
বহুল আলোচিত তিস্তা নদীতে বহুমুখী মেগা প্রকল্পের মহাপরিকল্পনা বাস্তবায়নে ইতিবাচক সাড়া দিয়েছে চীন। শুধু তাই নয়, জলবিদ্যুৎ, পূর্বাভাস, বন্যা প্রতিরোধ ও দুর্যোগ হ্রাস, নদী খনন, পানি সম্পদের সমন্বিত ব্যবস্থাপনা, পানি সম্পদ উন্নয়ন এবং সংশ্লিষ্ট প্রযুক্তি বিনিময়ের ক্ষেত্রেও সহযোগিতা জোরদার করতে সম্মত হয়েছে চীন। চলতি সপ্তাহে প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনুস চীন সফরে দেশটির শীর্ষনেতারা এতে সম্মতি দেন বলে জানা গেছে।
রোববার প্রধান উপদেষ্টার হাই রিপ্রেজেন্টেটিভ ড. খলিলুর রহমান সংবাদ সম্মেলনে বহুল আলোচিত তিস্তা প্রকল্প নিয়ে কাজ করতে চীনের ইতিবাচক সাড়া দেওয়ার বিষয়টি নিশ্চিত করেন।
এরফলে তিস্তা প্রকল্প বাস্তবায়ন নিয়ে দীর্ঘদিনের জটিলতার নিরসন হতে চলেছে। পবিত্র ঈদুল ফিতরের আগ মুহূর্তে এমন খবর যেন উত্তরের পাঁচ জেলার মানুষের জন্য ঈদ আনন্দের সঙ্গে বাড়তি আনন্দ যোগ করেছে।
‘তিস্তা বাচাও নদী বাঁচাও আন্দোলনের কেন্দ্রীয় সভাপতি নজরুল ইসলাম হক্কানি বলেন, তিস্তা প্রকল্প নিয়ে চীনের ইতিবাচক সম্মতিতে এ অঞ্চলের মানুষের মধ্যে নতুন আশার সঞ্চার করেছে। ঈদের আগে এমন খবর মানুষের মনে বাড়তি জাগাচ্ছে। তবে প্রকল্পটি যাতে ঝুঁলে না থেকে এ সরকারের আমলেই শুরু করা হয় সে দাবিও জানান তিনি।
‘তিস্তা নদী রক্ষা আন্দোলন কমিটি’র প্রধান সমন্বয়কারী ও বিএনপির রংপুর বিভাগীয় সাংগঠনিক সম্পাদক আসাদুল হাবিব দুলু চীনের এ উদোগকে স্বাগত জানিয়ে বলেছেন, এ অঞ্চলের মানুষের দীর্ঘদিনের দাবি তিস্তা প্রকল্প বাস্তবায়নের, এর সঙ্গে জড়িত ৫ জেলার মানুষের সুখ-দুঃখ। ফলে এমন খবর মানুষের মনে আশার সঞ্চার করেছে। প্রকল্পটি যত দ্রুত বাস্তবায়ন হবে এ অঞ্চলের মানুষের দুঃখ-দুর্দশা ততো তাড়াতাড়ি লাঘব হবে বলে তিনি আশাবাদ ব্যক্ত করেন।
বিশ্লেষকরা বলছেন, প্রকল্পটি বাস্তবায়িত হলে পানি সংক্রান্ত বিষয়ে ভারতের দিকে আর তাকিয়ে থাকতে হবে না, তেমনি পুরো এলাকায় ব্যাপক পরিবর্তনের পাশাপাশি বদলে যাবে উত্তরের পাঁচ জেলার দুই কোটিরও বেশি মানুষের জীবনযাত্রা। তিস্তা নিয়ে সরকারের এ মহাপরিকল্পনা বাস্তবায়নের দাবিতে বিভিন্ন সংগঠনের ব্যানারে পাঁচ জেলার বাসিন্দারা দীর্ঘকাল ধরে আন্দোলন করে আসছিল।
ভারতের একতরফা পানি প্রত্যাহারে উত্তরাঞ্চলের বিশাল জনপদে মরুকরণ ঠেকাতে এবং সম্ভাব্য বিকল্প হিসেবে বাংলাদেশের এমন একটি প্রকল্প খোদ আত্মরক্ষামূলক হলেও প্রকল্পটি ভূ-রাজনীতির জন্য গুরুত্বপূর্ণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। ফলে তিস্তা নদীর এ প্রকল্প নিয়ে এতদিন ভারত এবং চীন পরস্পরবিরোধী অবস্থানে ছিল। এ নিয়ে চীন ব্যাপক আগ্রহী হলেও ভারত বরাবরই বিরোধিতা করে আসছিল। সেইসঙ্গে সীমান্তে চীনের উপস্থিতিতে অনেক বেশি আতঙ্কে রয়েছে ভারত।
