Image description

Shafin Rahman( শাফিন রহমান )


গতকাল ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. এস জয়শঙ্কর একটি গুরুত্বপূর্ণ কথা বলেছেন― “শেখ হাসিনার পতনের ব্যাপারে ভারত আগেই অবগত ছিল”। এর আগে গতবছরের অক্টোবরে ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সাবেক বিশেষ সচিব পিনাক রঞ্জনও একই সুরে কথা বলেছিলেন। পিনাক রঞ্জন হলেন সেই ব্যক্তি, যিনি ওয়ান ইলেভেনের সময় ঢাকাস্থ ইন্ডিয়ান এমবাসীর হাইকমিশনার হিসেবে নিযুক্ত ছিলেন। তবে এবার স্বয়ং ভারতীয় পররাষ্ট্রমন্ত্রীর স্বীকারোক্তিতে অনেককিছুই ডিকোড করা সম্ভব হলো।
 
আপনাদের অনেকেরই মনে থাকবে, পাঁচ আগস্ট পরবর্তী সময়ে একটি লিখায় আমি জানিয়েছিলাম- বাংলাদেশে হাসিনার পতনের সময়কালে RAW এর একটি ইউনিট সম্পূর্ণ নিষ্ক্রিয় হয়ে নিউট্রাল পজিশন নেয়। এই পজিশনের মূল কারণ ছিল ইন্দো প্যাসিফিক স্ট্রাটেজিতে সাউথ এশিয়ার রিজিওনাল লিডারশিপ খুঁজে নিতে ভারত-আমেরিকার আনঅফিসিয়াল বার্গেনিং।
 
2011 সালে অস্ট্রেলিয়ার পার্লামেন্টে একটি ভাষণে তৎকালীন মার্কিন প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা বলেন “যুক্তরাষ্ট্রের কৌশলগত মনোযোগ মধ্যপ্রাচ্য থেকে সরিয়ে দক্ষিণ এশিয়ার প্রতি হওয়া উচিত”, যার অফিসিয়াল এস্টেবলিসমেন্ট ঘটে ২০২২ সালে জো বাইডেন এডমিনস্ট্রেশনের সময়।
 
২০২২ সালের এগারো ফেব্রুয়ারি হোয়াইট হাউজ আনুষ্ঠানিকভাবে “Indo Pacific Strategy” প্রকাশ করে। ইন্দো প্যাসিফিক স্ট্রাটেজি প্রকাশিত হবার এক বছরের মাথায় এন্টনি ব্লিঙ্কেন একবার মন্তব্য করেছিলেন “বাংলাদেশ হবে দক্ষিণ এশিয়ার রিজিওনাল পাওয়ার/লিডার”
যুক্তরাষ্ট্রের পরিকল্পনা অনুযায়ী চীনকে মোকাবিলা করতে এবং এই অঞ্চলে তাদের এজেন্ডা বাস্তবায়ন করতে প্রথমেই ভারতের সাথে একটা বার্গেনিং হয়। বার্গেনিংটা এরকম যে- হয় ভারতে কংগ্রেস তথা রাহুলের উত্থান এবং মোদির পতন নয়ত ভারতকে তার ইস্টার্ন ফ্রন্ট বাংলাদেশকে ছেড়ে দিতে হবে।
ভারত তৎক্ষণাৎ কোনো জবাব দেয়নি কারন তাদের জন্য মোদি হাসিনা দুটোই ইম্পরট্যান্ট, দুজনকেই লাগবে। তাই মোদি এবং হাসিনা দুজনেই বাঁচাতে RAW এর দুটো ইউনিটই প্রথমদিকে কাজ করেছে।
 
ভারত যেহেতু দুদিকেই ব্যালেন্স করছিল তাই যুক্তরাষ্ট্রও রাহুল গান্ধীকে পিক করে। যার ফলশ্রুতিতে ভারতের গত লোকসভা নির্বাচনের আগে কংগ্রেস নেতা রাহুল গান্ধীকে বেশ এগ্রেসিভ লক্ষ্য করা গিয়েছিল। তার এপ্রোচে স্বয়ং মোদি, অমিত, আদিত্যনাথ পর্যন্ত তাজ্জব বনে যায়। আর রাহুলের এমন কনফিডেন্সের কারন ছিল নির্বাচনের দুয়েক মাস আগে যুক্তরাষ্ট্র ভ্রমণ। সেখানে তিনি ইউএস ন্যাশনাল সিকিউরিটি এডভাইজারের সাথে সাক্ষাৎ করেছিলেন। এর দেড় মাসের মাথায় বাংলাদেশে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের ব্যানারে আন্দোলন শুরু হয়। সবচেয়ে অবাক করার বিষয়, এই আন্দোলনের হাতে গোনা কয়েকদিন আগে থেকেই ভারতের বড় বড় অলিগারক, পিআর ফার্ম, সামরিক ব্যক্তিবর্গ রাহুলের সান্নিধ্যে যাওয়া শুরু করে, যেন তিনি দেবতাতুল্য। অর্থাৎ তারা একটা ক্লিয়ার ম্যাসেজ পেয়েছিল কোথাও না কোথাও মোদি সরকার ফল করতে যাচ্ছে। সেটা ইন্টারনাল কিংবা এক্সটার্নাল যেকোনো কিছুই হতে পারে।
 
