
সংসারের উপার্জনক্ষম একমাত্র ছেলেকে হারানোর পর থেকেই অভাব-অনটন পিছু ছাড়ছে না শহীদ শিহাব হাসান হৃদয়ের পরিবারের। সংসারের হাল ধরতে হৃদয় রাজধানীতে ফার্নিচারের শোরুমে কাজ করত। ২০২৪ সালের বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনে যোগ দিয়ে পুলিশের গুলিতে শহীদ হয় ১৭ বছর বয়সি এই তরুণ।
১৯ জুলাই রাজধানীর বাড্ডায় পুলিশের ছোড়া বুলেট হৃদয়ের বুকের এক পাশ দিয়ে ঢুকে অন্য পাশ দিয়ে বের হয়। অভিভাবকরা তাকে নিয়ে বিভিন্ন হাসপাতালে ঘুরলেও ভর্তি করানো যায়নি। একপর্যায়ে হাসপাতালে ঘুরতে ঘুরতেই হৃদয় শহীদ হয়। সবাইকে কাঁদিয়ে চলে যায় রক্তিম জুলাইয়ের এই সাহসী তরুণ।
মাদারীপুরের শিবচর উপজেলার সন্যাসীরচর এলাকার আজগর হাওলাদারকান্দি গ্রামের বাসিন্দা ছিল হৃদয়। শাহ আলম হাওলাদার ও নাছিমা বেগম দম্পতির ছেলে হৃদয়। পরিবারে তার এক ছোট বোন রয়েছে। তবে বাবা শাহ আলম বর্তমানে অসুস্থ।
পরিবার সূত্রে জানা গেছে, প্রায় আট বছর আগে মোটরসাইকেল দুর্ঘটনায় কাঁধে আঘাত পান তিনি। এরপর থেকে ভারী কোনো কাজ করতে পারতেন না। এর মধ্যেই আবার হার্টে সমস্যা দেখা দেয়। দুই ছেলেমেয়েকে নিয়ে নাছিমা বেগমের সংসারে তৈরি হয় আর্থিক সংকট। সংসারের হাল ধরতে সেলাইয়ের কাজ শুরু করেন নাছিমা। পরে কোনোমতে চলতে থাকে সংসার। তখন একমাত্র ছেলে হৃদয় অষ্টম শ্রেণিতে পড়ত। সংসারের হাল ধরতে তাকে ঢাকায় একটি ফার্নিচারের দোকানে কাজে পাঠিয়ে দেন দরিদ্র বাবা-মা। সেই ফার্নিচারের দোকানে কাজ করে যা উপার্জন করত, নিজের খরচ চালিয়ে বাবা-মার জন্য পাঠাত হৃদয়। তা দিয়েই গ্রামে সংসার চলত তাদের। তবে উপার্জনক্ষম সন্তানকে হারিয়ে অসহায় হয়ে পড়েছেন বাবা-মা।
জুলাই শহীদ স্মৃতি ফাউন্ডেশন থেকে পাওয়া পাঁচ লাখ টাকাই এখন সন্তানের স্মৃতি বহন করছে। সেগুলো ব্যাংকে রেখে তা দিয়েই চলছে সংসার। তবে সংসার খরচ ও অসুস্থ বাবার চিকিৎসা ব্যয় সামলাতে গিয়ে হিমশিম খেতে হয় পরিবারটিকে।
সরেজমিনে জানা গেছে, ছোট্ট একটি টিনের ঘরে থাকেন হৃদয়ের পরিবার। ঘরের ভেতরের অবস্থাও খুবই খারাপ। নিজেদের নিজস্ব কোনো জমি নেই বলেও দাবি পরিবারটির। স্থানীয় বাসিন্দারা জানান, ‘ছেলেটি মারা যাওয়ার পর পরিবারটি বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছে। এখন তারা খুবই অসহায় জীবনযাপন করছে।’
বাবা শাহ আলম হাওলাদার বলেন, ‘আমার ছেলেটা দুপুরে ভাত খেয়ে ফার্নিচার কারখানায় যাচ্ছিল। এ সময় একটি গুলি এসে ওর বুকের এক পাশ দিয়ে ঢুকে অন্য পাশ দিয়ে বের হয়ে যায়। হাসপাতালে গুলিবিদ্ধ আহতদের ভর্তি করেনি তখন। এক হাসপাতাল থেকে অন্য হাসপাতালে যেতে যেতেই ছেলেটা মরে গেল। আমার ছেলেকে নির্মমভাবে গুলি করে মেরেছে পুলিশ। আমার আর কেউ থাকল না।’
নিহত হৃদয়ের মা নাছিমা বেগম বলেন, ‘আমি সন্তান হারিয়েছি। এই যন্ত্রণা আমি বুঝি। শেখ হাসিনা আমার সন্তানকে হত্যা করেছে। আমি এর বিচার চাই।’
বোন সাথী আক্তার বলেন, ‘আমার ভাই মরল। স্বৈরাচার সরকারের পতনের পর আমার ভাই হত্যার মামলা করলেন শিবচরের এক নেতা। অথচ আমাদের কাউকেই জানানো হয়নি। আমাদের কারো কোনো খোঁজ পর্যন্ত নেয়নি।’
জানতে চাইলে শিবচর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) পারভীন খানম বলেন, ‘আমরা হৃদয়ের পরিবারের সঙ্গে যোগাযোগ রাখছি। তাদের আর্থিক সমস্যার কথা আমরা জেনেছি। জুলাই বিপ্লবে নিহত হৃদয়ের কবর সংরক্ষণের ব্যবস্থার কথা পরিবার থেকে বলা হয়েছে। আমরা আলোচনা করে এ ব্যাপারে সিদ্ধান্ত জানাতে পারব। সরকারের পক্ষ থেকে যখন যে সহযোগিতা এসেছে, তা আমরা হৃদয়ের পরিবারকে দিয়েছি। আর কোনো সহায়তা করা যায় কি না সে ব্যাপারেও আলোচনা চলছে।’