
২০১২ সালের ৩ জুলাই পুলিশের ট্রেইনি রিক্রুট কনস্টেবল (টিআরসি) পদে নিয়োগ পান ব্রাহ্মণবাড়িয়ার আখাউড়া উপজেলার মোগড়া গ্রামের নান্নু মিয়ার ছেলে মো. সুমন। মুক্তিযোদ্ধার নাতি হিসেবে পুলিশ ভেরিফিকেশনের পর তাঁর এ নিয়োগ সম্পন্ন হয়। ২০১৩ সালের ২৯ মার্চ থেকে কনস্টেবল পদে চাকরিরত ছিলেন তিনি। গত ২১ অক্টোবর তাঁর বিরুদ্ধে প্রতারণার মাধ্যমে চাকরি নেওয়ার লিখিত অভিযোগ দেন স্থানীয় যুবক মো. ফরহাদ মিয়া।
অভিযোগে বলা হয়, মো. সুমনের দাখিল করা মুক্তিযোদ্ধার সনদে উল্লিখিত মো. হোসেন মিয়া (অবসরপ্রাপ্ত সেনাসদস্য) তাঁর দাদা নন। তাঁর দাদার নাম আলতাফ আলী হোসেন। তদন্ত চলাকালে ১ ডিসেম্বর চাকরি থেকে স্বেচ্ছায় অব্যাহতি নেন সুমন। ২ মার্চ তাঁকে গ্রেপ্তারও করেছে পুলিশ।
মুন্সীগঞ্জের গজারিয়া উপজেলার মধ্য ভাটেরচরের বাসিন্দা মৃত রজব আলী দেওয়ানের ছেলে মো. আব্দুল হক গজারিয়া উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে কর্মরত। তাঁর তিন সন্তানও ‘মুক্তিযোদ্ধার সন্তান’ কোটায় সরকারি চাকরিতে কর্মরত। মুক্তিযোদ্ধা যাচাই-বাছাই সংক্রান্ত এক সভায় তথ্যপ্রমাণ না মেলায় আব্দুল হককে অমুক্তিযোদ্ধা হিসেবে শনাক্ত করেছে উপজেলা প্রশাসন। ফলে তিনি অবসরে গেলেও তাঁর তিন সন্তানের মুক্তিযোদ্ধা কোটায় চাকরি নিয়ে শুরু হয়েছে যাচাই-বাছাই।
শুধু ব্রাহ্মণবাড়িয়ার সুমন ও মুন্সীগঞ্জের আব্দুল হকের বিরুদ্ধে নয়; এমন অভিযোগের তালিকা দীর্ঘ। এর আলোকে গত বছরের ১৪ আগস্ট থেকে মুক্তিযোদ্ধা কোটায় চাকরিপ্রাপ্ত সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের তথ্য যাচাই-বাছাই শুরু করেছে অন্তর্বর্তী সরকার। গত সাত মাস ধরে যাচাই-বাছাই চলছে। গত ৫৩ বছরে ছয় দফা বীর মুক্তিযোদ্ধার তালিকা প্রকাশ করে বিভিন্ন সরকার।
জানা গেছে, সরকারি চাকরিতে বেসামরিক প্রশাসনে বর্তমানে ১৪ লাখ ৪৩ হাজার ৫১৮ জন কর্মরত। এর মধ্যে মুক্তিযোদ্ধা কোটায় কর্মরত ৮৯ হাজার ২৩৫ জন। অর্থাৎ, ৫ দশমিক ৯৯ শতাংশ কর্মচারী মুক্তিযোদ্ধা কোটায় চাকরিরত।
যেভাবে শুরু
দায়িত্ব গ্রহণের পর মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক উপদেষ্টা ফারুক-ই-আজম গত ১৪ আগস্ট সরকারি চাকরিতে মুক্তিযোদ্ধা কোটায় কর্মরতদের তালিকা প্রণয়নের নির্দেশ দেন। পরদিন সরকারের ৬২ মন্ত্রণালয় ও বিভাগকে তালিকা পাঠাতে চিঠি দেয় মন্ত্রণালয়। চিঠিতে সরকারি চাকরিতে প্রথম (ক্যাডার ও নন-ক্যাডার) দ্বিতীয়, তৃতীয় ও চতুর্থ শ্রেণিতে কর্মরত কর্মকর্তা-কর্মচারীদের মধ্যে যারা মুক্তিযোদ্ধা কোটায় নিয়োগ পেয়েছেন তাদের জীবনবৃত্তান্তসহ পূর্ণাঙ্গ তথ্য চাওয়া হয়।
