
সাবেক রাষ্ট্রপতি আবদুল হামিদ পরিবারের ইচ্ছা পূরণে বিস্তীর্ণ হাওরের বুক ফেঁড়ে কিশোরগঞ্জ জেলার ইটনা-মিঠামইন-অষ্টগ্রাম সড়কটি নির্মাণ করা হয়। ভূপ্রকৃতির নৈসর্গিক সৌন্দর্যবেষ্টিত হাওরে ৯০০ কোটি টাকার এ সড়ক স্থানীয় বাসিন্দাদের কাছে হামিদ পরিবারের ‘প্রমোদ সড়ক’ হিসেবেই পরিচিত। কেউ ডাকেন ‘অলওয়েদার সড়ক’ নামে। পতিত হাসিনা সরকারের শেষদিকে এ সড়কটিকে কেন্দ্র করে পাঁচ হাজার কোটি টাকার আরো একটি প্রকল্প নেওয়া হয়। অন্তর্বর্তী সরকারের গলার কাঁটা এখন এ প্রকল্পটিও। দুটি প্রকল্পের কোনোটিতেই পরিবেশ অধিদপ্তরের ছাড়পত্র নেওয়া হয়নি।
সড়ক পরিবহন ও সেতু মন্ত্রণালয় সূত্র জানিয়েছে, ‘এ সড়কে প্রতিদিন ২৬ হাজার যানবাহন চলাচল করবে, আর টোল বাবদ আয় হবে পদ্মা সেতুর চেয়েও বেশি’Ñ প্রকল্প প্রস্তাবনায় এমন ধারণা দেওয়া হলেও ফলাফল সম্পূর্ণ উল্টো। পরিবেশবিদরা বলেছেন, প্রভাবশালী ও ক্ষমতাধর ব্যক্তি আর কিছু আমলার অতি উৎসাহী এ প্রকল্প দেশের অর্থনীতি, জীববৈচিত্র্য ও পরিবেশের ওপর বড় ধরনের আঘাত। এমন আত্মঘাতী প্রকল্প বিশ্বে আর দ্বিতীয়টি নেই। তারা বলেন, হাওর হচ্ছে দেশের হৃৎপিণ্ড। একটি পরিবারের খায়েশ পূরণে বিগত সরকার এটিকে ধ্বংস করে গেছে।
সড়ক ও জনপথ বিভাগ এবং হাওর ও জলাভূমি উন্নয়ন অধিদপ্তর সূত্র জানিয়েছে, হামিদ পরিবারের প্রমোদ সড়ক হিসেবে খ্যাত এ সড়কটি নির্মাণে দুটি পৃথক প্রকল্প বাস্তবায়নে রাষ্ট্রের অপচয় হয়েছে প্রায় দুই হাজার কোটি টাকা। তবে পরিবেশবিদদের মতে, হাওরের জীববৈচিত্র্য ও কৃষির ক্ষতি হয়েছে আরো কয়েক গুণ বেশি। সড়ক নির্মাণের পর থেকে প্রতি বছর তিন জেলা ডুবছে অকাল বন্যায়। দেশের শস্যভান্ডার হিসেবে খ্যাত এ অঞ্চলের মাটির শ্রেণিতেও এসেছে পরিবর্তন। পাশাপাশি কমেছে বোরো উৎপাদনও। এ সড়ক নির্মাণে আবদুল হামিদ তার রাষ্ট্রপতি পদের সাংবিধানিক এখতিয়ারের অপপ্রয়োগ করেছেন বলেও অভিযোগ সড়ক ও জনপথ বিভাগের।
পরিকল্পনা মন্ত্রণালয় সূত্র জানিয়েছে, সড়কটির ফলে পরিবেশের ওপর সৃষ্ট বিরূপ প্রভাব কমিয়ে আনা, বন্যা নিয়ন্ত্রণ ও কৃষি উৎপাদন বাড়াতে বিগত সরকার হাওর ও জলাভূমি উন্নয়ন অধিদপ্তরের আওতায় আরো প্রায় এক হাজার কোটি টাকার একটি প্রকল্প নিয়েছে।
হাওরের সড়ক প্রকল্প যখন গলার কাঁটা
