
বিকেল গড়িয়ে তখন চারপাশ অন্ধকার হতে শুরু করেছে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের (ঢাবি) অ্যাকাডেমিক কার্যক্রম শেষে হলে বা বাসায় ফিরেছেন শিক্ষক-শিক্ষার্থী ও কর্মকর্তা-কর্মচারীরা। এমন সময়েও চারুকলা ইনস্টিটিউটের দেওয়া গেল ভিন্ন দৃশ্য। বেশ ব্যস্ত সময় পার করছে শিক্ষক-শিক্ষার্থীরা। তুলি হাতে নিয়ে হরেক রংয়ে ফুটিয়ে তুলছেন বিভিন্ন ধরনের মাসকট, সরাচিত্র, মুখোশ আর মোটিফ।
বুধবার (৯ এপ্রিল) শিক্ষক-শিক্ষার্থীরা জানান, অন্তত ২০ দিন ধরে এখানে বাংলা নববর্ষ বরণের প্রস্তুতি চলছে। এর পেছনে প্রতিদিন কমপক্ষে ১০ থেকে ১৫ জন শিক্ষক-শিক্ষার্থী-কারিগররা কাজ করছেন। তারা পাশেই তাদের শিল্পকর্ম বিক্রির জন্য রেখেছেন। মূলত এসব বিক্রি করেই শোভাযাত্রার বড় অংশের খরচ মেটানো হয়।
নতুন বাংলাদেশে এক নতুন চৈত্র নেমেছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা অনুষদের প্রঙ্গনে। শাহবাগ থেকে টিএসসি অভিমুখে রওনা হওয়া যে কারও চোখ আটকে পড়বে বিশাল দেহী এক রাক্ষসী অবয়বে তৈরি করা শিল্পকাঠামোয়। পথচারীদের কাছে এই অবয়ব নতুন হলেও এর ডিজিটাল ছবি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে দেখেছেন অনেকে।
বাংলা নববর্ষকে বরণ করে নিতে প্রতি বছর ‘মঙ্গল শোভাযাত্রা’ নামে শোভাযাত্রা করা হয়। যদিও এ নাম নিয়ে এবার যথেষ্ট বিতর্ক হয়েছে। আগামীকাল সংবাদ সম্মেলন করে নামের বিষয়ে সিদ্ধান্ত জানানো হবে। এবার নববর্ষের প্রতিপাদ্য হলো ‘নববর্ষের ঐকতান, ফ্যাসিবাদের অবসান।’
জুলাই অভ্যুত্থান পরবর্তী এই ছবিই দেশের জনগণের কাছে স্বৈরাচারের অবয়ব হিসেবে পরিচিতি পেয়েছে। চৈত্রের বিকেলে খানিকটা কর্কশ রোদের নিচে দাঁড়িয়ে থাকা বস্তুটা সহসাই আকৃষ্ট করছে পথচারীদের। অতঃপর রাগী সূর্যকে উপেক্ষা করেই চারুকলা অনুষদের ভিতরে ঢুকেই চোখে সামনে হাজির হলো এক ভিন্ন চিত্র। আপাতদৃষ্টিতে বাহির থেকে বোঝার উপায় নেই, ভেতরে চলছে কী ধরনের কর্মযজ্ঞ।
আসন্ন বাংলা নববর্ষ-১৪৩২ বরণ করে নিতে এবারের আকর্ষণ দীর্ঘদেহী এক রাক্ষস। যার মাথায় রয়েছে দুটি শিং এবং মুখের দুপাশে দুটি দীর্ঘ দাঁত। এছাড়া এবারের শোভাযাত্রায় স্থান পাবে বাঁশ ও কাঠ দিয়ে তৈরি একটি পায়রা, গ্রামীণ ঐতিহ্য লালনকারী এক সময় বিয়েতে ব্যবহৃত পালকি, রয়েল বেঙ্গল টাইগার, ইলিশসহ অনেক কিছু। জুলাই অভ্যুত্থানের মুগ্ধের পানি পানি বলে চিৎকার করার বিষয়টিকে ফুটিয়ে তুলতে থাকবে বৃহদাকারের পানির বোতল।
কারিগর রিপন হোসেন বলেন, ‘আমরা প্রায় ২০ দিন আগ থেকে কাজ শুরু করেছি। আরো দুই-তিন দিন লাগবে।’ রাক্ষুসে শিংওয়ালা অবয়ব নিয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘এটি কার তৈরি করা হয়েছে আমরা জানি না। আমাদের এভাবে তৈরি করতে বলেছে, তাই আমরা এভাবে তৈরি করেছি।’
