
ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের প্রত্যাশা পূরণে অন্তর্বর্তী সরকার জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের মাধ্যমে রাষ্ট্র সংস্কারের জন্য কাজ চালিয়ে যাচ্ছে। অন্তর্বর্তী সরকার গঠিত ১১টি সংস্কার কমিশনের মধ্যে সাতটি কমিশন এরই মধ্যে সুপারিশ জমা দিয়েছে। এর মধ্যে পাঁচটি সংস্কার কমিশনের সুপারিশ নিয়ে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে ঐকমত্য প্রতিষ্ঠার চেষ্টা করছে জাতীয় ঐকমত্য কমিশন। কিন্তু এর সফলতা এখনো স্পষ্ট নয়। অনেক বিষয়ে ভিন্নমত প্রকাশের খবর মিলছে। বেশ কিছু বিষয়ে এক দলের চাওয়ার সঙ্গে অন্য দলের চাহিদা মিলছে না। আশা-নিরাশার এই দোলাচলে রাষ্ট্রের মেরামত কতটা সম্পন্ন হবে তা নিয়ে জনপরিসরে নানামুখী আলোচনা চলমান। ঐকমত্য কমিশন ১৬৬টি সুপারিশের ওপর রাজনৈতিক দলের মতামত নিচ্ছে।
এর মধ্যে ৭০টি সংবিধানসংক্রান্ত, ২৭টি নির্বাচনব্যবস্থা সংস্কারসংক্রান্ত। বিচার বিভাগসংক্রান্ত ২৩টি, জনপ্রশাসনসংক্রান্ত ২৬টি ও ২০টি দুর্নীতি দমন কমিশনসংক্রান্ত। এই সুপারিশে একমত, আংশিক একমত ও ভিন্নমতে ‘টিক’ চিহ্ন দিয়ে জানাতে ‘স্প্রেডশিট’ দেওয়া হয়েছে। তবে এর বাইরেও মতামত রাখছে দলগুলো।
নির্বাচনের আগে সংস্কারকাজ কতটা সম্পন্ন করা সম্ভব—এ প্রশ্নে জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের সদস্য এবং নির্বাচনব্যবস্থা সংস্কার কমিশনের প্রধান ড. বদিউল আলম মজুমদার গতকাল সোমবার কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘আমি মনে করি, ডিসেম্বরে জাতীয় নির্বাচন হলেও নির্বাচনকে সহায়তা করবে এমন অনেক সংস্কার প্রস্তাব নির্বাচনের অনেক আগেই বাস্তবায়ন করা সম্ভব। যে প্রস্তাবগুলো সম্পর্কে ভিন্নমত আসছে সেগুলো হয়তো বাস্তবায়ন হবে না। তার পরও আমি মনে করি, ভিন্নমতের বিষয়গুলো নিয়ে আরো চিন্তা-ভাবনা করা দরকার। কারণ, রাষ্ট্র মেরামতের যে সুবর্ণ সুযোগ এসেছে, এই সুযোগ হাতছাড়া করা ঠিক হবে না। কিছু সংস্কার নির্বাচনের পরে করতে হবে। এই সুযোগ হাতছাড়া করলে ভবিষ্যৎ বংশধর আমাদের ক্ষমা করবে না।’
গত ১৭ মার্চ আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ে পুলিশের উচ্চপদস্থ কর্মকর্তাদের সঙ্গে বৈঠকে অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূস বলেন, ‘অন্তর্বর্তী সরকারের হাতে খুব বেশি সময় নেই। আমরা এরই মধ্যে সাত মাস পার করে এসেছি। আমরা বলছি, ডিসেম্বরে নির্বাচন হবে। কাজেই কী কী সংস্কার করতে চাই, করে ফেলতে হবে।’ গত ১৪ মার্চ জাতিসংঘের মহাসচিব আন্তোনিও গুতেরেসকে তিনি জানান, চলতি বছরের ডিসেম্বরে কিংবা আগামী বছরের জুনে জাতীয় সংসদ নির্বাচন হবে। রাজনৈতিক দলগুলো যদি ‘সংক্ষিপ্ত সংস্কার প্যাকেজ’ নিয়ে একমত হয়, তবে নির্বাচন ডিসেম্বরেই হতে পারে। তবে তারা যদি ‘বৃহৎ সংস্কার প্যাকেজ’ গ্রহণ করে, তাহলে নির্বাচন আগামী বছরের জুনে অনুষ্ঠিত হবে।
