
চলতি অর্থবছরের বাকি আছে আর ৪ মাস। কিন্তু বিশাল অঙ্কের টাকা ব্যয়ের চাপে রয়েছে মন্ত্রণালয় ও বিভাগগুলো। কেননা গত ৮ মাসে খরচ হয়েছে মাত্র ৬২ হাজার ৩২৯ কোটি টাকা। তবে কাটছাঁট করেও সংশোধিত বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচি (আরএডিপি) শতভাগ বাস্তবায়ন রয়েছে শঙ্কার মধ্যে। কেননা এখনো বরাদ্দের ১ লাখ ৫৩ হাজার ৬৭১ কোটি টাকা ব্যয়ের চ্যালেঞ্জে আছে সরকার। উন্নয়ন প্রকল্প বাস্তবায়নে ধীরগতি বিরাজ করায় এমন পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে। সেই সঙ্গে চলমান সংকটে অর্থ বরাদ্দ ঠিকমতো পাওয়া যাচ্ছে না। পাশাপাশি আছে নানা নতুন পুরোনো বাধাও। বাস্তবায়ন, পরিবীক্ষণ ও মূল্যায়ন বিভাগের (আইএমইডি) সাম্প্রতিক প্রতিবেদন পর্যালোচনা করে এসব তথ্য পাওয়া গেছে।
এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে সাবেক পরিকল্পনা সচিব মামুন-আল-রশীদ মঙ্গলবার যুগান্তরকে বলেন, কোথাও কার্যকর কোনো জবাবদিহিতা নেই বলেই এমন ঘটনা ঘটছে। মন্ত্রণালয়গুলো যদি তাদের দায়িত্ব সঠিকভাবে পালন করত তাহলে এডিপি বাস্তবায়ন এত খারাপ হতো না। অর্থবছরের শুরুতেই কঠোর অবস্থান নিলে বাস্তবায়ন হার বেড়ে যেত। বরাদ্দ দেওয়া অর্থ খরচ করতে না পারার ব্যর্থতায় প্রকল্পের মেয়াদ ও ব্যয় বাড়ার ঝুঁকি তৈরি করে। পাশাপাশি অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে নেতিবাচক প্রভাব তৈরি করে। কর্মসংস্থান বৃদ্ধিতে বাধার সৃষ্টি হয়। একটি প্রকল্পের সঙ্গে অনেক বিষয় জড়িত থাকে। সেই প্রকল্পই যদি সঠিক সময়ে বাস্তবায়িত না হয় তাহলে বাকি সব ক্ষেত্রে নেতিবাচক প্রভাব পড়বে।
আইএমইডি জানায়, চলতি অর্থবছরের বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচিতে (এডিপি) বরাদ্দ দেওয়া হয় ২ লাখ ৬৫ হাজার কোটি টাকা। এর মধ্যে সরকারি তহবিলের ১ লাখ ৬৫ হাজার এবং বৈদেশিক সহায়তার ১ লাখ কোটি টাকা। কিন্তু সম্প্রতি এডিপি সংশোধন করে ৪৯ হাজার কোটি টাকা কাটছাঁট করা হয়। ফলে সংশোধিত এডিপির (আরএডিপি) আকার দাঁড়ায় ২ লাখ ১৬ হাজার কোটি টাকা। এর মধ্যে সরকারি তহবিলের এক লাখ ৩৫ হাজার কোটি এবং বৈদেশিক ঋণ থেকে ৮১ হাজার কোটি টাকা। ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত মন্ত্রণালয় ও বিভাগগুলো খরচ করতে পেরেছে ৬২ হাজার ৩২৯ কোটি টাকা। ফলে বাকি চার মাসে (মার্চ থেকে জুন) মন্ত্রণালয় ও বিভাগগুলোকে খরচ করতে হবে ১ লাখ ৫৩ হাজার ৬৭১ কোটি টাকা।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, ফেব্রুয়ারিতে এডিপি বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে প্রায় ২৮টি প্রতিবন্ধকতা চিহ্নিত করেছে আইএমইডি। এগুলোর মধ্যে প্রকল্প তৈরির সময় ১১টি, প্রকল্প বাস্তবায়ন পর্যায়ে ১২টি এবং প্রকল্প শেষ হওয়ার পর ৬টি প্রতিবন্ধকতা রয়েছে। এ সংক্রান্ত একটি প্রতিবেদন উপস্থাপন করা হয় জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের (এনইসি) বৈঠকে। সেখানে উল্লিখিত কারণগুলো হচ্ছে-প্রকল্প তৈরিতে দুর্বলতা এবং সম্ভাব্যতা সমীক্ষা ছাড়াই প্রকল্প তৈরি, দায়সারাভাবে অন্য প্রকল্পের ছকে প্রকল্প তৈরি এবং প্রকল্প হাতে নেওয়ার ক্ষেত্রে সুবিধাভোগীদের মতামত না নেওয়া বা চাহিদা যাচাই