
১৫ বছরের আওয়ামী দুঃশাসনের সময় বিএনপির প্রতি সাধারণ জনগণের অনেক আশা-আকাঙ্ক্ষা ছিল। সরকারের দমন-পীড়ন আর মারমুখী অবস্থানের সামনে তারা মাথা উঁচু করে দাঁড়াতে পারেনি। রাজনৈতিকভাবে তাদের অবস্থা একবারেই নাজেহাল ছিল। এমনকি কোনো আন্দোলনেই তারা সফলতার মুখ দেখেনি। তবে এ কথা ঠিক, ৫ আগস্ট শেখ হাসিনা পালানোর আগ পর্যন্ত বিগত ১৫ বছর বিএনপির নেতাকর্মীরা অবর্ণনীয় নির্যাতনের শিকার হয়েছেন।
ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে আওয়ামী লীগের রাজনৈতিক মৃত্যু ঘটার পর বিএনপিই দেশের সবচেয়ে বড় রাজনৈতিক দল। কিন্তু দল যতই শক্তিশালী হোক না কেন, জনগণ যেকোনো সময় সবকিছু ওলোটপালট করে দিতে পারে। কেউ না বুঝলেও বিদেশে অবস্থানরত বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান বিষয়টি বুঝতে পেরেছেন। এই ভাবনা থেকেই হয়তো কিছুদিন আগে তিনি বলেছেন, ‘আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচন বিএনপির জন্য সহজ নয়। জনগণ ম্যাটারস। জনগণ হচ্ছে আমাদের শক্তি, আমাদের সমর্থন। জনগণ সঙ্গে না থাকলে কী হয় ৫ আগস্ট বুঝিয়ে দিয়েছে।’
স্বৈরাচারী সরকারের পতনের পর মানুষ মনে করেছিল বিএনপি জাতিকে ভালো নেতৃত্ব দেবে এবং সুন্দর সমাজ গঠনে অগ্রণী ভূমিকা পালন করবে। সাংগঠনিকভাবে নিজেদের গুছিয়ে নেবে। দেশের এই ক্রান্তিকালে তারাই মানুষের আকাঙ্ক্ষার প্রতিফলন ঘটাবে। মানুষের আকাঙ্ক্ষা ছিল সমাজে ইনসাফ প্রতিষ্ঠিত হবে। দুর্নীতিমুক্ত হবে অফিস-আদালত। সব ক্ষেত্রে বৈষম্য দূর হবে। জীবনযাত্রার ব্যয় কমবে। বাজারে কোনো সিন্ডিকেট থাকবে না। সর্বত্রই আসবে নতুনত্ব। সংস্কার হবে। দখল, চাঁদাবাজ, ঘুষ ও সন্ত্রাসমুক্ত সোনালি সমাজ গড়ে উঠবে। রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে ঐক্য প্রতিষ্ঠিত হবে। হিংসা-বিদ্বেষের রাজনীতি থাকবে না। রাতের ভোট নয়, ভোটকে আমানত হিসেবেই প্রদান করা সম্ভব হবে। বিএনপির নেতা-কর্মীরা কি জনগণের এসব চাহিদার কথা বুঝতে পারছেন?
নির্বাচনের আগে প্রয়োজনীয় সংস্কারকে গুরুত্ব দিচ্ছে বেশিরভাগ রাজনৈতিক দল। সচেতন নাগরিকরা মনে করছেন, বিএনপির সাম্প্রতিক পারফরম্যান্সের কারণে তাদের জনপ্রিয়তার অবনতির ভয়ে তারা সরকারকে দ্রুত নির্বাচনের তাগিদ দিচ্ছে। দিন যতই এগুচ্ছে বিএনপি ততই চ্যালেঞ্জ আর চাপের সম্মুখীন হচ্ছে। আগস্টে আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর থেকে তারা যেসব পারফরম্যান্স দেখাচ্ছে তাতে তাদের জনপ্রিয়তা নিচের দিকেই ধাবিত হচ্ছে। চায়ের স্টলে বসলে কারো কারো মুখে শোনা যায়, ‘বিএনপি-আওয়ামী লীগ একই মুদ্রার এপিঠ-ওপিঠ।’ এসব কথা বিএনপির জন্য মোটেই ইতিবাচক নয়।
এ ছাড়া নির্বাচনসহ কয়েকটি ইস্যুকে কেন্দ্র করে বিএনপির সঙ্গে অন্তর্বর্তী সরকারের দূরত্ব সৃষ্টি হচ্ছে। শুধু নির্বাচন-বিষয়ক ইস্যুই নয়; বরং রাষ্ট্রপতিকে সরিয়ে দেওয়া ও ‘জুলাই বিপ্লবের ঘোষণাপত্র’ প্রকাশের উদ্যোগকে বিএনপি যেভাবে ঠেকিয়ে দিয়েছে, তাতে উভয় পক্ষের মধ্যে আস্থার সংকট ও দূরত্বের মাত্রা আরো বৃদ্ধি পাচ্ছে। বিষয়টি সচেতন নাগরিকরা ভালোভাবে দেখছে না।
নির্বাচনকে সামনে রেখে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের নেতারা নতুন দল গঠন করতে যাচ্ছে। তাদের মূল এজেন্ডা হলো, দেশপ্রেমে উদ্বুদ্ধ হয়ে ভারতবিরোধিতা, হাসিনার বিচার নিশ্চিত করা এবং ৯২ ভাগ মুসলমানের ধর্মীয় চেতনা ধারণ করে তৌহিদি জনতাকে সঙ্গে নিয়ে পথ চলা। এই লক্ষ্যে ছাত্রনেতারা শুধু সভা-সমাবেশ নয়, পাশাপাশি ইসলামি জলসা-মাহফিলেও যাচ্ছেন। এটিও বিএনপির জন্য আরেকটি নতুন চ্যালেঞ্জ। তা ছাড়া জামায়াত জোটবদ্ধ হয়ে নানা কৌশলে বিএনপিকে ঠেকিয়ে ক্ষমতায় যাওয়ার পরিকল্পনা করছে।
সাধারণ জনগণ এখন সবকিছু পর্যবেক্ষণ করছে। আগামী নির্বাচনে বিএনপি কি ধর্মনিরপেক্ষতার নামে সেক্যুলারদের পথ ধরবে, নাকি তৌহিদি জনতার পক্ষ নেবে—এমন সমীকরণ মাথায় রেখে যখন পথ চলার কথা, তখন তাদের কতিপয় নেতাকে নাস্তিকদের সঙ্গে তাল মিলিয়ে ইসলামবিদ্বেষী কথা বলতে শোনা যাচ্ছে। কেউ কেউ ওয়াজ মাহফিলের বক্তাদের নিয়ে কটাক্ষও করছেন বলে শোনা যায়, যা বিএনপির জন্য কখনোই শুভ ফল বয়ে আনবে না।
বিএনপির মনে রাখা উচিত, এ দেশের মানুষ কট্টর হিন্দুত্ববাদী রাষ্ট্র ভারতবিরোধী। ভারতের দাদাগিরি এদেশের মানুষ এখন সহ্য করতে পারে না। নতুন প্রজন্ম নতজানু মেজাজ লালন করে না। এই প্রজন্মের ছেলে-মেয়েরা প্রয়োজনে একবেলা খেয়ে হলেও মাথা উঁচু করে বাঁচতে চায়। এসব বিষয় ভেবেচিন্তে বিএনপিকে সামনের দিকে এগিয়ে যেতে হবে।