সড়ক ও জনপথ অধিদপ্তরের প্রায় ৯০০ কোটি টাকা অপচয় ও পরিবেশবিদদের সব আপত্তি ও উদ্বেগকে উপেক্ষা করে সাবেক রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদের স্বেচ্ছাচারিতায় নির্মিত এই ‘প্রমোদ সড়ক’ হাওরের প্রকৃতি ও জীববৈচিত্র্যকে বিপন্ন করেছে। সড়ক পরিবহন ও মহাসড়ক বিভাগের অধীনে সড়ক ও জনপথ অধিদপ্তর এ প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করেছে। রাষ্ট্রপতি আবদুল হামিদ তার সাংবিধানিক ক্ষমতার অপপ্রয়োগ করে সড়ক পরিবহন ও সেতু মন্ত্রণালয়কে চারটি চিঠিও দিয়েছিলেন বলে জানিয়েছেন প্রকল্পটির সঙ্গে যুক্ত মন্ত্রণালয়ের এক কর্মকর্তা।
কিশোরগঞ্জের হাওর উপজেলা ইটনা, মিঠামইন ও অষ্টগ্রামকে যুক্ত করেছে এই ‘অলওয়েদার সড়ক’। প্রায় ৩০ কিলোমিটার দীর্ঘ এ সড়কে গত বছর পহেলা বৈশাখে সৌন্দর্যের নামে আলপনা এঁকে পরিবেশের দ্বিতীয় দফা ক্ষতি করা হয়েছে। রঙের রাসায়নিক পদার্থ বৃষ্টির পানির সঙ্গে ভেসে গিয়ে মিশেছে হাওরের পানিতে। এতে মারাত্মক ক্ষতি হয়েছে হাওরের মৎস্য সম্পদ ও জলজ উদ্ভিদের। অন্তর্বর্তী সরকারের উপদেষ্টারা এটিকে এখন গলার কাঁটা হিসেবে দেখছেন।
সড়কটির বিষয়ে প্রবল আপত্তি ও উদ্বেগ জানিয়ে প্রকাশ্যে বক্তব্যও দিয়েছিলেন হাসিনা সরকারের পরিকল্পনামন্ত্রী এম এ মান্নান। ২০২৩ সালে জাতীয় প্রেস ক্লাবে এক আলোচনা সভায় তিনি বলেন, ‘আমরা হাওরে অপরিকল্পিতভাবে সড়ক নির্মাণ করে নিজেদের পায়ে কুড়াল মেরেছি। এর ক্ষতি কোনোভাবেই পুষিয়ে নেওয়ার মতো নয়। এর ক্ষতি আমাদের বহন করে যেতে হবে। এতে আমাদের উপকারের চেয়ে অপকারই বেশি হয়েছে। এটা এখন আমাদের গলার কাঁটা।’
হাওরের এ ‘গলার কাঁটা’র বিষয়ে সড়ক ও জনপথ বিভাগের ঊর্ধ্বতন এক কর্মকর্তা জানান, এখানে পুরো সড়কটি নির্মাণ করা হয়েছে সাবেক রাষ্ট্রপতি আবদুল হামিদের ইচ্ছা পূরণের প্রকল্প হিসেবে। এ বিষয়ে সড়ক ও জনপথ বিভাগের প্রকল্পের স্থায়িত্ব ও উপযোগিতার বিষয়ে প্রাক যাচাই-বাছাইয়ের কোনো সুযোগ ছিল না। এ সংক্রান্ত কোনো প্রতিবেদনও প্রকল্পের নথিতে নেই বলে জানান তিনি। তবে বুয়েটের একটি টিমকে দিয়ে ২০ কোটি টাকা ব্যয় করে নামকাওয়াস্তে একটি সমীক্ষাপত্র নেওয়া হয়েছিল।
কিশোরগঞ্জের নির্বাহী প্রকৌশলী শাকিল মোহাম্মদ ফয়সাল আমার দেশকে বলেন, ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের নির্দেশে অলওয়েদার সড়কটির পরিবেশগত নানা দিক নিয়ে নতুন করে একটি স্টাডির (পর্যবেক্ষণ) উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে।
সড়ক ও জনপথ বিভাগের এক কর্মকর্তা জানান, কিশোরগঞ্জের অলওয়েদার সড়ক নির্মাণে ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান হিসেবে কাজ করেছে মনিকো লিমিটেড, স্পেকট্রা ইঞ্জিনিয়ার্স লিমিটেড, স্পেকট্রা এমবিএল লিমিটেড ও স্পেকট্রা আরবিএল লিমিটেড।
সাড়ে পাঁচ হাজার কোটি টাকার আত্মঘাতী আরেক প্রকল্প
