Image description

ঈদ উৎসব ঘিরে বাড়ছে কেনাকাটা। রোজার দ্বিতীয় সপ্তাহ থেকে রাজধানীর বিভিন্ন মার্কেটে ক্রেতা উপস্থিতি বেড়েছে। তবে গত বছরের তুলনায় বিক্রি বাড়ার আশা করছেন না ব্যবসায়ীরা। তাঁরা বলছেন, এবারের ঈদে ক্রেতা সমাগম বাড়লেও বিক্রি এখনো ৩০ শতাংশ কম।

ব্যবসায়ী ও অর্থনীতিবিদরা বলছেন, উচ্চ মূল্যস্ফীতির কারণে মানুষ খরচ কমাতে বাধ্য হচ্ছে। রাজনৈতিক অস্থিরতায় ব্যবসা-বাণিজ্যে স্থবিরতা চলছে। শ্রমিক অসন্তোষসহ নানা কারণে শতাধিক শিল্প-কারখানা বন্ধ হয়ে লাখো কর্মী কাজ হারিয়েছেন। এতে কমেছে তাঁদের ক্রয়ক্ষমতা। অনেক প্রতিষ্ঠান এখনো ঠিকমতো বেতন-বোনাস পরিশোধ করতে পারেনি। এর নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে ঈদের কেনাকাটায়। স্থবির অর্থনীতিতে ঈদ কেনাকাটা গতি এনে দেবে বলে মনে করছেন খাতসংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা।

গতকাল বুধবার রাজধানীর বিভিন্ন শপিং মল ঘুরে দেখা যায়, ঈদের ঠিক আগ মুহূর্তে এই ছুটির দিনটিকে বেশ ভালোভাবেই কাজে লাগাচ্ছে মানুষ।ব্যস্ততায় আগে যারা করতে পারেনি কেনাকাটা, শেষ সময়ে তারা সেরে নিচ্ছে সেটি। ফলে কাপড়, জুতা, কসমেটিকস কিংবা গয়নার দোকানসবখানেই দেখা গেছে ক্রেতার চাপ।

ব্যবসায়ীরা বলছেন, ঈদের বাজারে মূলত বিক্রি হয় নতুন পোশাক। পাশাপাশি জুতা, অর্নামেন্টস, প্রসাধনী, ঘর সাজানোর জিনিস এবং কিছু আসবাবও বিক্রি হয়। তবে ঈদকেন্দ্রিক ক্রেতারা যে অর্থ ব্যয় করেন, তার ৮০ শতাংশই যায় পোশাকের জন্য। বাকি ২০ শতাংশ অর্থ অন্য পণ্যে ব্যয় হয়।

খাতসংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, সাম্প্রতিক বছরগুলোতে ঈদুল ফিতরকে কেন্দ্র করে প্রায় দুই লাখ কোটি টাকার ব্যবসা হচ্ছে।

বাংলাদেশ দোকান মালিক সমিতির তথ্য অনুযায়ী, গত বছর অর্থাৎ ২০২৪ সালে এক লাখ ৯৬ হাজার কোটি টাকার মতো ব্যবসা হয়। তার আগের বছর ২০২৩ সালে ঈদকেন্দ্রিক ব্যবসা হয় এক লাখ ৮৭ হাজার কোটি টাকা। ১০ বছর আগে ২০১৫ সালে ঈদকেন্দ্রিক ব্যবসা ছিল এক লাখ ৫৫ হাজার কোটি টাকার মতো। এবার ঈদকেন্দ্রিক আড়াই লাখ কোটি টাকার কম হতে পারে মনে করছেন ব্যবসায়ীরা।

