Image description

বাংলাদেশের সামুদ্রিক জলসীমায় মাছ ধরার নিষেধাজ্ঞার সময়সীমা পুনর্বিন্যাস করেছে সরকার। মাছের সুষ্ঠু প্রজনন ও উৎপাদন, সামুদ্রিক মৎস্য সম্পদ সংরক্ষণ এবং টেকসই মৎস্য আহরণের লক্ষ্যে পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতের সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে ১৫ এপ্রিল থেকে ১১ জুন পর্যন্ত মোট ৫৮ দিন সকল প্রকার মৎস্য নৌযান কর্তৃক যে কোনো প্রজাতির মৎস্য আহরণ নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হয়েছে। গত রোববার (১৬ মার্চ) এক প্রজ্ঞাপনে এ তথ্য জানিয়েছে মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয় (সামুদ্রিক মৎস্য-২ শাখা)।

প্রজ্ঞাপনে বলা হয়, সামুদ্রিক মৎস্য বিধিমালা, ২০২৩-এর বিধি ৩-এর উপবিধি (১)-এর দফা (ক)-তে প্রদত্ত ক্ষমতাবলে, সরকার বাংলাদেশের সামুদ্রিক জলসীমায় মাছের সুষ্ঠু প্রজনন, উৎপাদন, সামুদ্রিক মৎস্য সম্পদ সংরক্ষণ এবং টেকসই মৎস্য আহরণের জন্য প্রতি বছর ১৫ এপ্রিল থেকে ১১ জুন পর্যন্ত মোট ৫৮ (আটান্ন) দিন সকল প্রকার মৎস্য নৌযান কর্তৃক যেকোনো প্রজাতির মৎস্য আহরণ নিষিদ্ধ ঘোষণা করেছে।

এর আগে, বিগত বছরগুলোর নিষেধাজ্ঞা ২০ মে থেকে ২৩ জুলাই পর্যন্ত ৬৫ দিনের ছিল, যা শুরু থেকেই রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের (রাবি) ফিশারিজ বিভাগের একদল গবেষক বিরোধিতা করে আসছিলেন। পিআইইউ-বিএআরসি এনএটিপি-২ প্রকল্পের আওতায় এবং শেরেবাংলা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় ও বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা কাউন্সিলের (বিএআরসি) সংযুক্ততায় পরিচালিত গবেষণায় প্রমাণিত হয় যে, ২০ মে-২৩ জুলাই পর্যন্ত ৬৫ দিনের নিষেধাজ্ঞার ফলে সামুদ্রিক মাছের উৎপাদন হার কমেছে এবং মাছের প্রজাতির গুণগত মান ও জেলেরা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।

গবেষকদের দাবি ছিল, বাংলাদেশের অর্থনৈতিক সমুদ্রসীমার মধ্যে মাছের প্রজনন ও সামুদ্রিক মৎস্য সম্পদ সংরক্ষণের স্বার্থে উপকূলীয় নদী এবং গভীর সমুদ্র অঞ্চলে এপ্রিলের মাঝামাঝি থেকে জুনের মাঝামাঝি পর্যন্ত সকল ধরনের মাছ আহরণ নিষিদ্ধ করা উচিত। পূর্বের সময়সীমা কমিয়ে ৫৮ দিন নির্ধারণ এবং নিষেধাজ্ঞার সময়সীমা ১৫ এপ্রিল থেকে ১১ জুন পর্যন্ত করায় রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ফিশারিজ বিভাগের অধ্যাপক ও মুখ্য গবেষক ড. ইয়ামিন হোসেন সন্তোষ প্রকাশ করেছেন। 

ড. ইয়ামিন বলেন, এটি আমাদের গবেষণার ফলাফল। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ফিশারিজ বিভাগের জন্য এটি একটি বড় সফলতা। ২০১৯ সালের অক্টোবর থেকে ২০২২ সালের সেপ্টেম্বর পর্যন্ত আমাদের এই গবেষণা পরিচালিত হয়। ২০২২ সালের রিপোর্ট অনুযায়ী, 'বঙ্গোপসাগরে (বাংলাদেশে) বিদ্যমান মৎস্য আহরণ নিষেধাজ্ঞার সময়কাল সংশোধন' শীর্ষক একটি প্রতিবেদন আমরা সরকারের কাছে জমা দিই।

বাংলাদেশে প্রথমবারের মতো মাছের ২২২টি প্রজাতির উপর গবেষণা করে ২০২২ সালেই প্রমাণিত হয় যে মধ্য এপ্রিল থেকে মধ্য জুন পর্যন্ত মাছের সর্বোচ্চ প্রজনন মৌসুম। এতে মুখ্য গবেষক ছিলেন শেরেবাংলা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের ড. কাজী আহসান হাবীব এবং রাবির সহগবেষক ড. মো. তারিকুল ইসলাম। গবেষণায় সহকারী হিসেবে মোসা. শাকিলা সারমিন ও মো. আশেকুর রহমান কাজ করেন।

