
সেই হিসাবে ৩২ বছর ধরে সেতুটিতে টোল দিয়ে আসছে বিভিন্ন যানবাহন । ময়মনসিংহে ব্রহ্মপুত্র নদের ওপর নির্মিত শম্ভুগঞ্জ সেতু থেকে টোল আদায় করা হচ্ছে ১৯৯২ সাল থেকে । ৭২ কোটি টাকা ব্যয়ে নির্মিত সেতুটি এরই মধ্যে নির্মাণ ব্যয়ের টাকা তুলে ফেলেছে । এরপরও তিন বছর পরপর সেতুটি ইজারা দেওয়া হচ্ছিল । কিন্তু স্থানীয় নাগরিকেরা টোল আদায় বন্ধের দাবি জানিয়ে আসছিলেন । শেখ হাসিনার পতনের পর ছাত্র - জনতার দাবির পরিপ্রেক্ষিতে সেই সেতুর টোল আদায় বন্ধ করে দেন বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের নেতা - কর্মীরা । এরপর গত ফেব্রুয়ারিতে সেতুটির টোল বক্সটি গুঁড়িয়ে দেন তাঁরা । টোল আদায় বন্ধ থাকা অন্য সেতুগুলোর মধ্যে ২০০০ সাল থেকে রফিক উদ্দিন ভূঁইয়া সেতু , ২০০৫ সালে টোল তোলা হচ্ছে তুলসীখালী মরিচা , শহীদ মাসুদ রুমি , তৈলারদ্বীপ এবং চাঁদপুর সেতু থেকে , ২০১৮ সাল থেকে বানার সেতু এবং ধরলা সেতু থেকে টোল আদায় করা হচ্ছিল । ৫ আগস্টের পর স্থানীয়দের বাধার মুখে সেতুর নির্ধারিত টোল তুলতে পারছে না সড়ক ও জনপথ অধিদপ্তর ( সওজ ) ।
জানা গেছে , সরকার পতনের পর এসব সেতুর টোল আদায়ের সঙ্গে যুক্ত অনেক ঠিকাদার পালিয়ে গেছেন । কিছু জায়গায় টোল বুথ ভাঙচুর করা হয়েছে । স্থানীয় জনগণ টোল আদায়ে বাধা দিচ্ছেন । একই সঙ্গে জেলার পরিবহনশ্রমিক সংগঠনের নেতারাও টোল আদায় করতে গেলে বাধা প্রদান করছেন । টোল আদায়ের কাজ নিতে চান রাজনৈতিক প্রভাবশালীরা । ফলে সংশ্লিষ্ট জেলার সড়ক বিভাগ অফিস থেকে টোল আদায়ে অপারগতার কথা জানিয়েছে সড়ক জনপথ অধিদপ্তরে ।
কেন সেতুতে টোল আদায় হচ্ছে না , এ বিষয়ে জানতে চাইলে ৫ মার্চ সড়ক পরিবহন ও সেতু মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা মুহাম্মদ ফাওজুল কবির খান আজকের পত্রিকাকে বলেন ,‘ পলিটিক্যাল চাঁদাবাজদের খপ্পরে আছে এটা । টোল আদায় হচ্ছে না ঠিকই , কিন্তু চাঁদাবাজরা চাঁদা ঠিকই তুলছে সেতু থেকে । এগুলো আমাদের নজরে আছে এবং দেখছি কী করা যায় । ' সড়ক ও জনপথ অধিদপ্তরের টোল শাখার কর্মকর্তারা জানিয়েছেন , ‘ সড়ক পরিবহন ও মহাসড়ক বিভাগ থেকে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় , অর্থ মন্ত্রণালয় এবং সংশ্লিষ্ট জেলার জেলা প্রশাসকদের চিঠি দেওয়া হয়েছে সেতু থেকে টোল আদায় করার জন্য ।