ব্যবসায়ীদের শীর্ষ সংগঠন বাংলাদেশ শিল্প ও বণিক সমিতি ফেডারেশনের (এফবিসিসিআই) প্রশাসক মো. হাফিজুর রহমান কালের কণ্ঠকে বলেন, ঈদের কেনাকাটায় গতি এসেছে। ব্যবসা কিছুটা কম হতে পারে। উচ্চ মূল্যস্ফীতির কারণে মানুষের প্রকৃত আয় কিছুটা কমেছে। এ কারণে খরচ কমানোর প্রবণতা আছে মানুষের মধ্যে। এ ছাড়া ব্যবসা-বাণিজ্যে স্থবিরতার প্রভাবও আছে ঈদ বাজারে।

দোকান মালিক সমিতির সভাপতি হেলাল উদ্দিন কালের কণ্ঠকে বলেন, ঈদ কোনাকাটার ৮০ শতাংশই পোশাককেন্দ্রিক। সাধারণত প্রতিবছর বিক্রি কমপক্ষে ১০ শতাংশ বাড়ে। কিন্তু গত বছরের ২০ রমজানের তুলনায় এবার একই সময়ের তুলনামূলক চিত্র নিয়েছি। তাতে আমরা ২০ থেকে ২৫ শতাংশ পিছিয়ে আছি। আরো চার-পাঁচ দিনের বিক্রি কতটা বাড়বে তা নিয়ে যথেষ্ট সংশয় রয়েছে। এতে এবার পুরো ঈদের অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডের পরিমাণ আড়াই লাখ কোটি টাকার কম হবে বলে আমার বিশ্বাস। 

দোকান, শপিং মল ছাড়াই ঈদ কেনাকাটা হচ্ছে ই-কমার্সেও। তবে সেখানেও গতি কম বলে জানিয়েছেন বাংলাদেশ সফটওয়্যার অ্যান্ড ইনফরমেশন সার্ভিসেসের (বেসিস) সাবেক সভাপতি ও ই-কমার্স প্রতিষ্ঠান আজকের ডিলের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা ফাহিম মাশরুর। তিনি কালের কণ্ঠকে বলেন, সাধারণ মানুষের হাতে টাকা কম। খাবারের দাম বেড়ে যাওয়ায় পোশাকে খরচ কমে গেছে। অনেকের চাকরি চলে যাওয়ায় অনেক মধ্যবিত্ত পরিবার সংকটে আছে। এর প্রভাব পড়ছে ঈদের কোনাকাটায়। অনলাইনেও এবার বেচাকেনা কম।

রাজধানীর বসুন্ধরা সিটি শপিং কমপ্লেক্স, ধানমণ্ডি এলাকাসহ বেশ কয়েকটি শপিং মল ঘুরে দেখা গেছে, ব্র্যান্ডের দোকানে ক্রেতাদের ভিড় বেশি ছিল। সাধারণত অভিজাত শপিং মলগুলো ও ব্র্যান্ডের দোকান থেকে পণ্য কিনে থাকেন বিত্তশালীরা। বসুন্ধরা সিটি শপিং মলে ছিল ক্রেতাদের উপচে পড়া ভিড়। ইয়োলো, জেন্টেল পার্ক, আড়ংসহ ব্র্যান্ডের দোকানগুলোর প্রতিটির কাউন্টারে বিল দেওয়ার জন্য লাইনে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখা গেছে ক্রেতাদের।

রোজার প্রথম দিকে বেচাকেনায় ভাটা গেলেও এখন তা বাড়তে শুরু করেছে বলে জানালেন দেশের অন্যতম ফ্যাশন হাউস অঞ্জনসের স্বত্বাধিকারী শাহিন আহমেদ। তিনি কালের কণ্ঠকে বলেন, রোজার প্রথম দিকে বাজারে তেমন ক্রেতা ছিল না। তবে ১৫ রোজার পর থেকে বাজারে ক্রেতা বেড়েছে। এখন পর্যন্ত বিক্রি ঠিক আছে, বাকি চার-পাঁচ দিন হয়তো আরো বাড়বে।

