
২০১৬ সালের ৯ আগস্টের সেই রাত। ঢাকা ক্যান্টনমেন্ট এলাকার মিরপুর ডিওএইচএসের ১১ নম্বর সেকশনের ৭ নম্বর রোডের ৫৩৪ নম্বর বাড়ির দোতলা। ঘড়ির কাঁটা তখন রাতের দিকে এগোচ্ছে। দুই শিশু সন্তান, স্ত্রী ও বোনের সঙ্গে ছিলেন ব্যারিস্টার আহমাদ বিন কাশেম আরমান। হঠাৎ সাদা পোশাকে ভারী অস্ত্রধারী কিছু মানুষ বাড়িতে ঢুকে পড়ে। মুহূর্তের মধ্যেই ভেঙে যায় ঘরের স্বাভাবিক ছন্দ।
সবাই যেন বোবা হয়ে যায়, আতঙ্ক চেপে ধরে পরিবারকে। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা কাউকে কিছু বলার সুযোগ না দিয়েই আহমাদ বিন কাশেমকে নিয়ে বেরিয়ে যায়। বাবা যখন দরজার দিকে এগিয়ে যাচ্ছিলেন, তখন ছোট্ট নুজাইরার মনে পড়ল—বাবার জুতা! সে দৌড়ে গেল, ছোট্ট হাতে জুতা এনে বাবার সামনে ধরল, বলল, ‘বাবা, জুতাটা পরে যাও!’
কিন্তু সেই ভয়ানক লোকগুলো এতটুকু সময়ও দিল না। তারা টেনেহিঁচড়ে নিয়ে যেতে লাগল তাকে। বাবা একবার পেছন ফিরে মেয়ের দিকে তাকালেন, কিছু বলতে চাইলেন, কিন্তু মুখে কোনো কথা এলো না।
স্ত্রীর চিৎকার, বোন কিছু বলার চেষ্টা করছিলেন, কিন্তু কেউ কারও কথা শুনতে পাচ্ছিল না। চারপাশের শূন্যতা গিলে নিচ্ছিল সব শব্দ। টেনে হিঁচড়ে বাবাকে নিয়ে গেল দরজার বাইরে, নুজাইরার হাতে রয়ে গেল বাবার জুতা। ছোট্ট নুজাইরা তখন বাবাকে ছাড়া একটা রাত কাটানোর অভিজ্ঞতাও ছিল না। অথচ সেই রাতটাই হয়ে গেল এক দীর্ঘ অপেক্ষার শুরু।
অপেক্ষার আট বছর
বাবার জন্য নুজাইরার অপেক্ষার বয়স এখন আট বছর। সময়ের হিসাবে দীর্ঘ, অনুভূতির হিসাবে আরও দীর্ঘতর। বাবা গেলেন, কিন্তু ফিরলেন না। আনুষ্ঠানিকভাবে কেউ বলল না তিনি কোথায়, কেন তাকে ধরে নিয়ে যাওয়া হলো। বাইরে কানাঘুষা চলতে লাগল—তাকে ‘আয়নাঘরে’ রাখা হয়েছে। কিন্তু নুজাইরার জন্য এসব ছিল অর্থহীন। তার ছিল একটাই প্রশ্ন—বাবা কবে আসবেন?
প্রতি ঈদে নতুন জামা পরে আয়নার সামনে দাঁড়ালে মনে হতো, বাবাকে দেখানোর মতো কেউ নেই। খুশির দিনে বারবার মনে হতো, বাবা থাকলে কেমন হতো! বাবাকে ছাড়া আটটি ঈদ কেটেছে নুজাইরার। অথচ প্রতিবার সে দরজার দিকে তাকিয়ে থেকেছে—বাবা হয়তো এসে বলবেন, ‘আমার রাজকন্যা, ঈদ মোবারক!’
ফিরে আসার গল্প
২০২৫-এর এই ঈদটা আলাদা। এবার নুজাইরার জন্য নতুন সূর্য উঠেছে। দীর্ঘ আট বছর পর সে আবার বাবাকে পেয়েছে! আট বছরের জমে থাকা অপেক্ষা, হাজারো না বলা কথা, অগণিত না বলা অনুভূতি এবার সে বাবার কাছে প্রকাশ করতে পারবে।
এই ঈদটা শুধু নুজাইরার জন্য নয়, পুরো পরিবারের জন্য অন্যরকম। হয়তো পুরনো ক্ষতগুলো এক মুহূর্তে মুছে যাবে না, কিন্তু বাবাকে ফিরে পাওয়ার আনন্দ সেই ক্ষতের ওপর শান্তির প্রলেপ বুলিয়ে দেবে।
একটি পরিবারের নতুন শুরু
বাবাকে হারানোর যন্ত্রণা নুজাইরাকে শক্ত করে গড়ে তুলেছে। আট বছরের অপেক্ষার পর এবার তার বাবা তার পাশে। হয়তো স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আসতে সময় লাগবে, কিন্তু এই ঈদটা তাদের জন্য নতুন শুরুর প্রতীক।
নুজাইরা হয়তো এবারও আয়নার সামনে দাঁড়াবে, কিন্তু এই প্রথমবার বাবাকে দেখানোর জন্য নতুন জামাটা গায়ে দেবে। আট বছরের খুশি এবার একসঙ্গে ফিরে আসবে, যেন ঈদের আনন্দ পূর্ণতা পায়।