
দোকানের জন্য পাইকারি মালামাল কিনতে গত ১০ মার্চ কেরাণীগঞ্জ যান খিলক্ষেত এলাকার বাসিন্দা মতিন। সন্ধ্যায় ইফতারের পর বুড়িগঙ্গার পাশে দাঁড়িয়ে চটপটি খান। রাতে বাসায় ফিরতেই প্রচণ্ড জ্বর ও শরীরে ব্যথা শুরু হয়। গভীর রাত থেকে টানা পাতলা পায়খানা ও বমি। চিকিৎসক জানান খাদ্যে বিষক্রিয়া হয়েছে। চিকিৎসায় সুস্থ হলেও দুই দিন শয্যাশায়ী থাকতে হয় মতিনকে। জীবন বাঁচাতে যে খাদ্য, ভেজাল-দূষণের কারণে সেই খাদ্যই বিপদের কারণ হয়ে দাঁড়াচ্ছে। বাড়াচ্ছে রোগব্যাধি। তরান্বিত করছে মৃত্যু। খাদ্যের বিশুদ্ধতা রক্ষায় বিভিন্ন সংস্থা রমজানে জোরালো অভিযান শুরুর ঘোষণা দিলেও বাজারে নেই তার প্রভাব। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উচ্চতর বিজ্ঞান গবেষণা কেন্দ্রের ড. মুহাম্মদ লতিফুল বারী গত বছর ঢাকার ২৫টি জায়গা থেকে রাস্তার পাশের চটপটি, ছোলামুড়ি, স্যান্ডউইচ, আখের রস, অ্যালোভেরা সরবত ও রেস্তোরাঁর সালাদের নমুনা পরীক্ষা করে প্রত্যেকটিতে প্রাণঘাতী রোগ সৃষ্টিকারী বিভিন্ন ব্যাকটেরিয়া ও ছত্রাকের বিপজ্জনক মাত্রায় উপস্থিতি পান।
প্যাকেটজাত বা প্যাকেটহীন- কোনো খাবারই নিরাপদ নয়। অস্বাস্থ্যকর পরিবেশে খাদ্য তৈরি ও সংরক্ষণ ছাড়াও মেশানো হচ্ছে ক্ষতিকর রাসায়নিক ও রং। বাজারের বিক্রি হওয়া প্যাকেটজাত খাদ্যপণ্যের বড় অংশেরই নেই বিএসটিআইয়ের (বাংলাদেশ স্ট্যান্ডার্ডস অ্যান্ড টেস্টিং ইনস্টিটিউশন) অনুমোদন। অনুমোদন ছাড়াই আবার অনেকে বিএসটিআই লোগো ব্যবহার করছে। আবার যাদের অনুমোদন রয়েছে, তারা পরবর্তীতে খাবারের মান ঠিক রাখছে কি না তা যাচাই হচ্ছে না। রাস্তার পাশে উন্মুক্ত অবস্থায় বিক্রি হচ্ছে ইফতারসামগ্রী। খাবারের ওপরে ভন ভন করে উড়ছে মাছি, পড়ছে রাস্তার ধুলোবালি। প্যাকেটজাত বিভিন্ন কেকের মেয়াদ দেওয়া হচ্ছে ৪-৫ মাস। পাউরুটির মেয়াদ দেওয়া থাকছে ৫-৬ দিন। এতে ক্ষতিকর ছত্রাকের বসতবাড়ি তৈরি হচ্ছে। পুরনো পাউরুটি ফেরত নিয়ে সেগুলো ময়দার সঙ্গে মিশিয়ে ফের তৈরি হচ্ছে নতুন পাউরুটি। দিনের পর দিন অনেকটা প্রকাশ্যে এসব অপকর্ম চললেও দেখার কেউ নেই।