আত্মঘাতী প্রকল্পের মাধ্যমে হাওরের ব্যাপক ক্ষতির পর কিশোরগঞ্জ জেলার মিঠামইন উপজেলা সদর থেকে করিমগঞ্জ উপজেলার মরিচখালী পর্যন্ত উড়াল সড়ক নির্মাণে পাঁচ হাজার ৬৫১ কোটি টাকার প্রকল্প অনুমোদন দিয়ে যায় শেখ হাসিনার সরকার। এ প্রকল্পটিও কেবল রাষ্ট্রপতি হামিদ পরিবারের আগ্রহে নেওয়া হয় বলে জানিয়েছে সেতু বিভাগের কর্মকর্তারা। কর্মকর্তারা জানান, এ সড়কের সমীক্ষা চালাতেও সেতু বিভাগ ব্যয় করেছে ২০ কোটি টাকা। আর তাতে দেখানো হয়েছে, প্রকল্পটি সেতু কর্তৃপক্ষের জন্য লাভজনক হবে।
সমীক্ষা অনুযায়ী, ২০৩০ সালে প্রতিদিন ২৫ হাজার ৭০৮ যানবাহন চলাচল করবে। বাস চলবে ১ হাজার ৩৮২টি। ২০২৭ সালে প্রতিদিন ১৩ হাজার ২১৭ ও ২০২৩ সালে ১৫ হাজার ১৪২টি মোটরসাইকেল চলবে। তবে পরিবহন মালিক সমিতির দাবি, ব্যস্ততম ঢাকা-চট্টগ্রাম চার লেনের মহাসড়কেও এর অর্ধেক যানবাহন চলাচল করছে না। হাওর এলাকায় এত পরিমাণ যানবাহন কেন চলবে, সেটা তাদেরও মাথায় আসছে না। এর আগের অলওয়েদার সড়কের সমীক্ষায়ও ২৬ হাজার যানবাহন চলবে বলে দেখানো হয়েছিল।
সরেজমিনে দেখা গেছে, অলওয়েদার সড়কটি যানবাহন চলাচলের জন্য খুলে দেওয়ার চার বছর পরও অল্প কিছু মোটরসাইকেল, অটোরিকশা চলতে দেখা যায়। ৫ আগস্ট শেখ হাসিনার পতন ও পলায়নের আগে সাবেক রাষ্ট্রপতি আবদুল হামিদ ও তার পরিবারের লোকজন এবং স্থানীয় সংসদ সদস্যরা গাড়ির বহর নিয়ে এ সড়ক ব্যবহার করে এলাকায় যেতেন। এ ছাড়া তেমন কোনো মোটরগাড়ি এ সড়কে চলতে দেখা যায়নি।
কীসের ভিত্তিতে পরামর্শক প্রতিষ্ঠান যানবাহন চলাচলের এ আগাম তথ্য দিয়েছে, সে বিষয়ে কিছু জানাতে পারছে না সেতু বিভাগ। প্রকল্পটির সঙ্গে যুক্ত সেতু বিভাগের এক কর্মকর্তা জানান, এ প্রকল্পটি নেওয়ার আগে সাবেক রাষ্ট্রপতি চারটি চিঠি দিয়েছিলেন সড়ক পরিবহন ও সেতু মন্ত্রণালয়কে তাগাদা দিয়ে। আবদুল হামিদ ২০২৩ সালের ২৪ এপ্রিল রাষ্ট্রপতির পদ ছাড়েন। এর তিন মাস আগে ১৭ জানুয়ারি শেখ হাসিনার সভাপতিত্বে একনেক সভায় সাড়ে পাঁচ হাজার কোটি টাকার এ প্রকল্প অনুমোদন দেওয়া হয়।
এক পরিবারের প্রমোদ ভ্রমণের উদ্দেশে নেওয়া জাতীয় স্বার্থবিরোধী পাঁচ হাজার কোটি টাকার দ্বিতীয় প্রকল্পটি আর না চালানোর বিষয়ে চিন্তাভাবনা করছে অন্তর্বর্তী সরকার। সড়ক পরিবহন ও সেতু উপদেষ্টা মুহাম্মদ ফাওজুল কবির খান প্রকল্প এলাকা পরিদর্শন শেষে সাংবাদিকদের বলেছেন, ‘এসব প্রকল্প বিগত সরকার সম্পূর্ণ রাজনৈতিক স্বার্থে নিয়েছে। জাতীয় স্বার্থ বিবেচনা করে সরকার এ বিষয়ে পরবর্তী সিদ্ধান্ত নেবে।’
