
রাজধানীতে বেশ কিছুদিন ধরে মশার উপদ্রব বেশ বেড়েছে। দিন-রাত মশার কামড়ে মানুষ অতিষ্ঠ। ঢাকার দুই সিটি করপোরেশন মাঝে-মধ্যে মশা মারার নানা তোড়জোড় দেখালেও দিনশেষে সেগুলো কাজে আসছে না। এরই মধ্যে আগামী ‘মে’ মাস থেকে বৃষ্টির কারণে ডেঙ্গুর বাহক এডিস মশা বাড়ার আশঙ্কা রয়েছে। তবে সংক্রমণ কমাতে সরকারি তৎপরতা তেমন নেই। তাই এ বছর ডেঙ্গুর সংক্রমণও বাড়তে পারে বলে আশঙ্কা করছেন বিশেষজ্ঞরা।
কীটতত্ত্ববিদ ও জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এপ্রিল মাসের ঝড়বৃষ্টিতে কিউলেক্স মশা কমবে, তবে এডিস মশা ধীরে ধীরে বাড়তে থাকবে। মে মাসে বৃষ্টিপাতের কারণে জুনে ডেঙ্গু ব্যাপকভাবে ছড়াতে পারে।
তাঁরা বলছেন, গত দুই বছরের মতো ডেঙ্গু যেন এবারও না ছড়ায়, এ জন্য প্রস্তুতিমূলক কাজ এখনই শুরু করা দরকার। এ ক্ষেত্রে সিটি করপোরেশনের পাশাপাশি জনগণের সক্রিয় অংশগ্রহণ জরুরি।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তর বলছে, এ বছরের জানুয়ারি থেকে ২৭ মার্চ পর্যন্ত ডেঙ্গুতে আক্রান্ত মানুষের সংখ্যা এক হাজার ৮৬২। গত বছরের জানুয়ারি থেকে একই সময় রোগী ছিল এক হাজার ৬৫৯ জন। ২০২৩ সালের ১ জানুয়ারি থেকে ২৭ মার্চ পর্যন্ত ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয় ৮২৯ জন।
কীটতত্ত্ববিদ ও জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ড. কবিরুল বাশার কালের কণ্ঠকে বলেন, এ বছর এডিস মশা অন্যান্য বছরের তুলনায় বেশি হবে। কারণ গত বছরের মাঝামাঝি থেকে মশক নিধন কার্যক্রম ছিল সীমিত। এবারও স্থানীয় সরকার অগোছাল অবস্থায় রয়েছে। মশার বিস্তার রোধে যথাযথ উদ্যোগও দেখা যাচ্ছে না। এতে মশা বৃদ্ধির আশঙ্কা বেশি।
তিনি বলেন, এপ্রিল মাসে ঝড়বৃষ্টির সঙ্গে তাপমাত্রা চরম পর্যায়ে পৌঁছাবে। পরের মে মাসজুড়ে বৃষ্টিপাত থাকবে। এ সময় এডিস মশার প্রজনন বাড়বে। জুন থেকে ডেঙ্গু রোগী বাড়বে। এ পরিস্থিতি সামাল দিতে হলে প্রস্তুতিমূলক কাজ এখনই শুরু করা উচিত। বিশেষ করে ডেঙ্গু মশার প্রজনন তথ্য সংগ্রহ ও স্থানগুলো চিহ্নিত করে প্রজননস্থল ধ্বংস করা। একই সঙ্গে জনসচেতনতা তৈরিতে জোর দিতে হবে।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তর ও দুই সিটি করপোরেশনের প্রস্তুতি : ডেঙ্গুর পরিস্থিতি সম্পর্কে আগাম ধারণা নিতে এডিস মশার জরিপ হয় প্রতিবছর তিনবার—বর্ষার আগে, বর্ষার সময় ও বর্ষার পরে। এডিস মশার ঘনত্ব দেখে আগাম ধারণা পাওয়া যায় ডেঙ্গুর প্রকোপ কতটুকু হবে। এসব জরিপ হয় মূলত ঢাকার দুই সিটিসহ বিভিন্ন সিটি করপোরেশনে। তবে এবার স্বাস্থ্য খাতের উন্নয়ন কর্মসূচি পরিচালনায় অপারেশনাল প্ল্যান (ওপি) না থাকায় বর্ষার আগে কোনো জরিপ হয়নি।