এর মধ্যে মুক্তিযোদ্ধা কোটায় নিয়োগপ্রাপ্তদের পিতা/মাতা/পিতামহ/মাতামহের মুক্তিযোদ্ধা সনদ ও গেজেট নম্বর এবং চাকরিতে নিয়োগপ্রাপ্ত হওয়ার তথ্যও উল্লেখ করতে বলা হয়। ওই চিঠির আলোকে বিভিন্ন মন্ত্রণালয় ও প্রতিষ্ঠান থেকে মুক্তিযোদ্ধা কোটায় চাকরিরত ৮৯ হাজার ২৩৫ কর্মকর্তা-কর্মচারীর তথ্য মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হয়।
এখন সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তা-কর্মচারীরা যে মুক্তিযোদ্ধা নামের বিপরীতে চাকরি নিয়েছেন, সেই মুক্তিযোদ্ধার নামে থাকা গেজেট মন্ত্রণালয়ের চূড়ান্ত (সমন্বিত) তালিকায় আছে কিনা, তা খতিয়ে দেখা হচ্ছে। মন্ত্রণালয়ের যুগ্ম সচিব (উন্নয়ন) এসএম রফিকুন্নবীর নেতৃত্বে ১৮ জন কর্মকর্তা এই যাচাই-বাছাই কার্যক্রমে যুক্ত। এখন পর্যন্ত প্রায় ২৯ হাজার সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীর তথ্য যাচাই সম্পন্ন হয়েছে।
কবে নাগাদ যাচাই-বাছাই সম্পন্ন হতে পারে– এমন প্রশ্নের জবাবে এসএম রফিকুন্নবী সমকালকে বলেন, আগামী দুই মাসের মধ্যে যাচাই-বাছাই সম্পন্ন করার লক্ষ্য নিয়ে কাজ চলছে। তিনি জানান, একই জনবল দিয়ে জুলাই গণঅভ্যুত্থান অধিদপ্তরেরও কাজ চলছে।
তথ্যানুযায়ী, মুক্তিযোদ্ধা কোটায় সবচেয়ে বেশি চাকরি হয়েছে প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক পদে। যাচাই-বাছাই হওয়া তথ্যাদির মধ্যে পুলিশ, ব্যাংকসহ অন্যান্য প্রতিষ্ঠানে অমুক্তিযোদ্ধা হয়েও এই সনদে চাকরি নেওয়ার হার বেশি।
সংকটের কারণ
যাচাই-বাছাই সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, এ পর্যন্ত যা যাচাই হয়েছে, তার মধ্যে প্রায় ৪০ শতাংশ কর্মকর্তা-কর্মচারীর দাখিল করা সংশ্লিষ্ট মুক্তিযোদ্ধার তথ্য নিয়ে প্রশ্ন দেখা দিয়েছে। অনেকেই সঠিকভাবে তথ্য লিপিবদ্ধ করেননি। কেউ কেউ মন্ত্রণালয়ের চূড়ান্ত তালিকা অর্থাৎ এমআইএসের (ম্যানেজমেন্ট ইনফরমেশন সিস্টেম) তথ্য দেননি। তথ্যদাতাদের বৃহৎ অংশ বাতিল হওয়া আগের গেজেটের তথ্য। অর্থাৎ বিগত আওয়ামী লীগ সরকার, বিএনপি সরকারের আমলে গেজেটভুক্ত (২০০৫ সাল) যাদের নাম বাদ দিয়েছেন, সেই গেজেটের তথ্য উল্লেখ করেছেন।
আবার আওয়ামী লীগ সরকারের (২০০৯ থেকে ২০১৮ সাল পর্যন্ত) আমলে মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে গেজেটভুক্ত হওয়ার পর তার ওই গেজেট বাতিল হয়েছে, এমন ব্যক্তির তথ্যাদিও রয়েছে। অনেকে শুধু সাময়িক সনদের তথ্য দিয়েছেন। অনেকের আবার মুক্তিযোদ্ধার সনদও খুঁজে পাওয়া যায়নি। তাদের ব্যাপারে মন্ত্রণালয়ের কোনো সিদ্ধান্ত হয়নি। তবে বিবরণীতে তাদের তথ্য উল্লেখ রাখা হচ্ছে।
জানা গেছে, যাচাই সম্পন্ন হওয়ার পর মন্ত্রণালয়ের এ-সংক্রান্ত সভায় সংশ্লিষ্টদের বিষয়ে ধরন অনুযায়ী সিদ্ধান্ত হতে পারে।
এক ব্যাংকে ১৪৫ জন অবৈধ!