জেলা প্রশাসককে বলা হয়েছে , স্থানীয় স্টেকহোল্ডারদের সঙ্গে বসে বুঝিয়ে টোল আদায় কার্যক্রম আবার চালু করার জন্য । টোল বন্ধ হয়ে যাওয়া কিছু সেতুতে আদায়ের ঠিকাদার নিয়োগ ছিল । কিছু ঠিকাদার টোল আদায় করার জন্য একটা প্রক্রিয়ার মধ্যে ছিলেন । আর কিছু সেতুতে সওজ বিভাগীয়ভাবে টোলা আদায় করত । এখন টোটালি টোল আদায় করা যাচ্ছে না । ’ সওজ সূত্রে জানা গেছে , সারা দেশে ৬৭ টি সেতু এবং ৪ টি সড়ক থেকে টোল আদায় করে সড়ক ও জনপথ অধিদপ্তর । এসব সেতু থেকে বছরে টোল আদায়ের একটা টার্গেট থাকে সরকারের । ২০২২-২৩ অর্থবছরে টোল আদায়ের টার্গেট ছিল ১৩৫০ কোটি , ২০২৩-২৪ অর্থবছরের টার্গেট ছিল ১২৮৭ কোটি এবং ২০২৪-২৫ চলতি অর্থবছরে এই টার্গেট বাড়িয়ে করা হয় ২ হাজার কোটি টাকা । চলতি অর্থবছরে গত আগস্ট মাস পর্যন্ত ১১ - ১২ শতাংশ টোল আদায় হয়েছে , যা অন্যান্য বছরের এ সময়ের তুলনায় অনেক কম ।
সরকারের আয় বাড়াতে সড়ক ও জনপথ অধিদপ্তরের ওপর চলতি অর্থবছরে ২ হাজার কোটি টাকার টোল আদায়ের টার্গেট চাপিয়ে দেওয়া হয়েছে । সওজের যেসব সেতু আছে , সেখান থেকে এত টাকা টোল তোলা কখনোই সম্ভব নয় । গড়ে ১ হাজার থেকে ১২০০ কোটি টাকার টোল আদায় হতে পারে বলে জানিয়েছেন সওজের রক্ষণাবেক্ষণ বিভাগের কর্মকর্তারা ।
সওজ থেকে সরকারের রাজস্ব আয়ের পথ হলো , সেতুর টোল আদায় । এখান থেকে ৯৫ শতাংশ রাজস্ব সরকার পেয়ে থাকে । এর বাইরে অ্যাপ্রোচ রোড এবং পরীক্ষাগারে বিভিন্ন টেস্ট বাবদ ঠিকাদারদের কাছ থেকে কিছু রাজস্ব পায় সরকার । এ ছাড়া ৫ আগস্টের পর আনুমানিক ৩০ টি সেতুর টোল আদায় বন্ধ হয়ে গিয়েছিল । সওজ সেগুলো ধীরে ধীরে চালু করতে পেরেছে । তবে এখনো ৯ টি সেতুর টোল চালু করতে পারেনি ।
পরিবহন বিশেষজ্ঞ ও বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের ( বুয়েট ) পুরকৌশল বিভাগের অধ্যাপক এবং বুয়েটের দুর্ঘটনা গবেষণা ইনস্টিটিউটের পরিচালক ড . শামসুল হক আজকের পত্রিকাকে বলেন , ' স্থানীয় পর্যায়ে ভালো কোনো টেন্ডারে ইজারাদার নিয়োগ দেওয়া হয় না । ওই এলাকার মাস্তানরা জোরজবরদস্তি করে টোলের ঠিকাদারি নিয়ে নেয় এবং চাঁদাবাজি করে । সে জন্য মানুষের মধ্যে টোল না দেওয়ার প্রবণতা আছে । টোল ছাড়া গাড়ি ব্যবহার করা যৌক্তিক হবে না । সড়ক ও জনপথ অধিদপ্তরের কোনো কমিটমেন্ট নেই । আমাদের দেশে টোল আদায় শুরু হলে সেটা