না করা। এছাড়া ডিপিপিতে (উন্নয়ন প্রকল্প প্রস্তাব) প্রকল্পের ফলাফল কাঠামো এবং লগ ফ্রেম ঠিকমতো তৈরি না করা। প্রকল্প নেওয়ার আগে অধিগ্রহণের ক্ষেত্রে সম্ভাব্য ভূমি চিহ্নিত করে জেলা প্রশাসকদের প্রাথমিক সম্মতি না নেওয়া। এমটিবিএফের (মধ্যমেয়াদি বাজেট কাঠামো) আর্থিক সিলিং অনুসরণ না করা। প্রকল্পের এক্সিট প্ল্যান বা সাসটেইনেবিলিটি প্ল্যান সঠিকভাবে না করা। আরও আছে, প্রকল্পের মাঝপথে ভৌত কাজের ডিজাইন পরিবর্তন করা। অর্থায়ন নিশ্চিত না করে বৈদেশিক সাহায্যপুষ্ট প্রকল্পের অনুমোদন।
এদিকে প্রকল্প বাস্তবায়নের সময়কার প্রতিবন্ধকতাগুলোর অন্যতম কয়েকটি হলো-ডিপিপিতে উল্লিখিত কর্মপরিকল্পনা বা ক্রয় পরিকল্পনা অনুযায়ী প্রকল্প বাস্তবায়ন না করা, প্রকল্পের ঝুঁকি ব্যবস্থাপনার সঠিক ও কার্যকর পরিকল্পনা বা পরিবীক্ষণের ব্যবস্থা না থাকা এবং মাঠপর্যায়ে প্রকল্প বাস্তবায়নকারী সংস্থাগুলোর সমন্বয়হীনতা। এছাড়া প্রকল্পের কার্যক্রমে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতার অভাব, নিয়মিত পিআইসি (প্রজেক্ট ইমপ্লিমেন্টেশন কমিটি) ও স্টিয়ারিং কমিটির সভা না করা। ঠিকাদারের দায়িত্ব অবহেলা। ইউটিলিটি স্থানান্তরে দীর্ঘসূত্রতা। প্রকল্প অনুমোদনের পর প্রকল্প পরিচালক নিয়োগ ও ঘন ঘন প্রকল্প পরিচালক পরিবর্তন এবং প্রকল্পের কাজে যুক্তদের জন্য পুরস্কার বা শাস্তির ব্যবস্থা না থাকা।
প্রকল্প বাস্তবায়নের পরবর্তী বাধাগুলো হলো-প্রকল্প শেষ হওয়ার ৩ মাসের মধ্যে সমাপ্ত প্রতিবেদন (পিসিআর) আইএমইডিতে জমা না দেওয়া, প্রকল্প মূল্যায়ন করে আইএমইডির দেওয়ার সুপারিশের ফিডব্যাক যথাসময়ে আইএমইডিকে না দেওয়া। আরও আছে, প্রকল্প শেষে কার্যক্রম পরিচালনার জন্য রাজস্ব বাজেটের অপ্রতুলতা এবং প্রকল্প শেষে প্রকল্পের যানবাহন পরিবহণ পুলে জমা না দেওয়া।
বাস্তবায়ন পরিবীক্ষণ ও মূল্যায়ন বিভাগ (আইএমইডি) জানায়, গত অর্থবছরের এডিপিতে মোট বরাদ্দ ছিল দুই লাখ ৭৪ হাজার ৬৭৪ কোটি টাকা। সংশোধিত এডিপিতে এসে ২০ হাজার ২৮২ কোটি টাকা কাটছাঁট করে মোট বরাদ্দ নির্ধারণ করা হয় দুই লাখ ৫৪ হাজার ৩৯২ কোটি টাকা। এ অর্থবছর শেষে মন্ত্রণালয় ও বিভাগগুলো খরচ করতে পেরেছিল দুই লাখ পাঁচ হাজার ৮৮৫ কোটি টাকা। অর্থাৎ বরাদ্দ কমিয়ে যা দেওয়া হয়েছিল তার ৮০ দশমিক ৯২ শতাংশ।
২০২২-২৩ অর্থবছরে মূল এডিপিতে বরাদ্দ ছিল দুই লাখ ৫৬ হাজার তিন কোটি টাকা। অর্থবছরের মাঝ পথে এসে ১৯ হাজার ৪৪২ কোটি টাকা বাদ দিয়ে বরাদ্দ নির্ধারণ করা হয় দুই লাখ ৩৬ হাজার ৫৬১ কোটি টাকা। শেষ পর্যন্ত খরচ হয়েছিল এরও কম দুই লাখ এক হাজার ৪৮৭ কোটি টাকা, অর্থাৎ বরাদ্দের ৮৫ শতাংশ। ২০২১-২২ অর্থবছরে মূল বরাদ্দ ছিল দুই লাখ ৩৬ হাজার ৭৯৩ কোটি টাকা। এরপর ১৭ হাজার ১৯০ কোটি টাকা বাদ দিয়ে সংশোধিত বরাদ্দ দেওয়া হয় দুই লাখ ১০ হাজার ৬০৩ কোটি টাকা। শেষ পর্যন্ত খরচ হয়েছিল দুই লাখ তিন হাজার ৬৪৮ কোটি টাকা, বা ৯২ দশমিক ৯৮ শতাংশ। এছাড়া ২০২০-২১ অর্থবছরে মূল এডিপি বরাদ্দ ছিল দুই লাখ ১৪ হাজার ৬১১ কোটি টাকা। এর মধ্যে পাঁচ হাজার ৩৩৯ কোটি টাকা কাটছাঁট সংশোধিত বরাদ্দ দেওয়া হয় দুই লাখ নয় হাজার ২৭২ কোটি টাকা। কিন্তু শেষ পর্যন্ত খরচ হয়েছিল এক লাখ ৭১ হাজার ৮৩৬ কোটি টাকা, যা বরাদ্দের ৮২ দশমিক ১১ শতাংশ।