Image description

নৌপরিবহন মন্ত্রণালয় ও এর অধীন অধিদপ্তরগুলোতে ব্যাপক লুটপাট চালানোর অভিযোগ সাবেক নৌপরিবহন প্রতিমন্ত্রী খালিদ মাহমুদ চৌধুরীর বিরুদ্ধে। লুটপাটতন্ত্রের কারণে অলিখিত এক ‘মাফিয়া ডনে’ পরিণত হয়েছিলেন খালিদ।

এ নিয়ে শুরু হয়েছে দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) অনুসন্ধান। হাসিনার সময়ে ব্যাপক প্রভাব-প্রতিপত্তি ছিল সাবেক এই প্রতিমন্ত্রীর। তার হাতে নির্যাতিত হয়েছে স্বয়ং আওয়ামী লীগের অসংখ্য দলীয় কর্মী।

তার ‘পেটোয়া বাহিনীর’ প্রধান ছিলেন আবুল বাশার ওরফে ‘বাস্টার্ড বাশার’। এই বাশারকে দিয়ে গোটা দিনাজপুর, বিরল ও বোচাগঞ্জে ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করেছিলেন স্বপন। পিয়ন হোক বা ঝাড়ুদারÑ সবার কাছে থেকেই ২০ লাখ টাকার নিয়োগ-বাণিজ্য করেছেন। আওয়ামী লীগের আমলে ইউনিয়ন পরিষদ (ইউপি) নির্বাচনে ২৫ থেকে ৩৫ লাখ টাকা যার কাছ থেকে পেয়েছেন তিনিই নির্বাচিত হয়েছে চেয়ারম্যান। কেউ প্রতিবাদ করলেই তার ওপর চলত নির্যাতন। আসত প্রাণনাশের হুমকি এবং সর্বশেষ মাদকসহ নানা মামলায় যেতে হতো জেলে।

সম্প্রতি দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) গোয়েন্দা ইউনিট ও দিনাজপুর জেলা কার্যালয়ের তদন্তে মিলেছে এসব তথ্য। নিজের আত্মীয়, বোনজামাই, এপিএস (সহকারী একান্ত সচিব) ও ব্যবসায়িক অংশীদারদের নামে অঢেল সম্পদ গড়েছেন সাবেক প্রতিমন্ত্রী খালিদ। তার মন্ত্রণালয়ের অধীন সব খাতেই বিপুল আর্থিক অনিয়মের সন্ধান পেয়েছে দুদক।

দুদকের অনুসন্ধানে প্রতিমন্ত্রী খালিদের অবৈধ সম্পদ

জোছরা অটোরাইস মিলের মালিক আবদুল হান্নান ম্যানেজারের নামে উপজেলার বিভিন্ন গ্রামে শত শত বিঘা জমি কিনেছেন। ওইসব জমির কয়েকগুণ বেশি দাম দেখিয়ে বিভিন্ন ব্যাংকে বন্ধক রেখে খালিদ মাহমুদের প্রভাবে শত কোটি টাকার লোন তুলে মালিকের ভাব নিয়েছেন আবদুল হান্নান। এ ছাড়া প্রতিমন্ত্রীর বেনামে ঢাকার লালমাটিয়া, আদাবর, শেখেরটেক, মোহাম্মদিয়া হাউজিং সোসাইটি, বাবর রোড ও হুমায়ুন রোডে রয়েছে ১৬টি ফ্ল্যাট। আর বছিলা ও ঢাকা উদ্যানে ৫ শতাংশ করে রয়েছে ১০টি প্লট। তার মরহুম বাবার নামে করা ‘আব্দুর রৌফ ফাউন্ডেশন’ ট্রাস্টের আড়ালেও করেছেন কবরস্থানের জমি দখল।

উল্লেখ্য, গত ২ সেপ্টেম্বর সাবেক নৌপরিবহন প্রতিমন্ত্রী খালিদ মাহমুদ চৌধুরী, তার স্ত্রী, সন্তান ও তাদের স্বার্থ-সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানের নামের ব্যাংক অ্যাকাউন্ট তলব করে বাংলাদেশ ব্যাংকের আর্থিক গোয়েন্দা সংস্থা বাংলাদেশ ফাইন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিট (বিএফআইইউ)।

একাধিক সূত্র জানিয়েছে, ক্ষমতার প্রভাব খাটিয়ে নিয়োগ-বাণিজ্য, টেন্ডারবাজি ও দলীয় পদ দেওয়ার নামে হাজার কোটি টাকা কামিয়েছেন সাবেক প্রতিমন্ত্রী খালিদ মাহমুদ চৌধুরী। তিনি দিনাজপুর জেলা ও রাজধানীর বিভিন্ন এলাকায় হাজার কোটি টাকার সম্পদ গড়েছেন। ‘জোহরা অটোরাইস মিলে’র নেপথ্যে রয়েছে বিশাল বিনিয়োগ। পাচার করা টাকায় লন্ডনে একাধিক বাড়ি কিনেছেন মেয়ের নামে। রাজধানীতে প্লটের পাশাপাশি রয়েছে ১৩টি ফ্ল্যাট। নিজ জেলা দিনাজপুরে রয়েছে শত কোটি টাকার অবৈধ বালু-বাণিজ্য।

