Image description

প্রথম দফা ১৯৯৮, দ্বিতীয় দফা ২০০৩ সালে। সর্বশেষ ২০০৮ সালে কালনী নদীতে ভেঙে যায় উপেন্দ্র বৈষ্ণবের (৪৫) বসতভিটা। তিনবার নদীভাঙনের শিকার হয়ে তিনি এখন অনেকটাই নিঃস্ব। বসতভিটার ৫৬ শতাংশের মধ্যে ৫০ শতাংশই নদীতে বিলীন হয়ে গেছে। যে ৬ শতাংশ অবশিষ্ট আছে, তা-ও এখন ভাঙনের হুমকিতে।

উপেন্দ্রর বাড়ি সুনামগঞ্জের শাল্লা উপজেলার ভেড়াডহর গ্রামে। পাশ দিয়ে বয়ে গেছে কালনী নদী। গ্রামের অন্তত ২০০ থেকে ৩০০ পরিবার এ নদীর ভাঙনের শিকার হয়েছেন। এর মধ্যে উপেন্দ্রর বাড়ি ভেঙেছে সবচেয়ে বেশি। তিনি জানান, একটু একটু করে তাঁর বাড়ি ভাঙছে। তিনিও বসতভিটা সরাচ্ছেন। এখন ভিটার সর্বশেষ অংশে আছেন। এ অংশ ভাঙনের শিকার হলে তাঁর আর মাথা গোঁজার ঠাঁই থাকবে না।

সরেজমিনে দেখা গেছে, নদীর ঠিক পারেই উপেন্দ্রর টিনশেডের ছোট দুটি ঘর। একটি বসবাসের জন্য, অন্যটি গোয়ালঘর। নদীর তীর থেকে কয়েক হাত উঁচু করে মাটি ফেলে প্রায় তিন শতক জায়গার মধ্যে ভিটা প্রস্তুত করে ঘর দুটি তৈরি করা হয়েছে। ঘরের সামনে নদীঘেঁষা আরও প্রায় তিন শতক জায়গা উন্মুক্ত। চৈত্র মাসেও নদীতে ধীরলয়ে স্রোত প্রবাহিত হচ্ছে। আশপাশের কয়েক কিলোমিটার অংশে নদীভাঙনের চিহ্ন দেখা যাচ্ছে।

স্ত্রী, এক মেয়ে ও এক ছেলেকে নিয়ে উপেন্দ্রর সংসার। তিনি পেশায় কৃষিজীবী। ধান ও সবজি চাষ করেন। বসতভিটার মতো তাঁর অনেকখানি কৃষিজমিও ভাঙনের শিকার হয়েছে। যে টাকা তাঁর আয় হয়, তা দিয়ে সংসার চলে না। তাই সব সময় ধার-কর্জ করে চলতে হয়। এ ছাড়া পাঁচ বছর আগে আত্মীয়দের কাছ থেকে আড়াই লাখ টাকা ঋণ নিয়েছিলেন। অভাবের কারণে সে ধারও শোধ করতে পারছেন না।

বাড়ির ৬ শতাংশ এখন অবশিষ্ট আছে, সেটাও এখন ভাঙনের হুমকিতে
বাড়ির ৬ শতাংশ এখন অবশিষ্ট আছে, সেটাও এখন ভাঙনের হুমকিতেছবি: প্রথম আলো

উপেন্দ্র জানান, তাঁর মেয়ে রমা রানী বৈষ্ণব হবিগঞ্জ সরকারি মহিলা কলেজে দ্বাদশ শ্রেণিতে পড়ে। ছেলে উদয় কুমার বৈষ্ণব গ্রামের বিদ্যালয়ে পঞ্চম শ্রেণিতে পড়ে। মেয়েকে প্রতি মাসে সাত হাজার টাকা পাঠাতে হয়। অন্যদিকে ছেলের গৃহশিক্ষক বাবদ খরচ হয় এক হাজার টাকা। এ ছাড়া খাওয়াদাওয়াসহ পরিবারের যাবতীয় খরচ মেটাতে তাঁর লাগে আরও প্রায় ১৫ হাজার টাকা। প্রতি মাসে সমুদয় টাকা জোগাড় করতে তাকে হিমশিম খেতে হয়।

নিজের ও বর্গা মিলিয়ে চলতি বছর উপেন্দ্র ৪২ শতক জমিতে মরিচ ও আলু চাষ করেছেন বলে জানিয়েছেন। এতে তাঁর ব্যয় হয় ৫৫ হাজার টাকা। তবে এবার মরিচ ও আলুর দাম কম হওয়ায় তিনি লোকসানে পড়েছেন। এবার প্রতি মণ আলু ৮০০ টাকা এবং মরিচ মাত্র ৪০০ টাকায় পাইকারি দরে বিক্রি হচ্ছে। গত শুক্রবার পর্যন্ত তিনি ১৫ হাজার টাকার মরিচ ও আলু বিক্রি করেছেন। আরও প্রায় পাঁচ হাজার টাকার বিক্রি করতে পারবেন। বাকি টাকা তাঁর লোকসান।

উপেন্দ্র জানান, তাঁর নিজের এক একর জমি আছে। এর বাইরে আরও এক একর জমি তিনি বর্গা নিয়ে চাষ করেন। এসব জমিতে রোপা আমন ও বোরো চাষাবাদ হয়। তবে গত দুই বছর অকাল বন্যায় রোপা আমন তলিয়ে যায়। এখন দুই একর জমিতে বোরো চাষ করেছেন। প্রাকৃতিক দুর্যোগ না হলে আগামী বৈশাখ মাসে এসব ধান কাটবেন। ফসল ঠিকমতো ঘরে তুলতে না পারলে আবারও ধারকর্জ করতে হবে।

কালনী নদী উপেন্দ্রকে নিঃস্ব করে ফেলেছে বলে আক্ষেপ করলেন। তিনি বলেন, ‘ইন্টার (উচ্চমাধ্যমিক) পর্যন্ত পড়েছি। নদীতে বাড়ি ভেঙে যাওয়ায় অর্থনৈতিক টানাপোড়েনে আর পড়াশোনা এগোয়নি। এখান থেকে সরে যে অন্যত্র যাব, জায়গা কেনার সে টাকাও তো নেই। স্ত্রী-বাচ্চাদের শখ-আহ্লাদ তো দূরের কথা, প্রয়োজনটুকুই তো মেটাতে পারছি না। এক কালনী নদীই আমার জীবন শেষ করে দিল।’