প্রধান উপদেষ্টার ওই বক্তব্য এবং জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের সঙ্গে সংলাপে রাজনৈতিক দলগুলোর মতামতের ভিন্নতা থেকে অনেকেরই ধারণা, অন্তর্বর্তী সরকার ‘সংক্ষিপ্ত সংস্কার প্যাকেজ’-এর দিকেই যাচ্ছে।
বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল বিএনপিকে বর্তমানে সবচেয়ে জনপ্রিয় দল মনে করা হচ্ছে। সম্প্রতি উন্নয়ন গবেষণা ও প্রকল্প ব্যবস্থাপনা সংস্থা ইনোভিশন কনসালটিং বাংলাদেশ পরিচালিত জরিপে বর্তমানে বিএনপিকেই দেশের সবচেয়ে জনপ্রিয় দল হিসেবে চিহ্নিত করে বলা হয়েছে, এই মুহূর্তে নির্বাচন হলে বিএনপি সর্বোচ্চ ৪১.৭ শতাংশ ভোট পাবে। দ্বিতীয় অবস্থানে থাকা জামায়াতে ইসলামী পাবে ৩১.৬ শতাংশ ভোট। আর ছাত্রদের নতুন রাজনৈতিক দল জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি) পাবে ৫.১ শতাংশ ভোট।
জনপ্রিয়তার শীর্ষে থাকা বিএনপি জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের সংস্কার প্রস্তাবগুলোর অনেকাংশে ভিন্নমত প্রকাশ করেছে। বিএনপি মনে করে, সংস্কার একটি চলমান প্রক্রিয়া। নির্বাচনসংশ্লিষ্ট প্রয়োজনীয় কিছু সুপারিশ আগেই বাস্তবায়ন করে বাকি গ্রহণযোগ্য সুপারিশগুলো বাস্তবায়ন করা যেতে পারে নির্বাচনের পর জাতীয় সংসদের মাধ্যমে। একই সঙ্গে দ্রুত নির্বাচনের দাবিও রয়েছে দলটির। সংস্কারপ্রক্রিয়া দীর্ঘায়িত করাকে সন্দেহের চোখে দেখেন দলটির শীর্ষ পর্যায়ের নেতারা।
গত রবিবার বিএনপি জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের সঙ্গে সংলাপে যে মতামত দিয়েছে, তাতে সংস্কার সম্পর্কে দলটির অবস্থান আরো স্পষ্ট হয়েছে বলেই মনে করা হচ্ছে।
জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের প্রস্তাবে ১৯৭১ ও ২০২৪ সালকে এক কাতারে আনা হয়েছে, যা সমুচিত নয় বলে মনে করে বিএনপি। রাষ্ট্রের সাংবিধানিক নাম পরিবর্তন করার প্রয়োজন আছে বলেও মনে করে না দলটি। দলের পক্ষ থেকে কমিশনের প্রস্তাবের পাশাপাশি বেশ কয়েকটি বিষয়ে দ্বিমত ও লিখিতভাবে বেশ কিছু নতুন প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে বলে জানান দলটির স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহউদ্দিন আহমদ।
তিনি বলেন, সংবিধানের প্রস্তাব স্প্রেডশিটে উল্লেখ করা হয়নি। এটি উচিত ছিল। সংবিধানের গুরুত্বপূর্ণ অংশ হলো প্রস্তাব। সেটি পুরোপুরি পরিবর্তন বা সংশোধনের প্রস্তাব করা হয়েছে। অনেকটা পুনর্লিখনের মতো। সেখানে ১৯৭১ সালের স্বাধীনতাযুদ্ধের সঙ্গে ২০২৪ সালের অভ্যুত্থানকে এক কাতারে আনা হয়েছে। এটা সমুচিত বলে বিএনপি মনে করে না। এটাকে অন্য জায়গায় রাখা বা সংবিধানের তফসিল অংশে রাখার বিভিন্ন রকম সুযোগ আছে। সেটা নিয়ে আলোচনা করে সিদ্ধান্ত নেওয়া যাবে। বিএনপি পঞ্চদশ সংশোধনের আগের অবস্থায় যে প্রস্তাব ছিল সেটির পক্ষে।
