Image description

মোহাম্মদ শাহজাহান

 

রাজধানীর আবাসিক এলাকা, বিপণিবিতান ও মার্কেটগুলোয় আইনশৃঙ্খলা নিয়ন্ত্রণের কাজে ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের (ডিএমপি) সহায়ক হিসেবে বেসরকারি নিরাপত্তা কর্মীদের ‘অক্সিলারি পুলিশ ফোর্স’ হিসেবে নিয়োগের বিষয়টি আলোচনায় এসেছে সম্প্রতি। ডিএমপির তরফ থেকে জানানো হয়েছে, এরা ‘সহায়ক পুলিশ কর্মকর্তা’ হিসেবে ডিএমপির নিয়মিত কর্মকর্তাদের মতো মামলা তদন্তের দায়িত্ব বাদে অন্যসব দায়িত্ব পালন করবেন এবং গ্রেপ্তারের ক্ষমতা ও আইনগত সুরক্ষা পাবেন।

 

দেশে নিয়মিত বাহিনীর পাশাপাশি সহায়ক পুলিশ বাহিনীর এই কার্যক্রম নতুন। বিশেষত, গ্রেপ্তারের ক্ষমতা ও আইনগত সুরক্ষার বিষয়টি বিশদ আলোচনার দাবি রাখে। ডিএমপি পরিচালিত হয় ১৯৭৬ সালের ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশ অধ্যাদেশ দ্বারা। এই অধ্যাদেশে পুলিশ কর্মকর্তার সংজ্ঞার আওতায় ‘অক্সিলারি পুলিশ অফিসার’ তথা সহায়ক পুলিশ কর্মকর্তাও অন্তর্ভুক্ত।

 

এই কর্মকর্তাদের নিয়োগের বিধান বর্ণিত আছে অধ্যাদেশের ১০ নম্বর ধারায়। এই ধারাটির মর্ম হলো, প্রয়োজনবোধে পুলিশ কমিশনার নিয়মিত বাহিনীর সহায়তার উদ্দেশ্যে যেকোনো ব্যক্তিকে সহায়ক পুলিশ কর্মকর্তা হিসেবে নিয়োগ করতে পারবেন এবং নিয়োগকৃত এসব সহায়ক কর্মকর্তা ডিএমপির অন্য যেকোনো কর্মকর্তার সমান ক্ষমতা ও দায়মুক্তি পাবেন। তারা একই ধরনের দায়িত্ব পালন ও একই কর্তৃপক্ষের অধীন হবেন।

 

বিশেষভাবে লক্ষণীয় বিষয় হলো, আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি বিবেচনায় সহায়ক পুলিশ কর্মকর্তা নিয়োগে পুলিশ কমিশনারকে ওই অধ্যাদেশে ক্ষমতা দেওয়া থাকলেও এই ক্ষমতা প্রয়োগে যথেষ্ট সতর্কতা অবলম্বন করা সমীচীন হবে। এক্ষেত্রে অধ্যাদেশের ওই ধারাটি আক্ষরিক অর্থে গ্রহণ করা ভুল হবে। ফলে চাইলেই যেকোনো ব্যক্তিকে ওই পদে নিয়োগ করা যাবে না। নিয়োগের জন্য পূর্বশর্ত হিসেবে নিয়মিত বাহিনীর কর্মকর্তাদের নিয়োগকালে চাহিত ন্যূনতম শিক্ষাগত ও শারীরিক যোগ্যতার সমান যোগ্যতা এবং প্রয়োজনীয় প্রশিক্ষণের কথা বিবেচনায় নিতে হবে।

 