গবেষকরা বলেন, ২০১২ সালে মিয়ানমার এবং ২০১৪ সালে ভারতের সঙ্গে সমুদ্রসীমা বিরোধ নিষ্পত্তির পর বাংলাদেশের সমুদ্রসীমায় নতুন করে ১,১৮,৮১৩ বর্গকিলোমিটার এলাকা যুক্ত হয়। ফলে নিষেধাজ্ঞাসহ নানা উদ্যোগ বাস্তবায়নে সাগরে মাছের আহরণ বেড়েছে। তবে দীর্ঘদিনের ৬৫ দিনের নিষেধাজ্ঞার ফলে মৎস্য উৎপাদন ও গুণগত মানের ক্ষতি হয়েছে, যা জলবায়ু পরিবর্তন, পরিবেশ ও বাস্তুতন্ত্রের ভারসাম্যহীনতা এবং অতিরিক্ত মৎস্য আহরণের কারণেও হয়েছে। প্রজাতি বিলুপ্তির আগেই সংরক্ষণ জরুরি, তাই বঙ্গোপসাগরে মৎস্য আহরণ নিষেধাজ্ঞার সময়কাল সংশোধনের সুপারিশ করেন তারা।

গবেষণার মুখ্য গবেষক শেরেবাংলা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ড. কাজী আহসান হাবীব বলেন, এটি আমাদের মৎস্য বিজ্ঞানীদের দীর্ঘদিনের দাবি ছিল, যা অবশেষে বাস্তবায়িত হলো। মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয়, মৎস্য অধিদপ্তর এবং বাংলাদেশ সরকারকে এ গুরুত্বপূর্ণ উদ্যোগ গ্রহণের জন্য আন্তরিক ধন্যবাদ ও কৃতজ্ঞতা। এতদিন ৬৫ দিনের নিষেধাজ্ঞায় বাংলাদেশ ও ভারতের ব্যানিং পিরিয়ড ভিন্ন হওয়ায়, ভারতের মাছ ধরার ট্রলার আমাদের নিষেধাজ্ঞার সময় অবাধে মাছ ধরে নিয়ে যেত। এতে আমাদের জেলেদের মধ্যে চরম হতাশা ও ক্ষোভ তৈরি হয়েছিল। নতুন এই সিদ্ধান্ত আমাদের সামুদ্রিক মৎস্য সম্পদ রক্ষায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে।

তিনি আরও বলেন, ২০১৯-২২ সালে বিএআরসি-এর অর্থায়নে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় ও শেরেবাংলা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের এক গবেষণায় গুরুত্বপূর্ণ সামুদ্রিক মাছের স্টক অ্যাসেসমেন্ট করা হয়। গবেষণায় নিজেদের ডাটা ও অন্যান্য প্রতিষ্ঠানের তথ্য বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, ব্যানিং পিরিয়ড কিছুটা এগিয়ে আনলে স্টকের ক্ষতি না হয়ে বরং দেশের মৎস্য সম্পদ রক্ষা পাবে। গবেষণা ফলাফল ও সুপারিশ ওয়ার্ল্ড ব্যাংক, মৎস্য অধিদপ্তর ও বিজ্ঞানীদের সামনে উপস্থাপন করা হয় এবং সংশ্লিষ্ট দপ্তরগুলোতে পাঠানো হয়। সরকারের প্রজ্ঞাপন দেখে গবেষণা পরিচালক অধ্যাপক ড. মো. ইয়ামিন হোসেন ও আমি অত্যন্ত আনন্দিত। সংশ্লিষ্ট সকলকে ধন্যবাদ।

এ সফলতায় মুখ্য গবেষক রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ফিশারিজ বিভাগের অধ্যাপক ড. ইয়ামিন হোসেন বলেন, বাংলাদেশ সরকার, মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয় এবং মৎস্য অধিদপ্তরের প্রতি গভীর কৃতজ্ঞতা। বঙ্গোপসাগরে মৎস্যসম্পদ সংরক্ষণে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়, শেরেবাংলা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় এবং বিএআরসি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে। বিশ্বব্যাংকের অর্থায়নে পরিচালিত (BARC-NATP-2 PBRG-156) প্রকল্পের ফলাফলের ভিত্তিতেই আমরা সুপারিশ করেছিলাম যে মধ্য এপ্রিল থেকে মধ্য জুন পর্যন্ত প্রতি বছর বঙ্গোপসাগরে মাছ ধরা নিষিদ্ধ করা উচিত। আলহামদুলিল্লাহ, সেটিই বাস্তবায়িত হয়েছে।