সংবিধানে রাষ্ট্রের নাম পরিবর্তনের বিষয়ে তিনি বলেন, বাংলাদেশের মানুষ দীর্ঘদিনের প্র্যাকটিসের মাধ্যমে রাষ্ট্রের নাম মেনে নিয়েছে। এটা নিয়ে কতটুকু অর্জন হবে তা প্রশ্নের দাবি রাখে। এ বিষয়ে বিএনপি একমত নয়। এনআইডি ও সীমানা নির্ধারণের ক্ষমতা নির্বাচন কমিশনের হাতে রাখতে মতামত দিয়েছে বিএনপি। সংস্কার কমিশনের সুপারিশ নিয়ে নির্বাচন কমিশনের পক্ষ থেকে একই মত দেওয়া হয়েছিল।
দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) বিষয়ে সালাহউদ্দিন আহমদ বলেন, ‘দুদক নিয়ে ২০টির মতো প্রস্তাব ছিল। এর মধ্যে আমরা ১১টিতে সরাসরি একমত। আর সাত-আটটিতে আমরা মন্তব্যসহ নীতিগতভাবে একমত প্রকাশ করেছি। শুধু একটি প্রস্তাবে আমরা মন্তব্যসহ ভিন্নমত পোষণ করেছি। কারণ, ওখানে একটি আইন সংশোধনের বিষয় রয়েছে।’
সালাহউদ্দিন আহমদ বলেন, ‘প্রশাসন সংস্কারে আমরা যেসব প্রস্তাব পেয়েছি তার প্রায় অর্ধেক প্রস্তাবে একমত। বিদ্যমান এসএসপি ব্যবস্থা বাতিলের সুপারিশ করা হয়েছে, যার সঙ্গে আমরা একমত নই। তার পরিবর্তে মন্ত্রিপরিষদের একটি কমিটি করার প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে।’
তিনি বলেন, ‘এর মধ্য দিয়ে প্রশাসনে রাজনীতিকরণের সম্ভাবনা রয়েছে। এ জন্য আমরা ভিন্নমত পোষণ করেছি। আরেকটা বিষয়ে প্রমোশনের ক্ষেত্রে যে প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে সেখানে আদালতের একটা রায় আছে। আদালতের রায় বহাল থাকায় ওই বিষয়ে আমরা কোনো মন্তব্য করতে চাইনি।’
বিচার বিভাগ সংস্কার প্রসঙ্গে সালাহউদ্দিন আহমদ বলেন, ‘বিচার বিভাগের ক্ষেত্রে সব প্রস্তাবে আমরা একমত। আমাদের ৩১ দফার মধ্যে বিচার বিভাগের পূর্ণাঙ্গ স্বাধীনতার কথা বলেছি। বিচার বিভাগের ক্ষেত্রে চার-পাঁচটি বিষয়ে আমরা মন্তব্যসহ অন্য মতামত দিয়েছি, এটা বিস্তারিত আলোচনা করা যাবে।’
নির্বাচনব্যবস্থা সংস্কার কমিশনের প্রতিবেদনে ২৭টি সুপারিশের মধ্যে বেশির ভাগ প্রস্তাব সংবিধান সংশোধনের সঙ্গে সম্পৃক্ত উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘এটা আমরা ঠিক বুঝতে পারিনি। নির্বাচনব্যবস্থাসংক্রান্ত সংস্কারের প্রস্তাবে কিছু সংবিধান সংশ্লিষ্টতা আছে, কিন্তু বেশির ভাগ ক্ষেত্রে দেখা যায়, নির্বাচন সংস্কার কমিশনের কাজ নয় সে বিষয়েও সুপারিশ এসেছে। ওই সব বিষয়ে সংবিধান সংস্কার কমিশনের সুপারিশে আমরা মতামত দিয়েছি। নির্বাচন কমিশনের কিছু ক্ষমতা খর্ব করার প্রস্তাবে আমরা মনে করি এটি নির্বাচন কমিশনের স্বাধীনতার ওপর হস্তক্ষেপ।’