এর আগে পরিকল্পনামন্ত্রী ড. ওয়াহিদউদ্দিন মাহমুদ জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের এক সভা শেষে এ প্রকল্পের বিষয়ে সাংবাদিকদের বলেন, বিগত সরকারের আমলে রাজনৈতিক স্বার্থে নেওয়া মেগা প্রকল্পগুলো বাস্তবায়নের বিষয়ে সরকার যাচাই-বাছাই করবে।
‘ওয়েদার’ ধ্বংস করে ‘অলওয়েদার’ সড়ক
বিগত আওয়ামী লীগ সরকারের প্রকল্প পরিকল্পনায় হাওরের বুক ফেঁড়ে নির্মাণ করা এ সড়কটির নাম দেওয়া হয়েছিল ‘অলওয়েদার সড়ক।’ সব ঋতুতে ও সব ধরনের আবহাওয়ায় এ সড়কটিতে জনসাধারণ নির্বিঘ্নে চলাচল করতে পারবেÑ এ ধারণা থেকে এ নাম দেওয়া। তবে পরিবেশবিদরা হাওর অঞ্চলের ‘ওয়েদার’ ধ্বংস এবং জীববৈচিত্র্য ও পরিবেশের মারাত্মক ক্ষতির জন্য এ সড়কটিকে দায়ী করেন।
সড়কটি নির্মাণের পর সিলেট, হবিগঞ্জ ও মৌলভীবাজারসহ আশপাশের কয়েকটি জেলা প্রতি বছর আগাম বন্যায় ডুবে যায়। পরিবেশবিদরা জীববৈচিত্র্যের বিপন্নতা, মাছের উৎপাদন কমে যাওয়া ও জলজ উদ্ভিদের ক্ষতির জন্য সড়কটি দায়ী বলে মনে করছেন। তারা বলেন, জলাভূমির স্বাভাবিক পানিপ্রবাহ ব্যাহত হওয়ায় কৃষি ও জীববৈচিত্র্যের ওপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে।
বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলন (বাপা) কিশোরগঞ্জ জেলা শাখার সাধারণ সম্পাদক প্রভাষক সাইফুল ইসলাম জুয়েল বলেন, কোনো ধরনের সমীক্ষা ছাড়াই এ বাঁধের মতো করে এ সড়কটি নির্মাণ করায় হাওরের পানিপ্রবাহে বাধা সৃষ্টি হচ্ছে। জীববৈচিত্র্যের ওপর বড় ধরনের নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে। হাওরের বিভিন্ন জলজ উদ্ভিদ ও প্রাণীর আবাসস্থল ধ্বংস হতে পারে। তিনি বলেন, পরিযায়ী পাখিদের অভ্যাসগত আবাসস্থল সংকুচিত হয়ে গেছে। পানি চলাচলের স্বাভাবিক পথ পরিবর্তিত হওয়ায় দেশীয় মাছের প্রজাতি লোপ পাচ্ছে।
‘ভাতের হোটেল’ থেকে প্রেসিডেন্ট রিসোর্ট
গোয়েন্দা পুলিশের সাবেক প্রধান হারুন অর রশীদ কিশোরগঞ্জবাসীর কাছে পরিচিত সাবেক রাষ্ট্রপতি আবদুল হামিদের ডানহাত নামে। আর গোটা দেশবাসী জানে ‘ভাতের হোটেলের হারুন’ হিসেবে। ২০১১ সালে বিরোধীদলীয় চিফ হুইপ বিএনপি চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা জয়নুল আবদিন ফারুককে জাতীয় সংসদ ভবন এলাকায় মারধর করে পতিত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার হৃদয়ে স্থান করে নেন পুলিশের বহু বিতর্কিত এ কর্মকর্তা।
হাওরে আবদুল হামিদের প্রমোদ সড়ক তৈরির পর মিঠামইনের হোসেনপুর গ্রামে ৪০ একর জমিতে গড়ে তোলেন বিলাসবহুল ‘প্রেসিডেন্ট রিসোর্ট’। এলাকাবাসীর দাবি, এ রিসোর্টে রাষ্ট্রপতি হামিদ পরিবারের বিপুল পরিমাণ বিনিয়োগ রয়েছে।
