Image description

আমাদের দেশে কাগুজে নোটের প্রচলন বেশি। এসব নোটের স্থায়িত্ব সাধারণত ছয় থেকে আট মাস। এই সময়ের মধ্যেই অধিকাংশ নোট ব্যবহার অনুপোযোগী হয়ে পড়ে। কয়েনে খরচ বেশি হলেও দীর্ঘস্থায়ী। কয়েক বছর আগে পলিমার নোট ছেপেও খুব ফায়দা হয়নি। পুরোনো নোট তুলে নিয়ে বিনষ্ট করে নতুন নোট ছাপতে বছরে সরকারের খরচ হয় সাড়ে চার থেকে পাঁচশ কোটি টাকা। এবার সেই খরচ ঠেকতে পারে দেড় হাজার কোটিতে।

বাংলাদেশ ব্যাংকের টাকা ছাপানোর সঙ্গে সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে কথা বলে এসব তথ্য জানা যায়।

কখন নতুন নোট ছাপায় কেন্দ্রীয় ব্যাংক?

মূলত ব্যবহারের পদ্ধতিগত কারণে ছাপানো নতুন কাগজের নোটের স্থায়িত্ব কমছে। বিপরীতে খরচ বেশি পড়লেও ধাতব কয়েনের স্থায়িত্ব অনেক বেশি। ছেঁড়া-ফাটা নোট বিনিময় করে সেগুলো পুড়িয়ে ফেলে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। এসব নোটের বিপরীতে পরবর্তীসময়ে ইস্যু করা হয় নতুন নোট। চাহিদা অনুযায়ী প্রতি বছর শুধু নতুন নোট ছাপাতে সরকারের বিপুল টাকা খরচ হয়। এই খরচের লাগাম টানতে ক্যাশলেস কিউআর (কুইক রেসপন্স) লেনদেনে ঝুঁকছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক।

যে কারণে এবার খরচ বাড়ছে

দেশের রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর নতুন টাকার নকশায় পরিবর্তন আনছে সরকার। সব ধরনের নোটেই নকশা পরিবর্তন হবে। এর আগে ডিজাইন অক্ষুণ্ন রেখে শুধু প্রিন্ট করা হতো। এবার নতুন নোটে থাকবে না শেখ মুজিবুর রহমানের ছবি। যুক্ত হবে ধর্মীয় স্থাপনা, বাঙালি ঐতিহ্যসহ জুলাই বিপ্লবের গ্রাফিতি। নতুন ডিজাইনের জন্য রয়েছে পারিশ্রমিক। আর আগের তুলনায় স্বাভাবিকভাবেই বাড়বে নোটের পরিমাণ। কারণ, পুরোনো ডিজাইনের নোট ধীরে ধীরে বাজার থেকে তুলে নেওয়ার পরিকল্পনা রয়েছে সরকারের। এর আগে টাকা ছাপতে বছরে পাঁচশ কোটি টাকার মতো খরচ হলেও এবার খরচ পড়বে প্রায় দেড় হাজার কোটি টাকা।

 

 

টাকা ছাপাতে হলে রিজার্ভ ও পর্যাপ্ত গোল্ড থাকতে হবে। চাইলেই টাকা ছাপানো যায় না, কিছু বাধ্যবাধকতা আছে। সরকার যদি চায় সহায়তা নিতে, সেক্ষেত্রে সরকারের অনুরোধে একটা বাধ্যবাধকতা চলে আসে। সরকার, সেন্ট্রাল ব্যাংক ও বোর্ডের অনুমোদনের মাধ্যমে টাকা ছাপানো হয়।-বিশ্বব্যাংক ঢাকা কার্যালয়ের সাবেক প্রধান অর্থনীতিবিদ ড. জাহিদ হোসেন

তবে ঠিক কত টাকার নতুন নোট ছাপা হবে সে বিষয়ে স্পষ্ট কিছু বলেননি বাংলাদেশ ব্যাংকের দায়িত্বশীলরা। নতুন ডিজাইনসহ নোট বাজারে আনতে ঈদ সামনে রেখে এবার কোনো নতুন নোট বাজারে ছাড়েনি কেন্দ্রীয় ব্যাংক।