মুক্তিযুদ্ধ মন্ত্রণালয় বলছে, কর্মসংস্থান ব্যাংক থেকে মুক্তিযোদ্ধা কোটায় নিয়োগ পাওয়া ১৪৮ জনের তথ্য পাঠানো হয়েছে। এই তালিকা যাচাই-বাছাইয়ের পর প্রথম দফায় মাত্র তিনজনের গেজেট নম্বর এমআইএসের সঙ্গে সঠিক বলে প্রমাণিত। অন্য সবার উল্লিখিত গেজেট নম্বর ভুল অথবা অসম্পূর্ণ। কেউ কেউ জালিয়াতি করেছেন বলে ধারণা সংশ্লিষ্টদের। এ পর্যায়ে ব্যাংকের সংশ্লিষ্টদের কাছে ফের পূর্ণাঙ্গ তথ্য চেয়েছে মন্ত্রণালয়।
জানা গেছে, ২০১১ থেকে ২০২৩ সাল পর্যন্ত বিভিন্ন সময়ে মুক্তিযোদ্ধার কোটায় তারা চাকরি নিয়েছেন। প্রথম, দ্বিতীয় ও তৃতীয় শ্রেণিতে নিয়োগ পাওয়াদের কেউ কেউ এখন সহকারী মহাব্যবস্থাপক, সিনিয়র প্রিন্সিপাল অফিসার, প্রিন্সিপাল অফিসার, সিনিয়র অফিসার, অফিসার, সহকারী অফিসার ও ডেটা এন্ট্রি অফিসার পদেও পদোন্নতি পেয়েছেন।
পরিচয় প্রকাশে অনিচ্ছুক মন্ত্রণালয়ের সংশ্লিষ্ট এক কর্মকর্তা সমকালকে বলেন, গেজেট নম্বর মেলানোর অনেক ধাপ রয়েছে। এমআইএসে যদি কারও নম্বর না মেলে বা না থাকে, সে ক্ষেত্রে সঠিকতা যাচাইয়ের জন্য আগের গেজেটগুলো অধিকাংশ ক্ষেত্রে মেলানোর চেষ্টা করা হয়।
মুক্তিযোদ্ধাদের গেজেটভুক্তির প্রাথমিক ধাপ অর্থাৎ সামরিক, বেসামরিক, লাল মুক্তিবার্তা, ভারতীয় তালিকায় সংশ্লিষ্ট ব্যক্তির নাম রয়েছে কিনা, সেটা যাচাই করা হয়। কিন্তু দেখা গেছে, ব্যাংকটির পাঠানো কর্মকর্তাদের দেওয়া মুক্তিযোদ্ধাদের নাম বা গেজেট নম্বর কোথাও নেই। এ বিষয়ে মন্ত্রণালয়ের সভায় পরবর্তী সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে।
জানতে চাওয়া হলে কর্মসংস্থান ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক অরুণ কুমার চৌধুরী সমকালকে বলেন, মুক্তিযোদ্ধা কোটার সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের বিষয়ে দ্বিতীয় দফা মন্ত্রণালয়ের চাহিত তথ্যাদি পাঠানো হয়েছে। এ বিষয়ে সরকারের সিদ্ধান্ত অনুসারে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।
কার্যকর যেভাবে
জানা গেছে, চাকরিরতদের তথ্যাদি যাচাই-বাছাইয়ের পর বিশদ প্রতিবেদন তৈরি করবে মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয়। এতে যারা জালিয়াতি করে নিয়োগ পেয়েছেন বলে প্রমাণিত হবেন, তাদের বিষয়টি সরকারের নীতিনির্ধারণী সিদ্ধান্তের বিষয়। এ জন্য প্রতিবেদনটি অনুমোদনের জন্য অন্তর্বর্তী সরকারের উপদেষ্টা পরিষদের বৈঠকে উপস্থাপন করা হবে। বৈঠকে যারা ভুয়া সনদ দেখিয়ে চাকরি নিয়েছেন; চাকরিচ্যুতির পাশাপাশি তাদের দেওয়া বেতন-ভাতা ফেরত নেওয়া এবং প্রতারণার দায়ে তাদের বিরুদ্ধে মামলার করা হবে কিনা– এসব বিষয়ে সিদ্ধান্ত চাওয়া হবে।