শুরু থেকেই এ প্রকল্পে সহায়তায় আগ্রহী চীন, বিগত ফ্যাসিস্ট হাসিনা সরকার একসময় চীনকে গ্রিন সিগন্যালও দিয়েছিল, কিন্তু আপত্তি জানায় ভারত। পরে ভারতকেই এ প্রকল্পের কাজ দিতে উদ্যোগ নেয় আওয়ামী লীগ সরকার। এতে বিস্মিত হয় চীন, তখন ঢাকা বেইজিং সম্পর্কে কিছুটা টানাপড়েনও তৈরি হয়। ২০২৪ সালের ৮ জুলাই শেখ হাসিনা বেইজিং সফরে গেলেও একদিন আগেই তাকে সফর শেষ করে ফিরে আসতে হয়। তখন ভারত ছিল বেশ খোশমেজাজে। কিন্তু কয়েকদিনের ব্যবধানে জুলাই বিপ্লবে হাসিনা পালিয়ে আশ্রয় নেন ভারতে। এরপর ঝুলে যায় তিস্তা সিদ্ধান্ত। অবশেষে হাসিনা সরকারের পতনের আট মাসের মাথায় তিস্তা প্রকল্প বাস্তবায়নের চীনের অংশ গ্রহণ নিশ্চিত হলো। পর্যবেক্ষকদের ধারণা, এতদিন ভারতের আপত্তির কারণেই চীনের সঙ্গে এ প্রকল্প নিয়ে এগোতে পারেনি বাংলাদেশ। হাসিনা সরকারও ভারতকে চটাতে চায়নি।
সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, চীন এরই মধ্যে একটি প্রাথমিক প্রস্তাবনা দিয়েছে বাংলাদেশকে। চীনের প্রস্তাবিত তিস্তা প্রকল্প’ বাস্তবায়ন হলে বদলে যাবে উত্তরাঞ্চলের পাঁচ জেলার মানুষের ভাগ্য। প্রকল্পটি বাস্তবায়ন হলে শুষ্ক মৌসুমে পানির জন্য ভারতের দিকে তাকিয়ে থাকতে হবে না। নদীর গভীরতা প্রায় ১০ মিটার বাড়বে, বর্ষা মৌসুমে বন্যার পানি প্লাবিত হবে না কোনো জনপদ। সারা বছর নৌ চলাচলের মতো পানি সংরক্ষণের ব্যবস্থা থাকবে। এতে ১০৮ কিলোমিটার নদী খনন, নদীর দুপাড়ে ১৭৩ কিলোমিটার তীর রক্ষা, চর খনন, নদীর দুই ধারে স্যাটেলাইট শহর নির্মাণ, বালু সরিয়ে কৃষিজমি উদ্ধার ও ১ লাখ ১৩ হাজার কোটি টাকার সম্পদ রক্ষা এবং প্রতি বছরে ২০ হাজার কোটি টাকার ফসল উৎপাদন। নৌ-বন্দর এবং আইনশৃঙ্খলা রক্ষায় দুই পাড়ে থানা, কোস্টগার্ড ও সেনাবাহিনীর জন্য ক্যাম্পের ব্যবস্থার প্রস্তাবও রাখা হয়েছে প্রকল্পটিতে।
ফলে এ প্রকল্প নিয়ে উত্তরাঞ্চলের পাঁচ জেলার মানুষেরও রয়েছে ব্যাপক আগ্রহ। তিস্তা মহাপরিকল্পনা বাস্তবায়নে স্থানীয়ভাবে বিভিন্ন সংগঠনের ব্যানারে নানা কর্মসূচি পালন করে আসছে। চলতি মাসের মাঝামাঝি সময়েও লালমনিরহাটে মেগা প্রকল্প বাস্তবায়নের দাবিতে লাখো মানুষ জড়ো হন তিস্তার তীরে। সদর উপজেলার তিস্তা রেল ও সড়ক সেতুর মধ্যবর্তী স্থানে তিস্তা নদীরক্ষা আন্দোলনের ব্যানারে আয়োজিত জনতার সমাবেশে দুদিনের কর্মসূচি উদ্বোধন করেছিলেন বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর। এর আগে গত ২৫ জানুয়ারিও জাগো বাহে তিস্তা বাঁচাই’ স্লোগানে কুড়িগ্রামে রাজারহাটে তিস্তা নদী রক্ষা আন্দোলনের সমাবেশ হয়।
এদিকে পর্যবেক্ষকদের ধারণা, এতদিন ভারতের আপত্তির কারণেই চীনের সঙ্গে এ প্রকল্প নিয়ে এগোতে পারেনি বাংলাদেশ। জুলাই বিপ্লবের পর সেই পরিস্থিতি পাল্টে গিয়ে এখন চীনের সঙ্গে বহুমুখি উষ্ম সম্পর্ক বিরাজ করছে।