বাংলাদেশ ব্যাংকের সংশ্লিষ্ট বিভাগ সূত্র জাগো নিউজকে জানায়, ছাপানো নোট এখন আর আগের মতো বেশিদিন টিকছে না। মাত্র ছয় মাসেই নষ্ট হচ্ছে, যে নোটগুলো (ছেঁড়া-ফাটা) বাংলাদেশ ব্যাংকে সংরক্ষণ করার পর তা পুড়িয়ে ফেলা হয়। পুড়িয়ে ফেলা ব্যবহার অযোগ্য নোট ও বাজার সার্কুলেশন বা অর্থের প্রবাহের বিষয়টি দেখেই পরে নতুন নোট ছাপানো হয়। এক্ষেত্রেও মার্কেট টুলস ব্যবহার করে পর্যালোচনা করে দেখা হয়। সেখানে উঠে আসে কী পরিমাণ নতুন টাকার দরকার পড়বে। সেভাবেই ছাপিয়ে বাজারের চাহিদার ভিত্তিতে ছাড়া হয়।

বিভাগটির ঊর্ধ্বতন এক কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করা শর্তে জাগো নিউজকে বলেন, ‘এবার সব ধরনের নোটে নকশায় পরিবর্তন আনা হয়েছে। পুরো জাতির দাবি নতুন নকশা। সে আলোকে নোট ছাপানো হচ্ছে। খরচ এখন ফ্যাক্টর নয়। তবে কয়েনের বিষয়ে এখনো সিদ্ধান্ত হয়নি। স্বাভাবিকভাবেই তিন গুণ পর্যন্ত খরচ বাড়বে এবার।’

 

কোন নোট ছাপাতে কত খরচ হয়

এবারের হিসাবটা একটু ভিন্ন হওয়ায় নতুন নোট ছাপাতে লাগছে বাড়তি টাকা। তবে সাধারণ সময়ে নোটপ্রতি খরচের একটি হিসাব আছে। এ হিসাব শুধু ছাপানোর জন্য প্রযোজ্য।

বাংলাদেশ ব্যাংকের সংশ্লিষ্ট বিভাগের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা জাগো নিউজকে বলেন, ১০০০ টাকার নোট ছাপাতে ৫ টাকা ও ৫০০ টাকার নোট ছাপানোয় খরচ পড়ে ৪ টাকা ৭০ পয়সা। এছাড়া ২০০ টাকার নোটে তিন টাকা ২০ পয়সা, ১০০ টাকার নোটে ৪ টাকা, ১০, ২০ ও ৫০ টাকার সবগুলো নোটই দেড় টাকা খরচ পড়ে। এছাড়া ৫ টাকা, ২ টাকার নোট ছাপাতে খরচ পড়ে ১ টাকা ৪০ পয়সা। সবচেয়ে বেশি খরচ হয় কয়েন তৈরিতে। প্রতিটি কয়েনে সমপরিমাণ টাকা খরচ পড়ে যায়। বিশ্বব্যাপী কাঁচামালের দাম বাড়ার কারণে এই খরচ কিছুটা বেড়েছে।

ঈদ উপলক্ষে নতুন টাকা মিলছে শুধু মতিঝিল ব্যাংকপাড়ার ফুটপাতে/মাহবুব আলম

খরচ কমাতে বিকল্প চিন্তা

কাগুজে নোটে খরচ বেশি পড়ায় বিকল্প চিন্তাও করছে বাংলাদেশ ব্যাংক। আর্থিকখাতের এ নিয়ন্ত্রক সংস্থাটি ধীরে ধীরে ক্যাশলেসের দিকে এগোচ্ছে। এজন্য ডিজিটাল প্ল্যাটফর্ম আনা হয়েছে, ছোট-বড় দোকান কিংবা মার্কেটে বসানো হয়েছে কিউআর কোড। যার মাধ্যমে লেনদেন করছেন। এ মাধ্যম সর্বত্র ছড়িয়ে দিতে এর আগেও উদ্যোগ নেয় কেন্দ্রীয় ব্যাংক। যেখানে ১০ টাকা থেকে সব ধরনের পেমেন্ট দেওয়ার ব্যবস্থা রাখা হয়েছে। কিউআর কোডের মাধ্যমে সর্বত্র লেনদেনের ধারণা সচেতনতার অভাবে খুব বেশি জনপ্রিয়তা পাচ্ছে না।

নতুন নকশার নোট বাজারে আসবে কবে?