রিসোর্টের সঙ্গে সম্পৃক্ত এক ব্যক্তি জানান, ২০২০ সালের ২০ ডিসেম্বর এ রিসোর্টের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেন হামিদের ছেলে ও কিশোরগঞ্জ-৪ আসনের আওয়ামী লীগের সংসদ সদস্য রেজওয়ান আহাম্মদ তৌফিক। ২০২১ সালের ৩ সেপ্টেম্বর এটি উদ্বোধন করার সময়ও তিনি রিসোর্টে উপস্থিত ছিলেন। রিসোর্টটি তৈরিতে ১০০ কোটি টাকারও বেশি ব্যয় হয়েছে। এটির এক পাশে ২০টি দোতলা কটেজে রয়েছে শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত ৪০টি সুইট। আছে রেস্টুরেন্ট, পার্টি সেন্টার, শিশুদের গেম জোন ও ওয়াচ টাওয়ার। প্রতিটি সুইটের দৈনিক ভাড়া দশ থেকে ২৮ হাজার টাকা।
রিসোর্ট এলাকার মাঝে রয়েছে বিশাল আয়তনের একটি দিঘি। এর মাঝখানে হেলিপ্যাড। বিগত সরকারের একাধিক প্রভাবশালী মন্ত্রী, সচিব ও পুলিশের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা রিসোর্টটিতে বেড়াতে এসেছেন।
এলাকাবাসীর দাবি, ডিবির হারুন এ রিসোর্ট তৈরির আগে কিছু জমি খরিদ করলেও বেশিরভাগ জমিই হুমকি দিয়ে জোরপূর্বক দখল করেছেন। কয়েকজনের কাছ থেকে বায়না করে পুরো টাকা না দিয়েই রাষ্ট্রপতির কথা বলে জমি দলিল করে নিয়েছেন।
এলাকাবাসী জানিয়েছেন, হাওর এলাকায় হারুনের পরিবারের অল্প পরিমাণ জমি ছিল। তার পিতা আব্দুল হাশেম ঘাগড়া বাজারে চালের কারবার ও হাওরে শ্রমিক হিসেবে কাজ করতেন। ছাত্রলীগের নেতা থেকে ভুয়া মুক্তিযোদ্ধার সনদ দিয়ে পুলিশে চাকরি বাগিয়ে নেন হারুন। হারুনের বাবা মুক্তিযুদ্ধে অংশ নেননি। তবে তার এক দাদা (বাবার চাচা) ইদ্রিস ওরফে ইদু মোল্লাকে রাজাকার হিসেবে জানেন এলাকাবাসী।
শ্রেণি পরিবর্তিত হচ্ছে মাটির, ফসল উৎপাদন ব্যাহত হওয়ার আশঙ্কা
গর্ব ও ঐতিহ্য হিসেবে পরিচিত কিশোরগঞ্জের হাওরাঞ্চল দেশের শস্যভান্ডার হিসেবে পরিচিত। এ হাওরের বুকে অপরিকল্পিত সড়ক নির্মাণের ফলে বর্ষায়ও পলি জমার কারণে জমির ধরনে পরিবর্তন এসেছে। ভূমি ও মাটিতে এর প্রভাব পড়ছে। প্রতি বছর ধানের উৎপাদনও কমে আসছে বলে জানিয়েছে বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনস্টিটিউট (ব্রি)। প্রতিষ্ঠানটির মহাপরিচালক
হাওর এলাকা নিয়ে কাজ করছেন এমন পরিবেশবিদরা জানান, এ সড়কের প্রভাবে বাড়ছে সেচ সংকট। পাশাপাশি কমছে বোরো উৎপাদন। সড়কঘেঁষে সৃষ্টি হচ্ছে বিশাল বিশাল গর্ত। গর্ত শাসনে ফেলা হচ্ছে সিমেন্টের ব্লক। এতে হাওরের প্রাকৃতিক চরিত্র বদলে যাচ্ছে।