সালাহউদ্দিন আহমদ জানান, বিএনপি জাতীয় পরিচয়পত্র বা এনআইডি নির্বাচন কমিশনের কাছেই থাকা দরকার। সংসদীয় আসনের সীমানা নির্ধারণও নির্বাচন কমিশনের সাংবিধানিক এখতিয়ার। নির্বাচন কমিশনের সেই আইনে সামান্য একটা প্রিন্টিং মিসটেক ছিল সেটা নিয়ে আমরা প্রধান উপদেষ্টার কাছে দিয়েছি, নির্বাচন কমিশনের সঙ্গে আলাপ করেছি, আইন মন্ত্রণালয়ে বিষয়টি গেছে; কিন্তু সেটা এখনো সংশোধন হয়নি। আমরা সরকারকে আহ্বান জানাব, অধ্যাদেশের মাধ্যমে সংশোধনী দিয়ে নির্বাচন কমিশনের হাতে সীমানা নির্ধারণ রাখা হোক। আলাদা কোনো প্রতিষ্ঠানের কাছে রাখার বিষয়টি আমরা নাকচ করছি। নির্বাচন কমিশনকে দায়বদ্ধতার জন্য সংসদীয় কমিটির কাছে জবাবদিহি করার জন্য একটা সুপারিশ এসেছে। এতে আমাদের মত নেই। সংবিধানে মৌলিক অধিকার বা মূলনীতির ক্ষেত্রে ব্যাপক পরিবর্তনের সুপারিশ এসেছে। আমরা আমাদের পক্ষ থেকে বিদ্যমান অবস্থা বহাল রাখার জন্য বলেছি। মৌলিক অধিকার ও স্বাধীনতা নামক আলাদা চ্যাপ্টার সংযোজন করার সুপারিশ সম্পর্কে আমরা মনে করি, পার্লামেন্টারি অভিজ্ঞতা বা রাষ্ট্র পরিচালনার অভিজ্ঞতা না থাকার কারণে এমন সুপারিশ আসতে পারে। নির্বাহী বিভাগ, আইন বিভাগ এবং বিচার বিভাগের ক্ষেত্রে যেসব কমিশন গঠন বা কার্যাবলির প্রস্তাব করা হয়েছে, তা বাস্তবায়ন হলে জনপ্রতিনিধির কোনো ক্ষমতা থাকে না। রাষ্ট্র নির্বাচিত প্রতিনিধিদের দ্বারা পরিচালিত হবে। এটা হলো আমাদের চেতনা। দ্বিকক্ষবিশিষ্ট সংসদের প্রস্তাব আমরা আগেই দিয়েছি। আমার মনে হয়, এটার ক্ষেত্রে জাতীয় ঐকমত্য তৈরি হয়েছে।’
জানা যায়, কোনো ব্যক্তি দুই মেয়াদের বেশি প্রধানমন্ত্রী থাকতে পারবেন না, এই সংস্কার প্রস্তাবের বিষয়ে একমত নয় বিএনপি। স্প্রেডশিটের মন্তব্য বিভাগে দলটি লিখেছে, এ বিষয়ে তারা একমত নয়। বিষয়টি হওয়া উচিত, কোনো ব্যক্তি টানা তিনবার প্রধানমন্ত্রী হতে পারবেন না।
এ ছাড়া একই ব্যক্তি একই সঙ্গে প্রধানমন্ত্রী, সংসদ নেতা ও রাজনৈতিক দলের প্রধান হতে পারবেন না—এ প্রস্তাবও সমর্থন করেনি বিএনপি। এ বিষয়ে দলটির মন্তব্য—এটি সংশ্লিষ্ট দলের সিদ্ধান্তের বিষয়।
রাজনীতিবিদরা যা বলছেন : বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ইকবাল হাসান মাহমুদ টুকু কালের কণ্ঠকে বলেন, একটি অবাধ ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচন অনুষ্ঠান করতে প্রশাসনিক সংস্কার ও মাঠের সংস্কার করতে হবে। এর পাশাপাশি নির্বাচনসংশ্লিষ্ট কিছু সংস্কার দরকার। এর বাইরে আপাতত কোনো সংস্কারের প্রয়োজন নেই।
তিনি বলেন, ‘সরকার মতামত চেয়েছে। আমরা সেই মতামত দিয়েছি। সরকারের কোনো প্রস্তাবের সঙ্গে আমরা একমত হয়েছি, কোনোটির সঙ্গে দ্বিমত রয়েছে। কিছু ক্ষেত্রে আংশিক ঐকমত্য হয়েছি। সে বিষয়ে মতামত তুলে ধরা হয়েছে। কিন্তু আমরা মনে করি, সংবিধানসংক্রান্ত যেসব সংস্কার তা জাতীয় সংসদ ছাড়া হতে পারে না। সে জন্য জাতীয় সংসদ নির্বাচন করে জনপ্রতিনিধিদের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর করতে হবে, যাতে সেই সংস্কারগুলো করা যায়।’