সারাজীবন চলে এবং এটা একটা চাঁদাবাজির পর্যায়ে চলে যায় । সেই জায়গায় সওজকে অত্যন্ত বিচক্ষণতা এবং পেশাদারত্বের পরিচয় দিতে হবে । ’ সেতুতে কত দিন টোল তুলবে সরকার : সাধারণ মানুষের অভিযোগ রয়েছে , বছরের পর বছর একই সেতুতে টোল দিয়ে যাচ্ছি , তারপরেও কি সেতুর খরচ ওঠে না । এ বিষয়ে সড়ক ও জনপথ অধিদপ্তরের একাধিক কর্মকর্তার সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে , সওজের আওতায় যতগুলো সেতুতে টোল আদায় করা হয় , সেসব সেতু থেকে কত দিন টোল আদায় করা হবে , সরকারের পক্ষ থেকে এ ধরনের সঠিক কোনো নির্দেশনা নেই । কর্মকর্তারা বলছেন , যেহেতু সেতু
থেকে সরকারের রেভিনিউ আসে , ফলে খরচ উঠে গেলেই এটি বন্ধ করে দেওয়া হবে এমন কোনো নিয়ম কোথাও নেই । এ রকম কোনো পরিপত্র বা গাইডলাইন , সড়ক পরিবহন আইন বা টোল আদায় নিতিমালার কোথাও এ ধরনের কোনো কিছু বলা নেই । একটা সেতু থেকে কত বছর টোল আদায় করা হবে , তা নির্ধারিত নেই ।
সরকার কত বছর টোল তুলতে পারে , এ বিষয়ে জানতে চাইলে সড়ক ও জনপথ অধিদপ্তরের প্রধান প্রকৌশলী সৈয়দ মঈনুল হাসান আজকের পত্রিকাকে বলেন , “ সেতুর টোল তোলার বিষয়টি বছরের সঙ্গে কোনো সম্পর্ক নেই । টোল নীতিমালা অনুযায়ী কোন সেতু এবং সড়কের টোল তোলা হবে , সেটা বলা আছে । সেতু হওয়ার পর যাতায়াত সময় কমে যায় । মানুষ একটা সুবিধা পায় , সেটার একটা ভ্যালু তৈরি হয় । ফলে সরকার সেটার একটা চার্জ নেয় । সেতু মেরামত করতে টাকার প্রয়োজন হয় । টোলের টাকা দিয়ে সেটা করা হয় । ফলে টোল নীতিমালা অনুযায়ী সড়ক সেতুগুলোকে সঠিকভাবে রাখার জন্য রাজস্ব আয়ের উৎস হিসেবে সরকার এটা ব্যবহার করে । ’ সাধারণ ৩ পদ্ধতিতে টোল আদায় করা হয় । অপারেশন অ্যান্ড ম্যানেজমেন্ট ( ওঅ্যান্ডএম ) , ইজারা এবং বিভাগীয় । টোল আদায়ে ওঅ্যান্ডএম এবং ইজারা তিন বছরের জন্য দেওয়া হয় । তারপর আবার নবায়ন করা হয় । এই দুই পদ্ধতিতে টোল আদায় না করতে পারলে , সওজ থেকে বিভাগীয়ভাবে নিজেদের লোক দিয়ে আদায় করা হয় । রোড সেফটি ফাউন্ডেশনের নির্বাহী পরিচালক মো . সাইদুর রহমান আজকের পত্রিকাকে বলেন “ অবশ্যই টোল আদায়ের একটা নির্দিষ্ট মেয়াদ থাকতে হবে । মেয়াদের পরও যদি টোল আদায় করা হয় , সেটা আর টোল থাকে না । সেটা চাঁদাবাজির পর্যায়ে চলে যায় । কারণ এটা তো মানুষের পকেট থেকে যাচ্ছে ।