
রোহিঙ্গাদের সশস্ত্র সংগঠন আরাকান রোহিঙ্গা স্যালভেশন আর্মির (আরসা) ১০ জনকে নারায়ণগঞ্জের সিদ্ধিরগঞ্জ ও ময়মনসিংহ থেকে গ্রেপ্তার করেছে র্যাব। এর মধ্যে আরসাপ্রধান আতাউল্লাহ ওরফে আবু আম্বার জুনুনী (৪৮) রয়েছেন। তিনি ডিজিএফআইয়ের এক কর্মকর্তা এবং রোহিঙ্গা নেতা মুহিবুল্লাহ হত্যার আসামি।
সীমান্তের একাধিক সূত্র ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর দেওয়া তথ্যমতে, মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যের মংডু টাউনশিপের সিকদারপাড়ায় আতাউল্লাহর বাড়ি। ১৯৬০ সালের দিকে তাঁর বাবা পাকিস্তানের করাচিতে চলে যান। সেখানেই জন্ম আতাউল্লাহর। তিনি পড়াশোনা করেন সৌদি আরবের মক্কায়।
২০১২ সালে আতাউল্লাহ সৌদি আরব থেকে অদৃশ্য হয়ে যান। এরপর আরাকানে নতুন করে সহিংসতা শুরু হওয়ার পর তাঁর নাম শোনা যায়। তিনি ২০১৬ সালের দিকে সশস্ত্র বিদ্রোহী সংগঠন গড়ে তোলেন বলে মনে করা হয়। ওই বছরের অক্টোবরের শুরুতে মিয়ানমারের আরাকান রাজ্যে সে দেশের সীমান্তচৌকিতে হামলা চালান। তাতে দেশটির বেশ কয়েকজন পুলিশ সদস্য নিহত হন। ওই সময় হামলার দায় স্বীকার করে আরসার কমান্ডার আতাউল্লাহ অনলাইনে ভিডিও বার্তা প্রচার করেন। এর পর থেকে আরসা ও আতাউল্লাহ ব্যাপকভাবে আলোচনায় আসে।
এরপর ২০১৭ সালের আগস্টে রাখাইনে নিরাপত্তা বাহিনীর অন্তত ৩০টি চৌকিতে হামলা হয়। ওই হামলার জন্য মিয়ানমারের সামরিক জান্তা সশস্ত্র গোষ্ঠী আরাকান স্যালভেশন আর্মি বা আরসাকে দায়ী করেছিল। সেই পটভূমিতে মিয়ানমারের সেনাবাহিনী রাখাইনে রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর ওপর ব্যাপক আক্রমণ শুরু করে। সেই সময় হত্যা, ধর্ষণ ও নিপীড়ন থেকে বাঁচতে বাংলাদেশে পালিয়ে আসতে বাধ্য হয় আট লাখের বেশি রোহিঙ্গা। পরবর্তী সময়ে আরও অনেক রোহিঙ্গা বাংলাদেশে পালিয়ে আসে।
২০২২ সালের ১৪ নভেম্বর সন্ধ্যায় বান্দরবানের নাইক্ষ্যংছড়ির তুমব্রু সীমান্তের শূন্যরেখার রোহিঙ্গা আশ্রয়শিবিরের কাছে মাদকবিরোধী যৌথ অভিযানের সময়ে সন্ত্রাসীদের গুলিতে নিহত হন ডিজিএফআইয়ের কর্মকর্তা স্কোয়াড্রন লিডার রিজওয়ান রুশদী। ওই হত্যা মামলার অভিযোগপত্রভুক্ত আসামি আরসার প্রধান আতাউল্লাহ।
বাংলাদেশের কক্সবাজারের রোহিঙ্গা আশ্রয়শিবিরে হত্যা, অপহরণসহ বিভিন্ন অপরাধে আরসার সদস্যরা জড়িত বলে এখানকার আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর পক্ষ থেকে বিভিন্ন সময়ে বলা হয়েছে।
২০২২ সালের ১৪ নভেম্বর সন্ধ্যায় বান্দরবানের নাইক্ষ্যংছড়ির তুমব্রু সীমান্তের শূন্যরেখার রোহিঙ্গা আশ্রয়শিবিরের কাছে মাদকবিরোধী যৌথ অভিযানের সময়ে সন্ত্রাসীদের গুলিতে নিহত হন ডিজিএফআইয়ের কর্মকর্তা স্কোয়াড্রন লিডার রিজওয়ান রুশদী। ওই হত্যা মামলার অভিযোগপত্রভুক্ত আসামি আরসার প্রধান আতাউল্লাহ।