হাওর এলাকার পরিবেশভিত্তিক সংগঠন ‘হাওরাঞ্চলবাসী’র প্রধান সমন্বয়ক হালিম দাদা খান জানিয়েছেন, এ সড়ক নির্মাণের কারণে দেশের যে পরিমাণ আর্থিক ক্ষতি হয়েছে, পরিবেশ ও প্রতিবেশগত ক্ষতি তার চেয়েও কয়েকগুণ বেশি। এ বিষয়ে মৃত্তিকা সম্পদ উন্নয়ন ইনস্টিটিউটের মুখ্য বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা মো. মামুনুর রহমান বলেছেন, হাওরের মাটির একটি স্বতন্ত্র্য বৈশিষ্ট্য রয়েছে। উন্নয়ন প্রকল্পের কারণে এর ক্ষতির পরিমাণটি সুদূরপ্রসারী। এ বিষয়ে সবাইকে সতর্ক হওয়া জরুরি।
হাওর এলাকায় ধান উৎপাদন আশঙ্কাজনকভাবে কমছে বলে মনে করছেন স্থানীয় কৃষকরা। এলাকার কয়েকজন কৃষকের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, আগে হাওরের ধানে খুব বেশি চিটা হতো না। এ বাঁধ নির্মাণের পর থেকে ধানের চিটা হচ্ছে। বৃষ্টির পানি ডোবা ও নালাগুলোতে চলে যেত। সেখান থেকে শ্যালো মেশিনে প্রয়োজনমতো আবার জমিতে দেওয়া যেত। এখন বৃষ্টির অতিরিক্ত পানি ধানক্ষেতগুলোতে দীর্ঘদিন ধরে জমে থাকার কারণে ধানের শীষে চিটা ধরে যাচ্ছে।
ধান গবেষণা ইনস্টিটিউটের মহাপরিচালক ড. মোহাম্মদ খালেকুজ্জামান জানিয়েছেন, হাওর এলাকায় অপরিকল্পিত উন্নয়ন প্রকল্প নেওয়া বোরো উৎপাদনে এটির নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে। এখন থেকেই এ বিষয়ে কর্তৃপক্ষকে সতর্ক হতে হবে।
কী বলছেন পরিবেশবিদরা
হাওরের এ সেতুটিকে দেশের জন্য আত্মঘাতী উল্লেখ করে আন্তর্জাতিক পরিবেশবিদ ও পানি বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক ড. আইনুন নিশাত বলেছেন, এমন প্রকল্প বিশ্বে আর দ্বিতীয়টি আছে বলে আমার মনে হয় না। কারণ, জেনে ও বুঝে রাষ্ট্রের কোটি কোটি টাকা ব্যয় করে মরণবাঁধ নির্মাণ কোনো সরকার করতে পারে না। অথচ এটাই আমাদের দেশের কিছু ক্ষমতাশালী ব্যক্তি ক্ষমতার দোর্দণ্ডপ্রতাপ দেখিয়ে করেছেন।
আইনুন নিশাত বলেন, বর্ষায় এ সলিড সড়কটিতে গেলে দেখা যায়, এর এক পাশের পানি তিন থেকে চার ফুট ওপরে আর অপর পাশের পানি তিন-চার ফুট নিচে। এতেই বোঝা যায়, সড়কটি দেশের জন্য কতটা আত্মঘাতী।
হাওরকে ধ্বংস করে সড়ক নির্মাণের সঙ্গে জড়িতদের শাস্তির আওতায় আনার দাবি জানিয়েছেন শিক্ষাবিদ অধ্যাপক ড. আনু মুহাম্মদ। তিনি বলেন, ব্যক্তিগত ইচ্ছার প্রতিফলন ঘটাতে গিয়ে গোটা রাষ্ট্রের স্বার্থহানি করে এ সড়কটি নির্মাণের ফলে গোটা হাওর অঞ্চলের প্রাণবৈচিত্র্যের ওপর প্রচণ্ড আঘাত করা হয়েছে। পরিবেশগত ভারসাম্য রক্ষা, বোরো উৎপাদন ও বর্ষায় মাছের জন্য এ হাওর হচ্ছে ওই অঞ্চলের মানুষের হৃৎপিণ্ডের মতো। বিগত সরকার গায়ের জোরে এর সুদূরপ্রসারী ক্ষতি করে গেল। দায়ীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার পাশাপাশি বর্তমান সরকারের উচিত সমীক্ষা চালিয়ে এর ক্ষয়ক্ষতি কমিয়ে আনার বিষয়টি ভেবে দেখা।