জামায়াতে ইসলামীর নায়েবে আমির অধ্যাপক মুজিবুর রহমান বলেন, ‘নির্বাচনের জন্য একটি সুষ্ঠু পরিবেশ তৈরি করা জরুরি। আমরা বলে আসছি, আগে প্রয়োজনীয় সংস্কার করতে হবে, তারপর নির্বাচন। আমরা ব্যক্তিগত প্রার্থিতা বাদ দিয়ে আনুপাতিক পদ্ধতির পক্ষে কথা বলেছি। এতে কোনো ব্যক্তির প্রার্থিতা থাকবে না, দলের প্রতীক থাকবে। নির্বাচনে কালো টাকা ছড়ানো হয়। গরিব মানুষ স্বাভাবিকভাবে টাকার দিকে ঝোঁকে। অনেকে লোভ সামলাতে পারেন না। জামায়াতের পক্ষে নির্বাচনে টাকা বিতরণের সামর্থ্য নেই। টাকা দিয়ে ভোট কেনা ঘুষের শামিল। নির্বাচনে কাউকে ভয় দেখানো হয়। ভোট না দিলে জেলে পাঠানোর হুমকি দেওয়া হয়। আনুপাতিক পদ্ধতিতে কেউ টাকা ছড়াবে না বা ভয় দেখাবে না।
সংস্কার একটি চলমান প্রক্রিয়া বলে মনে করেন বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টির (সিপিবি) সাধারণ সম্পাদক ও বাম গণতান্ত্রিক জোটের শীর্ষ নেতা রুহিন হোসেন প্রিন্স। তিনি বলেন, ‘সংস্কারের কাজগুলো করার উপযুক্ত পদ্ধতি টিক চিহ্ন দেওয়া নয়। এ জন্য উপযুক্ত পদ্ধতি হচ্ছে আলাপ-আলোচনা করা। এ জন্য আমরা জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের সঙ্গে আলোচনার অপেক্ষায় আছি। সেখানে সব সুপারিশের বিষয়ে দলের মতামত তুলে ধরা হবে।’ তিনি আরো বলেন, “সংস্কারের যে প্রস্তাবগুলো দিয়েছে, তার অনেকটার সঙ্গে সিপিবি একমত। অনেক প্রস্তাবের সঙ্গে মৌলিকভাবে দ্বিমত রয়েছে। অনেক প্রস্তাবের বিকল্প প্রস্তাব আছে। অনেক প্রস্তাব একেবারেই নাকচ করে দেওয়ার আছে। তাই অনেক কিছু যদি শুধু ‘হ্যাঁ’ বা ‘না’-এর মধ্যে থাকি, তাহলে পুরো যে সংস্কার প্রস্তাব, সেটা একটা ভুল বোঝাবুঝির জায়গায় যাবে। সংস্কারের মূল দায়িত্ব জনগণের। এটি তাদের ওপর ছেড়ে দিতে হবে। আর সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের জন্য প্রয়োজনীয় সংস্কার শেষ করে দ্রুত নির্বাচন দিতে হবে।”
জাতীয় ঐকমত্য না হলে সংস্কার প্রস্তাব বাস্তবায়ন সম্ভব নয় বলে মনে করেন বাসদের (মার্কসবাদী) কেন্দ্রীয় নির্বাহী ফোরামের সমন্বয়ক মাসুদ রানা। তিনি বলেন, ‘আমরা মনে করি, কমিশনের দেওয়া সংস্কার প্রস্তাবগুলো নিয়ে রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে যথেষ্ট আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে একটা ঐকমত্যে পৌঁছানো জরুরি। কোন মাধ্যমে এই প্রস্তাবগুলো কার্যকর হবে সেটাও এই ঐকমত্যের অন্তর্ভুক্ত হওয়া উচিত। কমিশনের পক্ষ থেকে স্প্রেডশিটে যেভাবে টিক চিহ্নের মাধ্যমে মতামত চাওয়া হয়েছে, সেভাবে মতামত দিয়ে ঐকমত্যে পৌঁছানোর পদ্ধতিটি যথাযথ নয়। বিষয়গুলো জটিল এবং বেশির ভাগ বিষয়ই ব্যাখ্যার দাবি রাখে। খুব অল্প কয়েকটি পয়েন্টে এরূপ এককথায় উত্তর দেওয়া যায়। আমরা কমিশনকে জানিয়েছি, আমাদের বক্তব্যটা আমরা মূলত লিখিত আকারেই রাখব।’