সূত্র জানায়, সাধারণত দুই ঈদের সময় ২৫ থেকে ৩০ হাজার কোটি টাকার নতুন নোট ছাড়ে বাংলাদেশ ব্যাংক। বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোও নিজেদের কাছে থাকা নতুন নোট বিনিময় করে। তবে বাজারের চাহিদা বিবেচনায় নিয়েও নোট ছাড়া হয় কোনো কোনো সময়। মূলত বাজারে পরিচ্ছন্ন নোট নিশ্চিতে ছেঁড়াফাটা নোট তুলে নিয়ে যথা নিয়মে ধ্বংস করে নতুন নোট প্রতিস্থাপন করে বাংলাদেশ ব্যাংক।

এর আগে ডিজাইন অক্ষুণ্ন রেখে টাকা শুধু প্রিন্ট করা হতো। এখন যারা ডিজাইন করে দেবেন সেসব দেশবরেণ্য চিত্রশিল্পীকে একটা বড় অ্যামাউন্ট দিতে হবে। সবগুলোই নতুন নকশায় ছাপানো হবে- এটা প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। এখানে নোটের পরিমাণও বাড়বে। এতে স্বাভাবিকভাবেই খরচ বাড়বে। খরচ কয়েকগুণ হবে।- বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্বাহী পরিচালক ও মুখপাত্র আরিফ হোসেন খান

নতুন নকশার নোট মুদ্রণের কার্যক্রম চলমান। আগামী এপ্রিলের শেষ অথবা মে মাসের শুরুতেই বাজারে আসবে নতুন নকশার নোট। তার আগ পর্যন্ত বাজারে নগদ অর্থের চলমান চাহিদা মেটাতে বিদ্যমান নকশার নোট বাজারে থাকছে। নতুন নোটে শেখ মুজিবুর রহমানের ছবির পরিবর্তে যুক্ত হবে ধর্মীয় স্থাপনা, বাঙালি ঐতিহ্যসহ জুলাই বিপ্লবের গ্রাফিতি।

এ বিষয়ে বিশ্বব্যাংক ঢাকা কার্যালয়ের সাবেক প্রধান অর্থনীতিবিদ ড. জাহিদ হোসেন জাগো নিউজকে বলেন, ‘টাকা ছাপাতে হলে রিজার্ভ ও পর্যাপ্ত গোল্ড থাকতে হবে। চাইলেই টাকা ছাপানো যায় না, কিছু বাধ্যবাধকতা আছে। সরকার যদি চায় সহায়তা নিতে, সেক্ষেত্রে সরকারের অনুরোধে একটা বাধ্যবাধকতা চলে আসে। সরকার, সেন্ট্রাল ব্যাংক ও বোর্ডের অনুমোদনের মাধ্যমে টাকা ছাপানো হয়। আবার ফাইন্যান্সিয়াল কারেন্সি ডিপার্টমেন্ট টাকা ছাপায় যেটা নির্ভর করে, রিকয়ারমেন্ট কত আছে কিংবা পুরোনো নোট যখন ইকোনমি এক্সপান্ড করে সে হিসাবে।’

টাকা ছাপানোর খরচের বিষয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্বাহী পরিচালক ও মুখপাত্র আরিফ হোসেন খান জাগো নিউজকে বলেন, ‘এর আগে ডিজাইন অক্ষুণ্ন রেখে টাকা শুধু প্রিন্ট করা হতো। এবার এখন যারা ডিজাইন করে দেবেন সেসব দেশবরেণ্য চিত্রশিল্পীকে একটা বড় অ্যামাউন্ট দিতে হবে। যেটা আগে দেওয়া হয়নি। এখন সব ধরনের নোট ছাপতে হবে এটা বলে দিয়েছি। যদিও একসঙ্গে সব ধরনের নোট বাজারে আসবে না। সবগুলোই নতুন নকশায় ছাপানো হবে- এটা প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। এখানে নোটের পরিমাণও বাড়বে। এতে স্বাভাবিকভাবেই খরচ বাড়বে। খরচ কয়েক গুণ হবে।’