এ ছাড়া আলোচিত রোহিঙ্গা নেতা মুহিবুল্লাহ হত্যার আসামি আতাউল্লাহ। তিনি ওই খুনের নির্দেশদাতা ছিলেন বলে আদালতের জবানবন্দিতে জানিয়েছেন ওই মামলায় গ্রেপ্তার চার আসামি। আরাকান রোহিঙ্গা সোসাইটি ফর পিস অ্যান্ড হিউম্যান রাইটসের (এআরএসপিএইচ) চেয়ারম্যান মুহিবুল্লাহকে ২০২১ সালের ২৯ সেপ্টেম্বর রাতে উখিয়ার কুতুপালংয়ে গুলি করে হত্যা করা হয়। ওই ঘটনায় করা মামলায় ২০২২ সালের ১৩ জুন কক্সবাজার সিনিয়র জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে অভিযোগপত্র দাখিল করে পুলিশ। এতে বলা হয়, আরসার প্রধান আতাউল্লাহর নির্দেশে সংগঠনের ৩৬ সদস্য পরিকল্পিতভাবে মুহিবুল্লাহকে গুলি করে হত্যা করেন। বর্তমানে মামলাটি কক্সবাজার জেলা ও দায়রা জজ আদালতে বিচারাধীন।
র্যাব-১৫ কক্সবাজার ব্যাটালিয়নের সদ্য বদলি হওয়া অধিনায়ক লেফটেন্যান্ট কর্নেল এইচ এম সাজ্জাদ হোসেন বলেন, র্যাব গত এক বছরে রোহিঙ্গা আশ্রয়শিবিরে অভিযান চালিয়ে আরসার শীর্ষ সন্ত্রাসী, সামরিক কমান্ডারসহ ১২৫ জনকে গ্রেপ্তার করেছে। এ সময় ৫৮ কেজি বিস্ফোরক দ্রব্য, ৭৮টি দেশি ও বিদেশি অস্ত্র, বিপুল পরিমাণ গ্রেনেড, হ্যান্ড মাইন ও গুলি জব্দ করা হয়েছে। মিয়ানমার সীমান্তে অবস্থান করায় আতাউল্লাহসহ অন্য আসামিদের গ্রেপ্তার করা সম্ভব হয়নি।
পুলিশ, র্যাব ও রোহিঙ্গা নেতাদের দেওয়া তথ্যমতে, গত সাড়ে ৭ বছরে আশ্রয়শিবিরগুলোতে খুন হয়েছেন ২৫২ জন রোহিঙ্গা। এর মধ্যে ২০২৪ সালে আশ্রয়শিবিরগুলোতে ৬৮টি সংঘর্ষ ও গোলাগুলির ঘটনায় অন্তত ৬৭ রোহিঙ্গা নিহত হন। অধিকাংশ খুনের ঘটনা আরসার সঙ্গে আরএসও এবং রোহিঙ্গা সন্ত্রাসী নবী হোসেন বাহিনীর মধ্যে। সংঘর্ষে আরসার ২৭ জন ও আরএসওর ৭ জন নিহত হন। বর্তমানে উখিয়া ও টেকনাফের ৩৩টি আশ্রয়শিবিরে নিবন্ধিত রোহিঙ্গার সংখ্যা ১৩ লাখের বেশি।
গত সাড়ে ৭ বছরে আশ্রয়শিবিরগুলোতে খুন হয়েছেন ২৫২ জন রোহিঙ্গা। এর মধ্যে ২০২৪ সালে আশ্রয়শিবিরগুলোতে ৬৮টি সংঘর্ষ ও গোলাগুলির ঘটনায় অন্তত ৬৭ রোহিঙ্গা নিহত হন।
রোহিঙ্গা নেতারা জানান, ২০১৮ সালের দিকে পুরো আশ্রয়শিবিরের নিয়ন্ত্রণ ছিল আরসার হাতে। সাধারণ রোহিঙ্গারাও আরসাকে নানাভাবে সহযোগিতা দিত। কিন্তু রোহিঙ্গা নেতা মুহিবুল্লাহ হত্যাকাণ্ডে জড়িয়ে বিপাকে পড়ে আরসা। এর ফলে সাধারণ রোহিঙ্গাদের সমর্থন হারাতে থাকে তারা। এরপর আরসা আশ্রয়শিবিরের নিয়ন্ত্রণ ধরে রাখতে নানাভাবে চেষ্টা চালাচ্ছিল। আতাউল্লাহসহ আরসার কয়েকজন শীর্ষ নেতা গ্রেপ্তারের খবরে আশ্রয়শিবিরে থাকা আরসা সন্ত্রাসীদের মনোবল ভেঙে পড়েছে। অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে তারা পালানোর চেষ্টা করছে। অন্যদিকে আরএসওসহ অন্য সন্ত্রাসীরা আরসার সন্ত্রাসীদের পালানো ঠেকাতে তৎপরতা চালাচ্ছে। তাতে আশ্রয়শিবিরে নতুন করে সংঘাত-হানাহানি দেখা দিতে পারে।