
আসন্ন পুলিশ সপ্তাহ ঘিরে বাহিনীটির মধ্যে বিভিন্ন ধরনের তৎপরতা ও মেরূকরণ লক্ষ্য করা যাচ্ছে। পুলিশের বিভিন্ন বিষয়ে সংস্কার, পুলিশ সংস্কার কমিশনের নানা অসংগতি, স্বাধীন ও প্রভাবমুক্তভাবে কাজ করার সুযোগ, স্বাধীন পুলিশ কমিশন, শীর্ষ পদে চুক্তিভিত্তিক নিয়োগের বিরোধিতাসহ নানা ইস্যুতে সদস্যদের মধ্যে ক্ষোভ তৈরি হয়েছে। অসন্তোষের বিষয়গুলো চলে এসেছে অনেকটাই প্রকাশ্যে। এই ক্ষোভ থেকে পুলিশ সপ্তাহের আগে আগে একজন ডিআইজির নেতৃত্বে রাজধানীতে বিশেষ সভা হয়েছে। সেখানে পুলিশের ঢাকায় ও ঢাকার বাইরে কর্মরত বেশ কিছু কর্মকর্তা অংশ নিয়েছেন। এমনকি ডিআইজি, কমিশনার ও এসপি পদমর্যাদার কর্মকর্তারা ঊর্ধ্বতন তদারক কর্মকর্তার অনুমতি ছাড়াই বৈঠকে অংশ নিয়েছেন।
এরই মধ্যে বিশেষ সভায় অংশ নেওয়ায় প্রায় একডজন কর্মকর্তার কাছে ব্যাখ্যা তলব করেছে পুলিশ সদর দপ্তর। জানা গেছে, ‘আগামী ২৯ এপ্রিল রাজারবাগ পুলিশ লাইন্সে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের ভাষণের মধ্য দিয়ে শুরু হবে পুলিশ সপ্তাহের কার্যক্রম। এ ছাড়া প্রধান উপদেষ্টা পুলিশের সব ইউনিটের সঙ্গে ভার্চুয়ালি শুভেচ্ছা বিনিময় করবেন। পুলিশ সপ্তাহের প্রথম দিন বিকেলে আইজিপির সঙ্গে ঊর্ধ্বতন পুলিশ কর্মকর্তারা মতবিনিময় করবেন। ৩০ এপ্রিল দুপুরে স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা ও স্বরাষ্ট্র সচিবের সঙ্গে সম্মেলন এবং সন্ধ্যায় বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বপ্রাপ্ত উপদেষ্টা ও সচিবদের সঙ্গে পুলিশ সদস্যরা মতবিনিময় করবেন। পুলিশ সপ্তাহের শেষ দিন ১ মে দুপুরে সর্বস্তরের নাগরিকদের সঙ্গে মতবিনিময় করবেন পুলিশ কর্মকর্তারা।’ এ ছাড়া রয়েছে এসবি, সিআইডি, র্যাব, ট্যুরিস্ট পুলিশ, পিবিআই, এন্টিটেররিজম ইউনিট, হাইওয়ে পুলিশ, এপিবিএন, রেলওয়ে পুলিশ, নৌপুলিশ ও শিল্পাঞ্চল পুলিশ বিষয়ক পৃথক প্রেজেন্টেশন। থাকছে পুলিশ নারী কল্যাণ সমিতির স্টল পরিদর্শক ও বার্ষিক পুনাক সমাবেশ, পুলিশ সার্ভিস অ্যাসোসিয়েশনের বার্ষিক সাধারণ সভা ও অবসরপ্রাপ্ত পুলিশ অফিসারদের সঙ্গে কর্মরত পুলিশ কর্মকর্তাদের পুনর্মিলনী সভা।