রাজধানীর অনেক এলাকায় খোঁজ নিয়ে দেখা গেছে, গত পাঁচ বছরেও সেখানে কোনো অভিযান চলেনি। সম্প্রতি বাজারে আসা বিভিন্ন ব্র্যান্ডের ইলেকট্রোলাইট ড্রিংসের অধিকাংশেই নেই বিএসটিআই লোগো। ছোট-বড় সবার পছন্দে থাকা ইলেকট্রোলাইট ড্রিংসের নাম নেই বিএসটিআইয়ের লাইসেন্স নেওয়া বাধ্যতামূলক ২৯৯টি পণ্যের তালিকায়। এ ব্যাপারে জানতে চাইলে বিএসটিআইয়ের পরিচালক (সিএম) মো. সাইফুল ইসলাম বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, ‘নতুন করে ১৬ পণ্য বাধ্যতামূলক তালিকায় যুক্ত করতে প্রস্তাব পাঠানো হয়েছে। শিগগিরই এ ব্যাপারে এসআরও জারি হবে। এর পরে অভিযানে নামব।’ তবে অনুমোদন ছাড়াই বাজার ছেয়ে গেছে পণ্যটিতে। এ ছাড়া গবেষণায় বাংলাদেশে দুধ ও দুগ্ধজাত পণ্যে ক্ষতিকর ফরমালিন, ডিটারজেন্ট ও হাইড্রোজেন পারক্সাইডের উপস্থিতি পাওয়া গেছে। অপরিপক্ব ফল পাকাতে ব্যবহার করা হচ্ছে ক্যালসিয়াম কার্বাইড ও ইথোফেন নামক রাসায়নিক। ফরমালিন, অ্যামোনিয়া এবং অন্যান্য রাসায়নিক ব্যবহার করে মাছ ও মাংস সংরক্ষণ করা হচ্ছে। হলুদ, মরিচ ও ধনে গুঁড়ায় সিসা ও কাপড়ের রং মেশানো হচ্ছে। মিষ্টি, কেক ও বিস্কুটে কাপড়ের রং এবং অতিরিক্ত সোডিয়াম বেনজয়েট ব্যবহার করা হচ্ছে। আটায় মেশানো হচ্ছে চক পাউডার। হরমোন প্রয়োগ করে দ্রুত বড় করা হচ্ছে আনারস, কলাসহ বিভিন্ন ফল। বিশেষজ্ঞদের মতে, খাদ্যে ভেজালের কারণে বাংলাদেশে ক্যান্সার, কিডনি রোগ, লিভারের সমস্যা, পেটের অসুখ, অ্যালার্জি, ডায়াবেটিস এবং শিশুদের মধ্যে অপুষ্টির হার আশঙ্কাজনক হারে বাড়ছে। জনস্বাস্থ্য ইনস্টিটিউটের গবেষণা অনুযায়ী, দেশে ক্যান্সার রোগীর সংখ্যা দ্রুত বাড়ছে, যার অন্যতম কারণ খাদ্যে রাসায়নিক দূষণ।
এ ব্যাপারে নিরাপদ খাদ্য কর্তৃপক্ষের চেয়ারম্যান জাকারিয়া বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, আমরা অন্য বছরের চেয়ে এ বছর বাজার মনিটরিং বাড়িয়েছি। প্রতিদিন অভিযান চলছে। তবে ভোক্তাকেও সচেতন হতে হবে। তারা যেন পণ্য কেনার আগে সবকিছু যাচাইবাছাই করে কেনে।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার তথ্যমতে, প্রতি বছর বিশ্বের প্রায় ৬০ কোটি মানুষ ভেজাল ও দূষিত খাদ্য গ্রহণের কারণে অসুস্থ হয়। মারা যায় ৪ লাখ ৪২ হাজার মানুষ। পরিবেশ বাঁচাও আন্দোলনের (পবা) এক গবেষণা প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, শুধু ভেজাল খাদ্য গ্রহণের কারণে প্রতি বছর দেশে ৩ লাখ লোক ক্যান্সারে, ২ লাখ লোক কিডনি রোগে, দেড় লাখ লোক ডায়াবেটিসে আক্রান্ত হচ্ছে। ১৫ লাখ বিকলাঙ্গ শিশুর জন্ম হচ্ছে। ভেজাল খাদ্য গ্রহণের ফলে দেশে হেপাটাইটিস, কিডনি, লিভার ও ফুসফুস সংক্রমিত রোগীর সংখ্যাও দিন দিন বাড়ছে।