লোকসভা নির্বাচনে মোদির প্রধানমন্ত্রী হবার সম্ভাবনাও ছিল খুবই কম। কারন যুক্তরাষ্ট্র প্রথম থেকেই বিষয়টিকে বিবেচনায় রাখছিল। আর এজন্যই নির্বাচনের আগে বিজেপি ইসরাইল থেকে স্পাইওয়্যার ইলেকট্রনিক ভোটিং মেশিন কিনে। যেখানে আগে থেকেই নির্দিষ্ট পার্সেন্ট ভোট কাস্টিং করে রাখা হয়। পরিকল্পনা ছিল যদি বিজেপির অবস্থা খুবই শোচনীয় হয়, এমনকি কোয়ালিশন করেও পাওয়ারে যাওয়ার অবস্থা না থাকে― তখন এই এডভান্স কাস্টিং ভোট ক্যালকুলেশনে আসবে। কিন্তু কোয়ালিশনের মাধ্যমে সরকার গঠন হওয়ায় আর এই পন্থা ব্যবহার করার প্রয়োজন পড়েনি।
 
যেহেতু বার্গেনিং এর মাধ্যমে নিজ দেশের আপরাইজিং মোকাবিলা করে মোদিকে পুনঃপ্রতিষ্ঠা করা সম্ভব হয়েছিল, তাই ভারতকে তার ইস্টার্ন ফ্রন্ট স্যাক্রিফাইস করতেই হতো এবং ভারত সেটাই করেছে।
 
তবে ইস্টার্ন ফ্রন্ট বাংলাদেশে হাসিনার পতন নিশ্চিত জানলেও ভারত কিন্তু চুপ করে বসে থাকেনি। ওই মুহূর্তে ভারতের প্ল্যান ছিল আপকামিং সরকারের গুরুত্বপূর্ণ পদসমূহে নিজেদের বি টিমকে ইমপ্লিমেন্ট করা। সেই পরিকল্পনার অংশ হিসেবে আসিফ নজরুলকে প্রধান উপদেষ্টা হিসেবে পিক করা হয়। কিন্তু ছাত্রজনতা প্রবলভাবে ডক্টর ইউনুসকে চাওয়ায় ভারতের প্ল্যান বি ফেল করে এবং হাসিনার পতনের পরও বাংলাদেশের উপর তাদের ওয়ান থার্ড গ্রিপ রাখার পরিকল্পনা ভেস্তে যায়।
 
ডক্টর মোহাম্মদ ইউনুস, ডক্টর আলী রিয়াজের মত মানুষেরা বাংলাদেশ রাষ্ট্রের নীতি নির্ধারণী পর্যায়ে বসে যাওয়ায় ভারতের মাথায় একপ্রকার আকাশ ভেঙ্গে পড়ে।
 
পুরোটাই মিটিক্যুলাসলি ডিজাইন্ড। এজন্যই ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী স্বীকার করে নিতে বাধ্য হয়েছেন “শেখ হাসিনাকে পরামর্শ দেওয়া ব্যতীত ভারতের কিছুই করার ছিলনা”
 
তবে এই মুহূর্তে বাঙলাদেশ ইন্দো প্যাসিফিক স্ট্রাটেজির কেন্দ্রে অবস্থান করছে। সম্প্রতি মার্কিন সিনেটর গ্যারি পিটার্সের বাংলাদেশ সফরে আকসা জিসমিয়া চুক্তির ব্যাপার উঠে আসা সেদিকেই ইঙ্গিত করছে। নিজের স্বার্থ বুঝে খেলতে পারলে অনেক কিছুই বাগিয়ে নিতে পারবে বাংলাদেশ।