৃদ্ধি, মানসিক ও শারীরিক বিকাশে বাধা দেখা দিতে পারে।
গবেষণা দলের সদস্য ও কলম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিবেশ স্বাস্থ্যবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক লুইস জিস্কা বলেন, আর্সেনিককে শত শত গবেষণায় ক্যানসার সৃষ্টিকারী হিসেবে প্রমাণ করা হয়েছে। এটি ফুসফুস, হৃদপিণ্ডসহ শরীরের নানা অঙ্গ-প্রত্যঙ্গে বিরূপ প্রভাব ফেলে। এখন দেখা যাচ্ছে, জলবায়ু পরিবর্তনের দুটি মূল উপাদান কার্বন ডাই অক্সাইড ও তাপমাত্রা বৃদ্ধি এই আর্সেনিক বৃদ্ধির জন্য দায়ী।
গবেষণার পূর্বাভাস অনুযায়ী, যদি ২০২৫ থেকে ২০৫০ সালের মধ্যে বৈশ্বিক তাপমাত্রা ২ ডিগ্রি সেলসিয়াস বাড়ে এবং বাতাসে কার্বন ডাই অক্সাইডের পরিমাণ ২০০ পিপিএম বৃদ্ধি পায়, তবে চালের মধ্যে আর্সেনিকের মাত্রা ভয়ংকরভাবে বাড়তে পারে।
গবেষকরা অবশ্য স্বীকার করেছেন, গবেষণায় কিছু সীমাবদ্ধতাও আছে। যেমন—২০৫০ সালেও মানুষ বর্তমান হারে চাল খাবে ধরে নেয়া হয়েছে। যদিও অনেক উন্নয়নশীল দেশে ধীরে ধীরে চাল খাওয়ার হার কমছে। এছাড়া গবেষণায় মূলত সাদা চালের ওপর ফোকাস করা হয়েছে, যা তুলনামূলকভাবে ব্রাউন রাইসের চেয়ে কম আর্সেনিক ধারণ করে।
তবে বিশ্বজুড়ে মানুষের খাদ্যাভ্যাস বিবেচনা করলে দেখা যায়, শুধু চালই অনেক অঞ্চলে আর্সেনিকের মূল উৎস। এমনকি ইউরোপ এবং আমেরিকার মতো অঞ্চলে যেখানে পানিতে আর্সেনিকের উপস্থিতি কম, চালই খাদ্য-ভিত্তিক আর্সেনিক গ্রহণের প্রধান মাধ্যম। কিন্তু চালেই কেন এই ঝুঁকি? গবেষকরা বলছেন, বিশ্বের ৭৫ শতাংশ ধান সেচের মাধ্যমে চাষ করা হয়। ধানখেত জলে ভরা থাকে, যা আগাছা নিয়ন্ত্রণে সাহায্য করে। কিন্তু জলের নিচে মাটিতে অক্সিজেনের অভাব হয়, যার ফলে মাটির অ্যানেরোবিক ব্যাকটেরিয়া আর্সেনিককে ইলেকট্রন গ্রহণকারী হিসেবে ব্যবহার করে। এটি আর্সেনিককে আরো সহজে ধানের শিকড় দ্বারা শোষণযোগ্য করে তোলে। জিস্কা বলেন, তাপমাত্রা ও কার্বন ডাই অক্সাইড বৃদ্ধির সঙ্গে মাটির এই ব্যাকটেরিয়াগুলো আরো সক্রিয় হয়ে উঠবে, ফলে আর্সেনিক শোষণের হার বাড়বে।
তবে এই ঝুঁকি এড়ানোর উপায়ও আছে। গবেষকরা বলছেন, ধান চাষের পদ্ধতি পরিবর্তন করতে হবে। কিছু পদ্ধতি, যেমন আংশিকভাবে খেত ভেজানো ও শুকানো আর্সেনিক কমাতে সাহায্য করতে পারে। তবে এটি ক্যাডমিয়ামের মাত্রা বাড়িয়ে দিতে পারে, যা আরো বিপজ্জনক। আর্সেনিক কম শোষণ করে এমন ধানের জাত তৈরি নিয়েও গবেষণা চলছে। এছাড়া, পানিতে সালফার যোগ করা বা জৈব সারের ব্যবহার আর্সেনিক কমাতে সাহায্য করতে পারে।
অধ্যাপক জিস্কা বলেন, চালের উৎপাদন ব্যবস্থাপনায় বড় পরিবর্তন আনতে হবে। এটি একটি বৈশ্বিক সমস্যা। মোকাবিলায় দ্রুত ও কার্যকর পদক্ষেপ প্রয়োজন। তার মতে, জলবায়ু পরিবর্তনের ক্ষতিকর প্রভাব আমাদের ভারতের প্লেটেও এসে পৌঁছেছে। এখন সিদ্ধান্ত নেয়ার পালা আমাদের।