তিনি আরো বলেন, ‘রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে সংলাপের আগেই ১১১টি প্রস্তাব বাস্তবায়নের সিদ্ধান্ত নিয়েছে সরকার। এই প্রস্তাবগুলোর মধ্যে রাজনৈতিক দলের নিবন্ধন বিধির সংস্কার বিষয়ে বেশির ভাগ দলের ঐকমত্য আছে। বাকি প্রস্তাবগুলো নিয়ে যথেষ্ট আলোচনা করা প্রয়োজন বলে আমরা মনে করি। কারণ, এখানে কিছু প্রস্তাব রয়েছে, যা জনস্বার্থবিরোধী।’
জাতীয় ঐকমত্য কমিশনকে এখনো লিখিত মতামত জানায়নি বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টি। পার্টির কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য ও গণতন্ত্র মঞ্চের অন্যতম নেতা আকবর খান বলেন, ‘এরই মধ্যে সংস্কার প্রস্তাবগুলো নিয়ে পার্টির বৈঠকে আলোচনা হয়েছে। দ্রুতই তা চূড়ান্ত করে আগামী বৃহস্পতিবার কমিশনের কাছে জমা দেওয়া হবে। তবে লিখিত মতামতের থেকে প্রস্তাবগুলো নিয়ে আলোচনা গুরুত্বপূর্ণ। কারণ, সার্বিক পরিস্থিতি বিবেচনায় রাজনৈতিক দলগুলোর ঐকমত্যের ভিত্তিতে সংস্কার ও নির্বাচনের দিন-তারিখ ঘোষণা দরকার। জনগণও দীর্ঘদিন ভোট দিতে পারেনি, তারাও অপেক্ষা করছে। আবার নির্বাচিত সরকার না থাকায় জনজীবনে সংকট বাড়ছে। সংকট মোকাবেলায় নির্বাচিত সরকারের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর জরুরি।’ সে ক্ষেত্রে নির্বাচনকে গুরুত্ব না দিয়ে ব্যাপক সংস্কারের উদ্যোগ নিলে তা জন-আকাঙ্ক্ষার বিপরীতে যেতে পারে বলে আশঙ্কা প্রকাশ করেন তিনি।
বিএনপি দুটি কমিশনের সুপারিশে বিস্তারিত লিখিত মতামত দিয়েছে। বাকি তিন কমিশনের বিষয়ে পরে জানাবে বলে জানিয়েছে। এনসিপি পাঁচটি কমিশনের সুপারিশেই লিখিত মতামত জানিয়েছে।
নির্বাচনের আগে সংস্কারের বিষয়ে জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি) কতটুকু আশাবাদী জানতে চাইলে দলটির যুগ্ম আহ্বায়ক সারোয়ার তুষার বলেন, ‘সংস্কারের বিষয়ে আমরা আশাবাদী। আমরা মনে করি, যেহেতু ওয়েবসাইটে সংস্কার প্রস্তাব ও দলগুলোর মতামত প্রকাশ করা হবে, সে ক্ষেত্রে জনগণের কাছে সবার প্রস্তাবগুলো পরিষ্কার হবে। তখন জনগণ সিদ্ধান্ত নেবে এবং জনগণের প্রত্যাশার চাপে দলগুলো সংস্কারে সম্মত হতে বাধ্য হবে। তবে সংস্কারের প্রক্রিয় নিয়ে আমাদের কিছু প্রশ্ন রয়েছে। প্রক্রিয়াটি আরো গোছানো হতে পারত। পুলিশ সংস্কার ও স্থানীয় সরকার সংস্কার কমিশনের প্রতিবেদন সুপারিশ পাঠানো হয়নি। তার পরও যে প্রস্তাবগুলো এসেছে সেগুলো কম্পাইল করে স্প্রেডশিট হয়েছে। স্প্রেডশিট থেকে ছোট করে জুলাই সনদ করা হবে। এর ফলে অনেক সংস্কার প্রস্তাব এমনিতেই বাদ পড়ে যাচ্ছে। তাহলে তিন মাস ধরে একেকটা কমিশন কাজ করল, তারপর শুধু দলগুলো মানতে চাইবে না এর জন্য একেকটা জিনিস বাদ দেবেন তা তো হয় না। সব সংস্কারের প্রস্তাব জুলাই সনদে থাকতে পারত। আমরা একটা মৌলিক পরিবর্তন আনতে চাই। কিন্তু অন্যান্য রাজনৈতিক দল সেটা চায় না। তারা বিদ্যমান ক্ষমতার অবস্থানটা অক্ষুণ্ন রাখতে চায়। অক্ষুণ্ন রেখে তারা কিছু ঘষামাজা করতে চায়।