গ্রেপ্তারের ক্ষমতা কোনো হেলাফেলার বিষয় নয়, এর সঙ্গে নাগরিকদের সাংবিধানিক ও আইনি অধিকারের মতো গুরুত্বপূর্ণ দিক জড়িত। গ্রেপ্তার নিয়ে পুলিশের আইন লঙ্ঘন ও নাগরিক অধিকার হরণের ঘটনা এত ব্যাপক যে, এ নিয়ে কম বিতর্ক হয়নি এদেশের উচ্চ আদালতে। সর্বশেষ বাংলাদেশ বনাম ব্লাস্ট [৬৯ ডিএলআর (এডি) ৬৩] মামলায় গ্রেপ্তারের ক্ষেত্রে পুলিশসহ অন্যান্য বাহিনীর সদস্যদের অবশ্য পালনীয় গাইডলাইন জারি করে এই বিতর্কের খানিকটা সুরাহা করেছে বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগ।

 

গ্রেপ্তারের ক্ষমতা প্রয়োগের ক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট পুলিশ কর্মকর্তাদের ফৌজদারি কার্যবিধি, পুলিশ রেগুলেশন ও উচ্চ আদালতের আইনি ব্যাখ্যা সম্পর্কে সম্যক ধারণা ও প্রশিক্ষণ থাকা জরুরি। নিয়মিত পুলিশ বাহিনীর প্রশিক্ষিত কর্মকর্তাদের নিয়েই যখন অদক্ষতা, দুর্নীতি ও গ্রেপ্তার-বাণিজ্যের অভিযোগের শেষ নেই, সেখানে গ্রেপ্তারের ক্ষমতাসহ বিপণিবিতানের নিরাপত্তা কর্মীদের ঢালাওভাবে সহায়ক পুলিশ কর্মকর্তা হিসেবে নিয়োগ কাঙ্ক্ষিত কোনো সুফল বয়ে আনবে বলে মনে হয় না, বরং এতে পুলিশের ক্ষমতার অপব্যবহারে জনগণের ভোগান্তি আরও বাড়তে পারে বলেই আশঙ্কা।

 

তদুপরি এই অধ্যাদেশের ধারা ১০৫ এ বর্ণিত দায়মুক্তির বিষয়টিও বেশ উদ্বেগের। এই ধারামতে, এই অধ্যাদেশের বা অন্য কোনো আইনের বিধান, আদেশ, নির্দেশ অনুযায়ী ও প্রদত্ত কর্তৃত্ববলে সরল বিশ্বাসে কৃত কোনো কাজের কারণে পুলিশ কর্মকর্তাদের অর্থাৎ সহায়ক পুলিশ কর্মকর্তা পদবির এই নিরাপত্তা কর্মীদের কোনো ধরনের শাস্তি দেওয়া যাবে না। এমনকি ক্ষতিপূরণ প্রদানেও বাধ্য করা যাবে না তাদের।

 

পরিতাপের বিষয় হলো, ‘সরল বিশ্বাস’-এর আড়ালে এমন নিঃশর্ত সুরক্ষা বা দায়মুক্তি দেওয়া হলেও এই আইনে তো নয়ই, দেশের অন্য কোনো আইনেও ‘সরল বিশ্বাস’-এর কোনো সংজ্ঞা বা ব্যাখ্যা দেওয়া নেই। দেশে দায়মুক্তির এই সংস্কৃতির ফলে পুলিশ বাহিনীসহ অন্য বাহিনীগুলো কতটা হিংস্র ও বর্বর হয়ে ওঠে, তা জুলাই গণহত্যা নিয়ে জাতিসংঘের সাম্প্রতিক প্রতিবেদনেও উঠে এসেছে।

 

আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির নিয়ন্ত্রণে ও উন্নয়নে অপারেশন ডেভিল হান্ট চলমান রয়েছে। ৫ আগস্টের পরে পুলিশের বেশিরভাগ সদস্য কাজে যোগ দিয়েছেন। বিভিন্ন কারণে খানিকটা নিষ্ক্রিয়তা থাকলেও তারা কাজ করছেন। এ অবস্থায় নিয়মিত পুলিশ বাহিনীর সদস্যদের পুরোপুরি সক্রিয় করে তোলার ব্যবস্থা গ্রহণ না করে গ্রেপ্তারের মতো গুরুতর পুলিশি ক্ষমতা বেসরকারি নিরাপত্তা কর্মীদের না দেওয়াই যুক্তিসংগত।

 

লেখক : আইনজীবী, বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্ট