
বগুড়া পুলিশ লাইনসে ছিল গোপন বন্দিশালা বা আয়নাঘর। কথিত জঙ্গি ও আওয়ামী বিরোধীদের দমন করতে আটকে রাখা হতো এ বন্দিশালায়, এমনকি সাজানো হতো ক্রসফায়ারের নাটক। এমনই সব চাঞ্চল্যকর তথ্য পেয়ছে গুম কমিশন।
ভুক্তভোগীরা বলছেন, দীর্ঘ সময় নিয়মবহির্ভূতভাবে তাদের সেখানে আটকে রেখে করা হতো নানারকম নির্যাতন।
সময় সংবাদের অনুসন্ধানে উঠে এসেছে চাঞ্চল্যকর সব তথ্য। ২০১৬ সালের ২৮ মে বগুড়ার গাবতলী উপজেলার দাঁড়াইলে বাবার সঙ্গে এশার নামাজ পড়ে মসজিদ থেকে বের হতেই সাদা পোশাকে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা তুলে নেন তুহিন মোল্লাকে।
আটকের পর সবজি ব্যবসায়ী তুহিনকে প্রথমে বগুড়া গোয়েন্দা পুলিশ (ডিবি) ও পরে পুলিশ লাইনসের ইনসার্ভিস ট্রেনিং সেন্টারে থাকা বন্দিশালায় আটকে রাখা হয়। এলাকাবাসীসহ বাবার সামনে থেকে প্রকাশ্যে তুহিনকে তুলে নেয়া হলেও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর পক্ষ থেকে অস্বীকার করা হয় তাকে আটকের ব্যাপারটি । বন্দিশালায় আটক রাখার ১২ দিন পর তুহিনকে সিআইডির কাছে হস্তান্তর করা হয়। তাকে গাইবান্ধার পল্লীচিকিৎসক দিপ্তী হত্যা মামলার সন্দেহভাজন জেএমবি সদস্য হিসেবে উল্লেখ করা হয়।
এজাহারে নাম না থাকা তুহিনকে জিজ্ঞাসাবাদেও জড়িত থাকার প্রমাণ পায়নি সিআইডি। পরদিন ১০ জুন গাইবান্ধার গোবিন্দগঞ্জে কথিত বন্দুকযুদ্ধে নিহত হয় তুহিন।
তুহিনের বাবা বাসেদ মোল্লা আহাজারি করতে করতে বলেন, ‘আমার ছেলেকে ছয় থেকে সাতটি গুলি করা হয়েছিল। যার নামে আগে কখনো মামলা বা অভিযোগ ছিল না ,সে এতটাই কি দুর্ধর্ষ অপরাধী হয়েছিল যে তাকে এমনই নির্মমভাবে হত্যা করতে হয়েছে? মসজিদের সামনে থেকে উঠিয়ে নিয়ে যাওয়ার পর ডিবি পুলিশের একাধিক কর্মকর্তা আমার ছেলেকে পুলিশ লাইনসে বন্দি রাখার বিষয়টি স্বীকার করলেও কেউ সহযোগিতা করেনি। এখন শুধু একটাই চাওয়া আমার ছেলে অপরাধী হয়ে থাকলে তার আইনিভাবে বিচার হতো। তবে বিচারবহির্ভূত এ হত্যাকাণ্ডে জড়িত পুলিশের সবার বিচার দাবি করছি।’
আলোচিত পল্লী চিকিৎসক দিপ্তী হত্যা মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা ও উপ-পরিদর্শক (অব.) আব্দুল হান্নান বলেন, ‘জিজ্ঞাসাবাদে হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে সজীবের জড়িত থাকার কোনো সম্পৃক্ততাই পাইনি। তাকে ২০১৬ সালের ৯ জুন রাতেই জিজ্ঞাসাবাদ শেষে ছেড়ে দিতে বলি। তবে পরদিন কেন তাকে ক্রসফায়ার দেওয়া হলো জানা নেই।’