এ বিষয়ে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের রোগ নিয়ন্ত্রণ শাখার পরিচালক মো. হালিমুর রশীদ বলেন, ‘রোগী বাড়ছে। এর অর্থ হলো মশা বাড়ছে। আমরা রোগীর চিকিৎসার বিষয় দেখি। মশা নিয়ন্ত্রণ স্থানীয় সরকারের দায়িত্ব। কিন্তু মশা তো নিয়ন্ত্রণ হচ্ছে না।’
ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের প্রধান স্বাস্থ্য কর্মকর্তা ডা. নিশাত পারভীন বলেন, ‘আমরা আমাদের নিয়মিত ডেঙ্গু কার্যক্রম পরিচালনা করছি। এপ্রিল না হলেও জুন-জুলাইয়ে বেশি বাড়ে সেটি মাথায় রেখে আমরা এগোচ্ছি। ঈদের পর থেকে সচেতনতা কার্যক্রম শুরু করব।’
নতুন মশার ওষুধ টেস্ট করা হবে কি না—এমন প্রশ্নে তিনি বলেন, ‘আপাতত আমরা আগের ওষুধ দিয়েই টেস্ট করব। সেটি কার্যকারিতা হারালে আমরা নতুন ওষুধের কথা চিন্তা করব।’
ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের প্রধান স্বাস্থ্য কর্মকর্তা ব্রিগেডিয়ার জেনারেল ইমরুল কায়েস চৌধুরী বলেন, ‘উত্তর সিটি করপোরেশন এলাকায় এডিস মশার জরিপ করেছি। এতে এডিস মশার লার্ভাও বেশি পেয়েছি। এ নিয়ে কাজ করে যাচ্ছি। আশা করি, এডিস মশা নিয়ন্ত্রণে থাকবে।’
আক্রান্তদের ৩১% ঢাকার দুই সিটির : এবার ঢাকার বাইরে ডেঙ্গু ছড়িয়ে পড়ার বিষয়টি বেশি আতঙ্কের। এ বছর এখন পর্যন্ত যত ব্যক্তি আক্রান্ত হয়েছেন, এর ৩১ শতাংশ ঢাকার দুই সিটি করপোরেশনের। অন্যরা ঢাকার বাইরের। এ পর্যন্ত সর্বোচ্চ সংক্রমণ হয়েছে বরিশালে। এরপর রয়েছে চট্টগ্রাম ও ঢাকা বিভাগ (সিটি করপোরেশন এলাকার বাইরে)।
জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ ডা. মুশতাক হোসেন কালের কণ্ঠকে বলেন, মশক নিয়ন্ত্রণ ও প্রাথমিক স্বাস্থ্য সেবায় নতুন কোনো দৃষ্টিভঙ্গির পরিচয় দেখছি না। স্থানীয় সরকার যখন সচল ছিল তখন তারা কাজ করেনি। এখন নতুন করে আরেকটা অজুহাত যুক্ত হলো—সিটি করপোরেশনগুলোতে জনপ্রতিনিধিরা নেই।
তিনি বলেন, প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবাকেন্দ্রিক রোগ শনাক্তকরণে কমিউনিটি ভিত্তিক যে প্রচেষ্টা, সে বিষয়েও এখনো কোনো সিদ্ধান্ত হয়নি। জনস্বার্থে স্বাস্থ্য সংস্কার কমিশন কাজ করেছে। সেখানেও এসব দৃষ্টিভঙ্গি প্রতিফলিত হয়নি। অথচ কমিউনিটি ভিত্তিক রোগ প্রতিরোধ, রোগ শনাক্তের ব্যবস্থা করা গেলে শনাক্ত বেশি হলেও মৃত্যুর সংখ্যা কমানো সম্ভব।
ডা. মুশতাক হোসেন বলেন, ডেঙ্গু ভাইরাসের চারটি ধরন বা সেরোটাইপ আছে। ২০২৩ সালে ডেন-২ ধরনটি বেশি ছড়ায়। গত বছরও ডেন-২ ধরনটিতে আক্রান্ত হওয়ার হার বেশি ছিল। কিন্তু শেষ দিকে ডেন-২-এর পাশাপাশি ডেন-৪-এর সংক্রমণও দেখা গেছে। এবার যদি ডেন-৩ বা ডেন-৪ দ্বারা আক্রান্ত শুরু হয়, তাহলে আক্রান্তের সঙ্গে মৃত্যুও বাড়বে।