তবে পর্যবেক্ষকদের অনেকের মতে, তিস্তা নিয়ে চীনের আগ্রহ মূলত কৌশলগত। এ প্রকল্পকে চীন ভূ-রাজনৈতিকভাবে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বিবেচনা করে। এ প্রকল্পে চীনের আগ্রহী হয়ে ওঠার সবচেয়ে বড় কারণ তাদের-বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভ- বিআরআই প্রজেক্ট। এ প্রকল্পের মাধ্যমে চীন এশিয়া, ইউরোপ এবং আফ্রিকা মহাদেশকে একই সুতায় গাঁথতে চাইছে। চীনের বিআরআই প্রকল্পের আওতাধীন বাংলাদেশ-চীন-ভারত-মিয়ানমার অর্থনৈতিক করিডোর।
ভারতের গবেষণা সংস্থা অবজারভার রিসার্চ ফাউন্ডেশনের গবেষক অনুসুয়া বসু রায় চৌধুরীর মতে, চীন প্রথম যেভাবে বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভ করতে চেয়েছিল সেই পরিস্থিতি বদলে গেছে। অন্য কোনোভাবে এই করিডোরগুলো বা এই ধরনের কানেক্টিভিটি প্ল্যানগুলো চরিতার্থ করা যায় কি না সেটা চীনের উদ্দেশ্য তো থাকবেই।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্কের অধ্যাপক ড. ইমতিয়াজ আহমেদ বলেন, তিস্তা নদীর পানি বণ্টন নিয়ে ভারত যেহেতু বাংলাদেশের সঙ্গে চুক্তি করেনি, সেজন্য এর বিকল্প একটি সমাধান খুঁজছিল বাংলাদেশ। এজন্য তিস্তা প্রকল্প সামনে এনেছিল বাংলাদেশ, এ প্রকল্প চীনের ভাবনা থেকে আসেনি। তিনি বলেন, তিস্তা প্রকল্পের সঙ্গে চীনের বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভের সম্পর্কের বিষয়টি পরিষ্কার নয়।
তবে তিস্তা প্রকল্প নিয়ে চীনের আগ্রহকে ভারত বরাবরই সন্দেহের চোখে দেখে এসেছে। ভারত মনে করে, চীন তাদের বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভের মাধ্যমে ভারতকে চারপাশ থেকে ঘিরে ফেলতে চায়।
এ প্রসঙ্গে অনুসুয়া বসু রায় চৌধুরী বলেন, তিস্তা প্রকল্পের যে ভূ-রাজনৈতিক গুরুত্ব রয়েছে সেটি অস্বীকার করা যাবে না। ভূ-কৌশলগতভাবে গুরুত্ব বহন করে এমন সব প্রকল্প নিয়ে দক্ষিণ এশিয়ার বিভিন্ন দেশে চীন অতিরিক্ত আগ্রহ প্রকাশ করে। চীন চায় তাদের উপস্থিতি জোরালো করতে। তা ছাড়া ভারতের পশ্চিমবঙ্গের জন্য তিস্তা নদীর পানি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তজর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের অধ্যাপক ইমতিয়াজ আহমেদ এ প্রকল্প নিয়ে ভারতের আপত্তির বেশ কিছু কারণের কথা উল্লেখ করেন। তার মতে, তিস্তা ইস্যু সমাধান হয়ে গেলে বাংলাদেশের ওপর ভারতের যে প্রভাব, সেটা আর থাকবে না। অন্যান্য অভিন্ন নদীর পানির ক্ষেত্রে বাংলাদেশ তখন আর ভারতের দিকে তাকিয়ে থাকবে না। ফলে সেখানে চীনের প্রতি ইতিবাচক মনোভাব তৈরির পাশাপাশি ভারতবিরোধী মনোভাব আরো প্রবল হবে।
গবেষক অনুসুয়া বসু রায় চৌধুরী বলেন, যে জায়গাটিতে চীন তিস্তা প্রকল্প বাস্তবায়ন করতে চাইছে, সেটি শুধু সীমান্তের কাছাকাছি নয়, ভারতের স্পর্শকাতর এলাকার খুবই কাছাকাছি। তাই বাংলাদেশের এ প্রকল্পটি নিয়ে ভারত খুবই উদ্বিগ্ন।