Image description
 

গত ১৯ মার্চ সকালে এক বিশেষ অভিযানের মধ্য দিয়ে ইস্তাম্বুলের মেয়র ও বিরোধী নেতা একরাম ইমামোগলুকে গ্রেপ্তার করে তুর্কি পুলিশ। বামপন্থী রিপাবলিকান পিপলস পার্টির (সিএইচপি) এই নেতার বিরুদ্ধে অপরাধী সংগঠন পরিচালনা, চাঁদাবাজি, দুর্নীতি, ব্যক্তিগত তথ্য চুরি, সরকারি চুক্তি জালিয়াতি এবং কুর্দিস্তান ওয়ার্কার্স পার্টির (পিকেকে) সঙ্গে সংযোগ থাকার অভিযোগ আনা হয়েছে। ইস্তাম্বুলের বাসা থেকে ইমামোগলুকে গ্রেপ্তারের দৃশ্য সরাসরি সম্প্রচার করেছে তুরস্কের টেলিভিশন চ্যানেলগুলো।

এই অভিযানে শুধু ইমামোগলু নন, তাঁর ঘনিষ্ঠ সহযোগী, উচ্চপদস্থ পৌর কর্মকর্তারাসহ শতাধিক ব্যক্তি গ্রেপ্তার হয়েছেন। কিন্তু এই গ্রেপ্তারের ঘটনায় হঠাৎ করেই অশান্ত হয়ে উঠেছে রিসেপ তাইয়েপ এরদোয়ানের দেশ তুরস্ক। গ্রেপ্তারের প্রতিক্রিয়ায় দেশজুড়ে শুরু হয়েছে বিক্ষোভ। এই বিক্ষোভ ধীরে ধীরে এরদোয়ানবিরোধী আন্দোলনে রূপ নিয়েছে বলে মনে করছেন বিশ্লেষকেরা।

বিশ্ববিদ্যালয়পড়ুয়া ছাত্র-ছাত্রী এবং তরুণদের অংশগ্রহণ এই আন্দোলনকে আরও জোরালো করে তুলেছে। নিরাপত্তা বাহিনীগুলো কঠোর হয়েও তাঁদের দমন করতে হিমশিম খাচ্ছে।

তুরস্কের রাজনীতিতে যাঁরা গভীর নজর রাখেন, তাঁদের কাছে ইমামোগলুর গ্রেপ্তার অপ্রত্যাশিত ছিল না। ইস্তাম্বুলসহ দেশজুড়ে জনপ্রিয় হয়ে উঠেছেন তিনি। বর্তমান সরকার তাঁর এই ক্রমবর্ধমান প্রভাবকে বরাবরই হুমকি হিসেবে দেখেছে।

 

২০১৯ সালে ইমামোগলু প্রথমবার ইস্তাম্বুলের মেয়র নির্বাচিত হন। কিন্তু তুরস্কের সুপ্রিম ইলেকশন কাউন্সিল এই নির্বাচন বাতিল করে পুনর্নির্বাচনের নির্দেশ দেয়। তবে পুনর্নির্বাচনে আরও বড় ব্যবধানে জয়ী হন ইমামোগলু। এই বিজয় তাঁকে শুধু ইস্তাম্বুলের মেয়র হিসেবেই নয়, বরং সমগ্র বিরোধী আন্দোলনের প্রতীক হিসেবে প্রতিষ্ঠা করে।

সাম্প্রতিক সময়ে ইমামোগলু নিজেকে প্রেসিডেন্ট এরদোয়ানের প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী হিসেবে গড়ে তুলেছেন। তাঁর দল সিএইচপির প্রধান ওজগুর ওজেল সরকারের বিরুদ্ধে শক্তিশালী প্রতিদ্বন্দ্বীকে দমন করার অভিযোগ তুলেছেন। ডানপন্থী আইওয়াইআই পার্টির নেতা মুসাভাত দারভিশোগলু পার্লামেন্টে বলেছেন, ‘এরদোয়ান যদি আবার নির্বাচন করেন, তাহলে সমগ্র বিরোধীদের নির্বাচন বর্জন করা উচিত।’

চলমান রাজনৈতিক সংকটের ফলে তুর্কি অর্থনীতিও ধাক্কা খেয়েছে। ইমামোগলুর গ্রেপ্তারের খবর প্রকাশের পর তুর্কি লিরার মানে দ্রুত পতন ঘটে এবং ইস্তাম্বুল স্টক এক্সচেঞ্জ প্রায় ৭ শতাংশ কমে যায়।

ইমামোগলুর গ্রেপ্তার এমন এক সময়ে ঘটেছে, যখন আর কয়েক দিনের মধ্যেই তাঁর দল সিএইচপির সম্মেলন অনুষ্ঠিত হওয়ার কথা ছিল। আশা করা হচ্ছিল, এই সম্মেলনেই তিনি আনুষ্ঠানিকভাবে ২০২৮ সালের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের জন্য বিরোধী দলের মনোনয়ন পাবেন। এ অবস্থায় তাঁকে রাজনীতি থেকে দূরে সরিয়ে দেওয়ার জন্যই গুরুতর অভিযোগগুলো আনা হয়েছে বলে মনে করছেন বিরোধীরা। এর আগে, ২০২২ সালেও ইমামোগলুকে দুই বছর সাত মাসের কারাদণ্ড দেওয়া হয়েছিল এবং রাজনৈতিক নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হয়েছিল।

এরদোয়ান কি ভুল করছেন

ইমামোগলু ঐতিহ্যগতভাবে সিএইচপির ধর্মনিরপেক্ষ ভোটারদের মধ্যে জনপ্রিয় হলেও তাঁর ধর্মীয় রীতিনীতি মেনে চলার কারণে রক্ষণশীলদের মধ্যেও গ্রহণযোগ্যতা রয়েছে। কুর্দি সম্প্রদায়ের মধ্যেও তাঁর সমর্থন রয়েছে, যা তাঁকে আরও শক্তিশালী বিরোধী নেতা হিসেবে প্রতিষ্ঠা করেছে।

বিশ্লেষকেরা মনে করছেন, ইমামোগলুর গ্রেপ্তার তাঁকে সরকার নির্যাতিত নেতা হিসেবে প্রতিষ্ঠা করতে পারে, যা তাঁর জনপ্রিয়তা আরও বাড়িয়ে তুলবে—ঠিক যেমনটি একসময় এরদোয়ানের ক্ষেত্রেও ঘটেছিল।

এরদোয়ান এখন পর্যন্ত এই বিষয়ে প্রকাশ্যে কোনো মন্তব্য করেননি। তবে তাঁর জোটসঙ্গী ন্যাশনালিস্ট মুভমেন্ট পার্টির নেতা আদালতের সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে মানুষের অবস্থানকে ‘রাষ্ট্রবিরোধী ষড়যন্ত্র’ বলে অভিহিত করেছেন।

বিশ্লেষকেরা মনে করছেন, এই গ্রেপ্তার সরকারকে স্বল্প মেয়াদে সুবিধা দিলেও দীর্ঘ মেয়াদে এটি গুরুতর ঝুঁকি সৃষ্টি করতে পারে। অর্থনৈতিক সংকটের মধ্যে একজন জনপ্রিয় বিরোধী নেতাকে দমন করার এই কৌশল তুরস্কের জনগণের মধ্যে আরও অসন্তোষ সৃষ্টি করতে পারে, যা শেষ পর্যন্ত হয়তো এরদোয়ান প্রশাসনের জন্য চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়াবে।