বিগত বছরগুলোর মতোই এবারও শোভাযাত্রায় স্থান পাবে বাঘ ও রাজা-রানির মুখোশ। বর্ণিল সাঝে ফুটিয়ে তোলা হচ্ছে সরাচিত্রসহ বিভিন্ন মাসকট। এছাড়া এবারে শোভাযাত্রায় বিশেষ আকর্ষণ হিসেবে থাকবে চিত্রকলার ঐতিহ্যের গৌরব ‘পটশিল্প’। ১০ ফুট দৈর্ঘের মোট পাঁছটি পটচিত্র অঙ্কন করা হবে বলে জানা গেছে।
শিল্পী রুবিনা নারগিস বলেন, ‘বিগত বছরগুলোর তুলনায় এ বছর একদম ভিন্ন প্রেক্ষাপট। আমরা একদম স্বাধীন এবং আনন্দমুখর পরিবেশে কাজ করছি। আগে আমরা প্রাণখুলে কথাও বলতে পারতাম না। কাজ করতে আসতেও একটা দ্বিধা-ভীতি কাজ করতো। এখন সবার মাঝে আনন্দ পরিলক্ষিত হচ্ছে। সবাই উচ্ছ্বাসের সঙ্গে কাজ করছে।’
বাংলা নববর্ষকে বরণ করে নিতে প্রতি বছর ‘মঙ্গল শোভাযাত্রা’ নামে শোভাযাত্রা করা হয়। যদিও এ নাম নিয়ে এবার যথেষ্ট বিতর্ক হয়েছে। আগামীকাল সংবাদ সম্মেলন করে নামের বিষয়ে সিদ্ধান্ত জানানো হবে। এবার নববর্ষের প্রতিপাদ্য হলো ‘নববর্ষের ঐকতান, ফ্যাসিবাদের অবসান।’
বিশ্ববিদ্যালয়ের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, এ শোভাযাত্রা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বহুদিনের ঐতিহ্যের পরিচায়ক। এ ঐতিহ্য ও স্বকীয়তা অব্যাহত রেখে অধিকতর অন্তর্ভুক্তিমূলক করার জন্য আরও বড় পরিসরে, বৈচিত্র্যপূর্ণভাবে, লোক-ঐতিহ্য ও ২৪-এর চেতনাকে ধারণ করে। এ বছর শোভাযাত্রায় সর্বজনীন অংশগ্রহণের ব্যবস্থা করা হবে।
অন্য বছরগুলোয় পুরো এ আয়োজনের দায়িত্ব নির্দিষ্ট একটি ব্যাচের কাছে থাকতো। তবে এবার আর তা হচ্ছে না। চলতি সব ব্যাচের শিক্ষার্থীরাই এবার সরাসরি এ কাজের সঙ্গে জড়িত। শিক্ষার্থীরা বলেন, একটি নির্দিষ্ট ব্যাচের দায়িত্বে থাকলে সকল শিক্ষার্থীদের আগ্রহ দেখায় না। সবাই আসতেও চান না একাজ করতে। তাই এবার সব ব্যাচের ছাত্র-শিক্ষক মিলে একসঙ্গে কাজটা করছে।
বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাচ্যকলা বিভাগের মুয়িদ হাসান শুভ বলেন, ‘এতদিন যে অরাজকতা চলছিল, এটাতে সবাই অতিষ্ট ছিল। এর বহিঃপ্রকাশ আমরা সব জায়গায় দেখছি। এরি ধারাবাহিকতায় এবারের শোভাযাত্রায়ও আমরা তারই বহিঃপ্রকাশ দেখতে পাচ্ছি।’
শিল্পী আরিফ শাহিন বলেন, ‘আগে (শোভাযাত্রা) যে চিন্তা-চেতনা নিয়ে করা হতো, তা ছিল আরোপিত। কাউকে অতি উচ্চ মর্যাদায় আর কাউকে ছোট করা বা হেয় করা হতো। আগে চাটুকারিতা করা হতো। চারুকলাও এর থেকে মুক্ত ছিল না। এখনও হয়তো অনেকে করছে।’
সার্বিক বিষয়ে চারুকলা অনুষদের ডিন অধ্যাপক ড. মো. আজহারুল ইসলাম শেখ বলেন, ‘বিগত বছরগুলোর মতো এবারের শোভাযাত্রায় পেঁচার অবয়ব থাকছে না। এছাড়া আবু সাঈদের পারিবারিক বিষয়টি বিবেচনায় নিয়ে তার বিষয়টিও রাখা হচ্ছে না।’
তিনি বলেন, ‘প্রস্তুতির কাজ চলছে এবং আমরা একটা সংবাদ সম্মেলনে এর হালনাগাদ তুলে ধরব। এবারের শোভাযাত্রার নাম সংবাদ সম্মেলনে ঘোষণা হবে।’