প্রতি বছর সাধারণত জানুয়ারি-ফেব্রুয়ারিতে পুলিশ সপ্তাহ অনুষ্ঠিত হয়। এবার পরিবর্তিত পরিস্থিতির কারণে এপ্রিলের শেষ সপ্তাহে পুলিশ সপ্তাহ অনুষ্ঠিত হচ্ছে। পুলিশের একাধিক কর্মকর্তা জানান, পুলিশ সপ্তাহের ইতিহাসে এবারই প্রথম কোনো ধরনের প্যারেড রাখা হয়নি। শিল্ডপ্যারেড প্রতিযোগিতাসহ অন্যান্য প্রতিযোগিতাও নেই পুলিশ সপ্তাহের আয়োজনে। বিষয়টি নিয়ে অনেক পুলিশ সদস্য ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন। তা ছাড়া ১ মে আন্তর্জাতিক শ্রমিক দিবস। ওই দিন সব সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকে। ওই দিন পুলিশ সপ্তাহের অনুষ্ঠান রাখাটাও যৌক্তিক হয়নি। মাঠ পর্যায়ের পুলিশ সদস্যদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, ‘এবারের পুলিশ সপ্তাহ অন্যান্য সময়ের চেয়ে বেশি গুরুত্ব দিয়ে দেখা হচ্ছে। এই পুলিশ সপ্তাহ থেকে ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে পুলিশের ভূমিকা ও কাজ কী হবে, তার নির্দেশনা পাওয়া যাবে। তা ছাড়া পুলিশের অভ্যন্তরীণ বিভিন্ন দাবিদাওয়া, মাঠ পর্যায়ের পুলিশের সমস্যাগুলোর বিশদভাবে আলোচনার সুযোগ তৈরি হবে।’ একটি জেলার পুলিশ সুপার কালবেলাকে বলেন, ‘আগে আমাদের রাজনৈতিক নেতাদের নানান তদবির ও অনুরোধ শুনতে হতো। কিন্তু এখন শুনতে হয় ‘সমন্বয়কদের’। কে ‘সমন্বয়ক’ আর কে ‘সমন্বয়ক’ নয়, সেটা জানা বোঝাও অনেক সময় দুরূহ হয়ে পড়ে। সমন্বয়ক পরিচয়ধারীদের কারণে সঠিক পুলিশিং করা কঠিন পড়েছে। তাই আমাদের প্রয়োজন স্বাধীনভাবে কাজ করার সুযোগ। পুলিশের অন্য এক এসপি কালবেলাকে বলেন, ‘পুলিশ সপ্তাহের দাবিদাওয়া প্রসঙ্গে নিজেদের মধ্যে সমন্বয় সভা হয়। এবার এখনো সভা হয়নি। সভায় প্রধান উপদেষ্টা ও স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টার কাছে পুলিশ কী দাবি জানাবে, কী কী বিষয়ে সহযোগিতা চাইবে, সেটা নিয়ে আলোচনা হবে। সাধারণত স্বাধীনভাবে কাজের সুযোগ, স্বাধীন পুলিশ কমিশন গঠন, পুলিশের যানবাহন ও আবাসন সংকট সমাধান, ডিউটির অতিরিক্ত কাজের জন্য ভাতা ইত্যাদি বিষয়ে এবার আলোচনায় আসতে পারে বলে জানান ওই পুলিশ সুপার।
পুলিশের বিভিন্ন কর্মকর্তার সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, পুলিশ সপ্তাহের আগে সম্প্রতি রাজধানীর পুলিশ অফিসার্স ম্যাচে ইফতার মাহফিল ও সভা হয়। সেখানে বিএনপিপন্থি হিসেবে পরিচিত একজন কমিশনার, কয়েকজন ডিআইজি ও পুলিশ সুপার উপস্থিত ছিলেন। পুলিশ সদর দপ্তরের ডিআইজি (প্রশাসন) কাজী ফজলুল করিম বৈঠকে প্রধান অতিথি হিসেবে বক্তব্য দেন। আরও অংশ নেন গাজীপুর মহানগরের পুলিশ কমিশনার নাজমুল করিম খান, ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের অতিরিক্ত কমিশনার ফারুক আহমেদ, এসবির ডিআইজি