এদিকে ঈদকে কেন্দ্র করে রাজধানীর ফুটপাতের মার্কেটগুলোতে ক্রেতাদের উপস্থিতি স্বাভাবিক সময়ের তুলনায় বেড়েছে। তবে ফুটপাতে দেখা মেলে না আগের দৃশ্য। অল্প টাকায় দরদাম করে নিম্নবিত্তদের পোশাক কেনার পরিবর্তে এক দামে মধ্যবিত্তরাই কিনছে ফুটপাতের বেশির ভাগ দোকান থেকে। আর ঈদের কেনাকাটা নিম্নবিত্তদের নাগালের বাইরে চলে গেছে।

ক্রেতা টানতে ছাড়

মোহাম্মদপুরের তাজমহল রোর্ডের ফ্যাশন হাউস সুলতানে সব পোশাকে ৫০ শতাংশ ছাড় চলছে। বাটাও নির্দিষ্ট কিছু পণ্যে ছাড় ঘোষণা করেছে। ঈদের সময় ছাড় দেওয়ার নজির কম। ক্রেতা টানতে পণ্যের দাম কমানোর পরও ঢাকার ছোট পোশাক ও জুতার দোকানগুলোতে ঈদের বিক্রি প্রত্যাশার চেয়ে কম হচ্ছে।

কার্ডে কেনাকাটায় ক্যাটস আই, ফিট অ্যালিগেন্স, রাইজ, ক্রিয়াস, সারা লাইফস্টাইল লিমিটেড, মিরর, স্মার্টেক্স, তাহুর লাইফস্টাইল ও ওয়্যারহাউসের মতো শীর্ষস্থানীয় ফ্যাশন ব্র্যান্ডে ২০ শতাংশ পর্যন্ত ছাড় দেওয়া হচ্ছে।

মিরপুর, ফার্মগেট ও কারওয়ান বাজারের ব্যবসায়ীরা জানান, আগের বছরের তুলনায় এবার বিক্রি ২০-৩০ শতাংশ কমেছে। অনেকেই তাঁদের লক্ষ্যমাত্রার ৬০ শতাংশও বিক্রি করতে হিমশিম খাচ্ছেন।

এদিকে ঈদ ঘিরে ইলেকট্রনিকস ও ইলেকট্রিক্যাল পণ্যের চাহিদা কিছুটা বেড়েছে। সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, প্রতিবছর প্রায় ৬০ শতাংশেরও বেশি ফ্রিজ দুই ঈদে বিক্রি হয়ে থাকে। তবে রোজার ঈদের তুলনায় কোরবানির ঈদে ফ্রিজের চাহিদাটা একটু বেশিই থাকে।

রাজধানীর বিভিন্ন এলাকায় রেফ্রিজারেটরের বিভিন্ন ব্র্যান্ডের শোরুম ঘুরে দেখা গেছে, প্রতিবারের মতো এবারও ঈদ ঘিরে শোরুমগুলোতে ফ্রিজের সরবরাহ বাড়িয়েছে কম্পানিগুলো। নতুন নতুন ডিজাইনের ফ্রিজ নিয়ে এসেছে দেশি-বিদেশি ব্র্যান্ডগুলো। কম্পানিগুলো ক্রেতা আকর্ষণে ফ্রিজ বিক্রিতে বিশেষ অফার দিয়েছে। ফ্রিজ কিনে লাখপতি ও কোটিপতি হওয়ারও অফার চলছে দেশি কয়েকটি কম্পানিতে। নগদ টাকায় ফ্রিজ কিনলে ১০ শতাংশ পর্যন্ত ডিসকাউন্ট সুবিধাও রেখেছে অনেক কম্পানি।