অভিযোগ আছে, নওগাঁর মান্দার আনোয়ার-রিমা দম্পতিকে একই বছরের ১১ এপ্রিল আটকের পর পুলিশ লাইনসের বন্দিশালায় রাখা হয়। ওইদিনই স্বামী-স্ত্রীকে জিজ্ঞাসাবাদও করা হয় একত্রে। এর চারদিন পর ১৫ এপ্রিল অন্তসত্ত্বা রিমাকে শেরপুরের একটি বিস্ফোরণ মামলায় কারাগারে পাঠানো হয়। চারমাস পর ৪ আগস্ট কারাগারে হাজতি থাকা রিমা বগুড়া শহীদ জিয়াউর রহমান মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে সন্তান প্রসব করেন ও সেই সন্তান সেখানেই চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যায়।
এর ৩ দিন পর রাজশাহীর বাঘমারায় কথিত বন্দুকযুদ্ধে নিহত হন বগুড়ার বন্দিশালায় আটক থাকা আনোয়ার। ৯ বছর পর জেল থেকে বেরিয়ে স্বামী সন্তানের কোনো চিহ্ন পায়নি রিমা। পরিবারের কাছে দেয়া হয়নি একটি মরদেহও।
রিমা আক্তার বলেন, ‘জীবন থেকে যা হারানোর তা হারিয়ে গেছে। তবে আমার নবজাতক সন্তান ও স্বামীর মরদেহ কোথায় দাফন করা হয়েছে, এখন তা জানতে চাই। সেই সঙ্গে যারা অন্যায়ভাবে আমার স্বামীকে ক্রসফায়ারে হত্যা করেছে ও আমাদের সাজানো জীবন তছনছ করেছে তাদের বিচার চাই।’
বগুড়া পুলিশ লাইনসে বন্দিশালা বা আয়নাঘরে আটক ছিলেন এমন একাধিক বন্দি ও পুলিশের একাধিক কর্মকর্তার সঙ্গে কথা বলেছে সময় সংবাদ।
পুলিশ লাইন্সের ইন সার্ভিস ট্রেনিং সেন্টারের প্রথম ও দ্বিতীয় তলায় ২০১৫ সালের মাঝামাঝি থেকে বন্দিশালার কার্যক্রম শুরু হয়। সেখানে বড় বড় হলরুমের মতো কক্ষে বন্দিদের হাতকড়া পরিয়ে আটক রাখা হতো। ২০২০ সালের ১৮ অক্টোবর থেকে ইনসার্ভিস ট্রেনিং সেন্টারে থাকা বন্দিশালার কার্যক্রম সরিয়ে নেওয়া হয় পুলিশ লাইনসের রিজার্ভ অফিসের দ্বিতীয় তলায়। যেখানে সাউন্ডপ্রুফ কাঁচের কক্ষে বন্দিদের রাখা হতো। এ বন্দিশালায় দিনের আলো না ফুটলেও রাতের আঁধারে বন্দিদের নির্যাতনের করুণ আর্তনাদ মিলিয়ে যেত নীরবতার গহ্বরে।
বগুড়ার আয়নাঘরের পুরো কার্যক্রমে মাঠ পর্যায়ে জড়িত ছিল বগুড়া ডিবি পুলিশের ৪ জন এসআই, ২ জন এএসআই ও তিনজন কন্সটেবল। গত ২৮ ফেব্রুয়ারি আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের ৭ সদস্য বগুড়া পুলিশ লাইনস পরিদর্শন করেন। গত ৮ মার্চ গুম কমিশন বগুড়ার সাবেক ৪ পুলিশ কর্মকর্তার বিদেশ ভ্রমণে নিষেধাজ্ঞা দিয়েছে।
তারা হলেন, পুলিশের অতিরিক্ত ডিআইজি আলী আশরাফ ভূঁইয়া, পুলিশ সুপার আরিফুর রহমান মণ্ডল, ওসি জুলহাস রবী ও নূর ই আলম সিদ্দিকী।
গুম সংক্রান্ত তদন্ত কমিশনের সদস্য নূর খান লিটন বলেন, ‘বগুড়া পুলিশ লাইনের গোপন বন্দিশালার বিষয়ে আমাদের কাছে অভিযোগ এসেছে। বিষয়টি নিয়ে আমরা তদন্ত করছি। তবে তদন্তাধীন বিষয়ে কিছু বলা যাচ্ছে না। এর আগে গত ৪ মার্চ এক সংবাদ সম্মেলনে তিনি জানান, সেখানে বিভিন্ন জায়গা থেকে বন্দিদের জিজ্ঞাসাবাদের নামে নির্যাতন করা হতো। এখানে অনেকের মৃত্যুর ঘটনাও ঘটতে পারে।’