মীর আশরাফ, রংপুর রেঞ্জের ডিআইজি আমিনুল ইসলাম এবং কয়েকজন পুলিশ সুপার। সভায় পুলিশের ১৫ থেকে ৪০তম ব্যাচের দু-তিনজন করে প্রতিনিধি অংশ নেন। ওই সভায় পুলিশের অতিরিক্ত আইজি, ডিআইজি পদে পদোন্নতি না দেওয়ায় ক্ষোভ প্রকাশ করেন। বৈঠকের বিষয়ে ঢাকা মহানগর পুলিশের অতিরিক্ত কমিশনার ফারুক আহমেদ কালবেলাকে বলেন, এটা কোনো বিশেষ বৈঠক ছিল না। ছিল ইফতার মাহফিল। আমরা নিজেদের মধ্যে কিছু সমস্যার বিষয়ে আলোচনা করেছি। পুলিশ সদর দপ্তরের প্রশাসন ও পার্সোনাল ম্যানেজমেন্ট শাখা সভায় অংশগ্রহণকারীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার উদ্যোগ নেয়। সদর দপ্তরের অনুমতি ছাড়া কর্মস্থল ত্যাগ করায় জিএমপি কমিশনার নাজমুল করিম খান এবং নরসিংদী ও গাজীপুরের পুলিশ সুপারসহ কয়েকজনের কাছে ব্যাখ্যা তলব করা হয়। এ ছাড়া সভায় অংশ নেওয়া কর্মকর্তাদের নিজ কর্মস্থল থেকে বদলিরও সুপারিশ করা হয়েছে।
পুলিশ কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, ৫ আগস্ট-পরবর্তী সময়ে আইনশৃঙ্খলা রক্ষায় স্বাভাবিকভাবে কাজ করতে পারছে না পুলিশ। বাহিনীকে আরও শক্তিশালী করা, অভ্যুত্থান-পরবর্তী যোগ্য অভ্যুত্থান সমর্থিত ও বঞ্চিত কর্মকর্তাদের নেতৃত্বে পেশাদার বাহিনী হিসেবে গতিশীলতা ফেরাতে কার্যকর ভূমিকা রাখতে পারেনি। পুলিশের ওই সভার আলোচনায় বিগত ফ্যাসিস্ট সরকারের গুম-খুন রাজনৈতিকভাবে ব্যবহৃত নিপীড়নের অভিযোগে বিচারাধীন ও শাস্তিপ্রাপ্ত পুলিশ কর্মকর্তাদের শূন্য পদে যোগ্য লোকদের দ্রুত পদায়ন করে গতিশীল করার আলোচনা হয়। পুলিশের বর্তমানে ১৯টি অতিরিক্ত আইজিপির শূন্য পদ ও তার দ্বিগুণ ডিআইজি পদ এবং অন্যান্য পদেও শূন্য থাকলেও কোনো পদোন্নতি বা নিয়োগের উদ্যোগ না নেওয়ায় ক্ষোভ প্রকাশ করেন। পুলিশের প্রতিটি ইউনিটকে স্বৈরাচারের দোসরমুক্ত ও যোগ্য লোকদের পদায়ন নিয়ে ধীরগতি এবং সিদ্ধান্তহীনতার কারণে অসন্তোষ প্রকাশ করে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতির জন্য দায়ী করা হয়। সভায় অংশ নেওয়া এক কর্মকর্তা জানান, পুলিশ সদর দপ্তরের ডিআইজি প্রশাসন তার বক্তব্যে সবাইকে ঐক্যবদ্ধ থাকার আহ্বান জানিয়ে সরকারকে সর্বাত্মতা সহায়তা করতে পুলিশকে আরও শক্তিশালী করার কথা বলেন। অন্য কর্মকর্তারাও পুলিশকে আরও শক্তিশালী করার পক্ষে ঐক্যবদ্ধ হয়ে কাজ করার কথা বলেছেন। ওই সভায় যোগদানকারীদের বিষয়ে সুনির্দিষ্টভাবে কিছু না বলা হলেও ঢাকার বাইরে থেকে যারা যোগদান করেছেন, তাদের বিনা অনুমতিতে কর্মস্থল ত্যাগের অভিযোগ এনে শৃঙ্খলাপরিপন্থি হিসেবে কারণ দর্শানোর নোটিশ দেওয়া হয়েছে। খোদ আইজিপি বাহারুল আলম স্বাক্ষরিত নোটিশ দেওয়া হয়েছে গাজীপুর মেট্রোপলিটন পুলিশের কমিশনার ড. নাজমুল করিম খানকে।