এ বিষয়ে ওয়ালটন ফ্রিজের চিফ বিজনেস অফিসার তাহসিনুল হক কালের কণ্ঠকে বলেন, ঈদ সামনে রেখে অর্ধশতাধিক অত্যাধুনিক ফিচার সমৃদ্ধ বেশ কিছু নতুন মডেলের ফ্রিজ বাজারে ছেড়েছে ওয়ালটন। বিদ্যুৎ সাশ্রয়ী ও পরিবেশবান্ধব ফ্রিজ উৎপাদন আমাদের সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার। তাই ওয়ালটন ফ্রিজে ব্যবহার করা হচ্ছে এমএসও প্লাস (ম্যাট্রিকস স্পিড অপটিমাইজেশন) ইনভার্টার টেকনোলজি। গত অর্থবছরে প্রায় এক লাখ ইউনিট ফ্রিজ রপ্তানি করেছি আমরা। ২০২৬ সালের মধ্যে তিন লাখ ইউনিট ফ্রিজ রপ্তানির টার্গেট রয়েছে আমাদের।

দেশের শীর্ষস্থানীয় গৃহস্থালি পণ্য উৎপাদন ও বিপণনকারী প্রতিষ্ঠান আরএফএল গ্রুপ ২০১৩ সালে ভিশন ব্র্যান্ড নামে ফ্রিজ উৎপাদন শুরু করে। প্রাণ-আরএফএল গ্রুপের পরিচালক (বিপণন) কামরুজ্জামান কামাল কালের কণ্ঠকে বলেন, বর্তমানে ভিশন রেফ্রিজারেটরের তিন শতাধিক মডেল রয়েছে। ভিশনের ফুলঝুড়ি মেগা অফার সিজন-৭ চলছে। একই সঙ্গে ভিশন রেফ্রিজারেটর কিনলেই মিলবে ৫ থেকে ১০ শতাংশ পর্যন্ত ছাড়। এ ছাড়া অনলাইন থেকে দুটি নির্দিষ্ট মডেলের রেফ্রিজারেটর কিনলে মিলবে ১০ হাজার টাকা ডিসকাউন্ট।

রাজধানীর বিভিন্ন এলাকায় রেফ্রিজারেটরের বিভিন্ন ব্র্যান্ডের শোরুম ঘুরে দেখা গেছে, প্রতিবারের মতো এবারও ঈদ ঘিরে শোরুমগুলোতে ফ্রিজের সরবরাহ বাড়িয়েছে কম্পানিগুলো। নতুন নতুন ডিজাইনের ফ্রিজ নিয়ে এসেছে দেশি-বিদেশি ব্র্যান্ডগুলো। কম্পানিগুলো ক্রেতা আকর্ষণে ফ্রিজ বিক্রিতে বিশেষ অফার দিয়েছে।

রাজধানীর বাড্ডার মিনিস্টার হাই-টেক পার্ক ব্রাঞ্চের ম্যানেজার হাসান মোহাম্মদ সোহেল কালের কণ্ঠকে বলেন, ঈদ উপলক্ষে গত কয়েক মাসের তুলনায় ফ্রিজের চাহিদা কিছুটা বেড়েছে। অনেকে শোরুমে এসে ফ্রিজ দেখে দামদর জেনে যাচ্ছেন। সর্বোচ্চ ৫৩ শতাংশ পর্যন্ত ডিসকাউন্ট রয়েছে।

ঢাকা চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির (ডিসিসিআই) সভাপতি তাসকীন আহমেদ কালের কণ্ঠকে বলেন, বাজারে ক্রেতাদের উপচে পড়া ভিড়, এলসি খোলার পরিস্থিতির উন্নতি, বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ বৃদ্ধি ইত্যাদি কারণে পণ্যের সরবরাহ বেড়েছে। পণ্য সরবরাহব্যবস্থা স্বাভাবিক থাকায় বাজারে অতিরিক্ত মূল্যবৃদ্ধির চাপ নেই এবং বিগত কয়েকটি ঈদের তুলনায় কেনাকাটায় স্বাচ্ছন্দ্য ফিরে এসেছে। দেশের অর্থনীতি ধীরে ধীরে ইতিবাচক ধারায় ফিরছে। এর ফলে সাধারণ মানুষ তাদের সামর্থ্যের মধ্যে ঈদের কেনাকাটা করতে পারছে, যা বাজারে ইতিবাচক প্রভাব ফেলছে।