মন্ত্রণালয় ও জামুকায় জালিয়াতির অভিযোগ
আইন অনুযায়ী মুক্তিযোদ্ধাদের গেজেটভুক্তিসহ যাচাই-বাছাই সংশ্লিষ্ট কার্যক্রম সম্পন্ন করে মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয় ও জাতীয় মুক্তিযোদ্ধা কাউন্সিল (জামুকা)। এবার এ দুই প্রতিষ্ঠানের দুই কর্মকর্তার বিরুদ্ধেই মুক্তিযোদ্ধা কোটায় তথ্য গোপন করে চাকরি নেওয়ার অভিযোগ উঠেছে। তারা হলেন– জামুকার সহকারী পরিচালক মোছা. জেসমিন আক্তার ও মন্ত্রণালয়ের প্রশাসনিক কর্মকর্তা মেহেনাজ তাবাসসুম। জেসমিন আক্তারের বিরুদ্ধে অভিযোগ, তাঁর বাবা মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে গেজেটভুক্তির আগেই তিনি মুক্তিযোদ্ধা কোটায় জামুকায় চাকরি নিয়েছেন।
অন্যদিকে মেহেনাজের বিরুদ্ধে তথ্য গোপন করে চাকরি নেওয়ার অভিযোগ রয়েছে। সম্প্রতি জামুকার ৯৪তম সভায় তাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ তদন্তের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে।
এ প্রসঙ্গে মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক উপদেষ্টা ফারুক-ই-আজম সমকালকে বলেন, মুক্তিযোদ্ধা কোটায় চাকরিরতদের তথ্যাদি যাচাই-বাছাই চলছে। সংখ্যা অনেক। প্রায় ৯০ হাজার। ইতোমধ্যে প্রায় ৪০ হাজার কর্মকর্তা-কর্মচারীর যাচাই সম্পন্ন হয়েছে। এ প্রক্রিয়া সম্পন্ন হলে মুক্তিযোদ্ধা কোটায় জালিয়াতি করে কেউ যদি চাকরিরত থাকেন, তাঁর বিরুদ্ধে বিধি অনুযায়ী শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
যাচাই-বাছাইয়ে সংকট প্রসঙ্গে উপদেষ্টা বলেন, ‘সংকট তো আছেই। অনেক মুক্তিযোদ্ধার গেজেট বিভিন্ন সময়ে বাতিল হয়েছে। অথচ সেই গেজেটের আলোকে যারা চাকরি নিয়েছেন, তাদের চাকরি রয়ে গেছে। একেকজনের একেক ধরনের সমস্যা চিহ্নিত হচ্ছে। এ জন্য যাচাই-বাছাই সম্পন্ন হওয়ার পর যেগুলো নিয়ে সমস্যা চিহ্নিত হবে, সেগুলোর বিষয়ে ‘কেস টু কেস’ পর্যালোচনা করে সিদ্ধান্ত নেব। সেখানে যদি দেখা যায়, কারও প্রতি অতীতে অন্যায় হয়েছে, আমরা সেগুলোও বিবেচনা করব।’