গত ১৬ মার্চ ব্যাখ্যা তলব প্রসঙ্গে এক চিঠিতে বলা হয়, ‘আপনি ডক্টর নাজমুল করিম খান পুলিশ কমিশনার গাজীপুর মেট্রোপলিটন পুলিশ হিসেবে কর্মরত আছেন। আপনি গত ১৪-০৩-২৫ তারিখে পুলিশ অফিসার্স ম্যাচ ঢাকায় ইফতার অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন। গাজীপুর মেট্রোপলিটন পুলিশ গাজীপুর আপনার ডিউটি স্টেশন ছেড়ে ঢাকায় আসার জন্য আপনি পুলিশ হেডকোয়ার্টার্সের অনুমতি নিয়েছেন—এমন কোনো রেকর্ড নেই। আপনার এহেন আচরণ শৃঙ্খলাপরিপন্থি এবং অসাদাচরণের শামিল। এজন্য কেন আপনার বিরুদ্ধে বিভাগীয় শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণের প্রস্তাব যথাযথ কর্তৃপক্ষ বরাবর প্রেরণ করা হবে না; তার লিখিত জবাব অত্র পত্র প্রাপ্তির তিন কার্যদিবসের মধ্যে দাখিল করতে আপনাকে নির্দেশ প্রদান করা হলো।’ একই ধরনের ব্যাখ্যা তলব করা হয়েছে পুলিশ হেডকোয়ার্টার্সের পার্সোনাল ম্যানেজমেন্ট-১ শাখার অতিরিক্ত ডিআইজি শামীম আসমিন স্বাক্ষরিত চিঠিতে। গাজীপুর, নরসিংদী জেলার পুলিশ সুপারসহ বৈঠকে যোগদানকারী ঢাকার বাইরের কর্মকর্তাদের কাছে ব্যাখ্যা চেয়ে চিঠি দেওয়া হয়েছে। জানতে চাইলে পুলিশ মহাপরিদর্শক (আইজিপি) বাহারুল আলম বলেন, ‘পুলিশ একটি ডিসিপ্লিন ফোর্স। সদর দপ্তর ও ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে না জানিয়ে কর্মকর্তারা স্টেশন ত্যাগ করতে পারেন না। তাই পুলিশ সপ্তাহের আগে কর্মকর্তারা এ ধরনের সভায় অংশ নেওয়ায় তাদের কাছে ব্যাখ্যা চাওয়া হয়েছে।’ সভায় আলোচনার বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘অনেক কিছু শুনলাম, কিন্তু আমি আসলে এতটা নিচে নেমে কথা বলতে চাই না। অফিসিয়াল ব্যাখ্যাটা পেলেই হবে।’ তাদের এবার পুলিশ সপ্তাহে কোনো প্যারেড অনুষ্ঠানে রাখা হয়নি। এ বিষয়ে জানতে চাইলে পুলিশ সদপ্তরের এআইজি (মিডিয়া অ্যান্ড পাবলিক রিলেশন) ইনামুল হক সাগর কালবেলাকে বলেন, ‘দেশের বর্তমান পরিস্থিতির কারণে পুলিশ সপ্তাহের অনুষ্ঠান কিছুটা সংক্ষিপ্ত করা হয়েছে। তাই প্যারেড অনুষ্ঠান রাখা হয়নি।’ পুলিশ সপ্তাহে নিরাপত্তার কোনো শঙ্কা নেই। পূর্বনির্ধারিত কর্মসূচি অনুযায়ী পুলিশ সপ্তাহ অনুষ্ঠিত হবে।