জানা গেছে, প্রতিমন্ত্রী খালিদ মাহমুদ চৌধুরীর হাজার কোটি টাকা লন্ডনে পাচার করা হয় তার এপিএস বাশারের মালিকানায় নেওয়া ‘এজেন্ট ব্যাংকিং’ শাখার মাধ্যমে। প্রতিমন্ত্রী খালিদের ছত্রচ্ছায়ায় বোচাগঞ্জ উপজেলার সীমান্ত এলাকায় ফেনসিডিল ও ‘টাপেনটাডল’ চোরাচালানের বাণিজ্য নিয়ন্ত্রণ করতেন উপজেলা যুবলীগের সাধারণ সম্পাদক আশরাফ আলী তুহিন।

এপিএসের মাধ্যমে লুটপাটতন্ত্রের নিয়ন্ত্রণ

সূত্র জানায়, ২০১৯ সালে নৌপরিবহন প্রতিমন্ত্রীর দায়িত্ব পাওয়ার পরই মন্ত্রণালয়ের অধীন বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ নৌপরিবহন কর্তৃপক্ষ (বিআইডব্লিউটিএ), বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ নৌপরিবহন করপোরেশন (বিআইডব্লিউটিসি), চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষ, মংলা বন্দর কর্তৃপক্ষ, বাংলাদেশ স্থলবন্দর কর্তৃপক্ষ, বাংলাদেশ শিপিং করপোরেশন, সমুদ্র পরিবহন অধিদপ্তর, মেরিন একাডেমি, ন্যাশনাল মেরিটাইম ইন্সটিটিউট, জাতীয় নদী রক্ষা কমিশন, পায়রা বন্দর কর্তৃপক্ষ, গভীর সমুদ্র বন্দর সেল, নৌ পরিবহন অধিদপ্তর এই শাখাগুলোর প্রধান কার্যালয় নিয়ন্ত্রণ রাখতেন তার এপিএসের মাধ্যমে। নিজস্ব ঠিকাদার ও ব্যক্তিগত ক্যাডার বাহিনী দিয়ে চেয়ারম্যান, প্রধান প্রকৌশলীদের কাজ দেওয়ার জন্য বিভিন্নভাবে চাপ সৃষ্টি করতেন। ২০ লাখ টাকার বেশি কোনো কাজ করতে হলে ‘কমিশন’ দিতে হতো প্রতিমন্ত্রীর লোকদের। ‘কমিশন’ না দিলে কাজ পাওয়া যেত না।

এপিএস বাশারের বড় সহযোগী ছিলেন খালিদ মাহমুদের দূর সম্পর্কের আত্মীয় মো. আরশাদ পারভেজ। তার বাড়ি যশোরের অভয়নগরে। এই দুজন মিলে নিয়ন্ত্রণ করতেন মন্ত্রণালয়ের সবকিছু। তাদের মাধ্যমেই কাজের ‘পার্সেন্টেজ’ নিতেন খালিদ। কাকে কাজ দেওয়া যাবে, তা ঠিক করতেন আরশাদ ও বাশার। কর্মকর্তা থেকে শুরু করে বিভিন্ন দপ্তরের কর্মচারী পদেও নিজেদের সিন্ডিকেটের লোক বসাতেন এই দুজন। তাদের মধ্যে আরশাদ খালিদ মাহমুদের ‘ক্যাশিয়ার’ হিসেবে পরিচিত। মূলত এই আরশাদ প্রতিমন্ত্রীর হাজার হাজার কোটি টাকা দেশের বাইরে পাচারে সহযোগিতা করেছেন।

খালিদ মাহমুদের ছত্রচ্ছায়ায় আঙুল ফুলে কলাগাছ এপিএস বাশার

সূত্র জানায়, ফ্যাসিবাদী আওয়ামী লীগের শাসনামলে ব্যবসা করতে হলে আওয়ামী লীগ করতে হবে এবং চাঁদা দিতে হবেÑ এই নীতির কারণে দিনাজপুরের বিরল ও বোচাগঞ্জ উপজেলায় ব্যবসায়ীরা অতিষ্ঠ হয়ে উঠেছিল। আর এসব হতো তৎকালীন নৌপরিবহন প্রতিমন্ত্রী খালিদ মাহমুদের নির্দেশে। খালিদের এপিএস আবুল বাশার ছিলেন সম্মুখসারীর কর্মী। বাশারের মৌখিক অনুমতি ছাড়া কিছু হতো না। দিনাজপুরে ব্যবসা-বাণিজ্যও নিয়ন্ত্রিত হতো তার ইশারায়।

একাধিক ব্যবসায়ী জানান, আওয়ামী লীগে যোগদান না করলে এবং চাঁদা না দিলে ট্রেড লাইসেন্স থেকে বিদ্যুৎ সংযোগÑ কোনোটাই পাওয়া যেত না। বাশার বোচাগঞ্জ এলাকায় কত সম্পদের মালিক তার হিসাব কেউ বলতে পারবে না।

টেনা গ্রামে পৈতৃক নিবাস হলেও সেখানে তার নামে ও বেনামে প্রায় ৩০০ বিঘা আবাদি জমি, মসলাবাটি এলাকায় মার্কেট, পুকুরসহ খামারবাড়ী, ৫ নম্বর সৈয়দপুর ইউনিয়নে ৯০ বিঘা জমির ওপর আমবাগান, ঠাকুরগাঁও জেলার পীরগঞ্জ উপজেলায় কোটি টাকা মূল্যের ৫৮ শতক জমিসহ বিপুল সম্পদ থাকার তথ্য পাওয়া গেছে। রয়েছে ঢাকার শেখের টেক, লালমাটিয়া, আদাবর, মোহাম্মদীয়া হাউজিং সোসাইটি, হুমায়ুন রোডে একাধিক ফ্ল্যাট ও বাড়ি।

গত ৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের মুখে শেখ হাসিনার সরকারের পতনের পর মন্ত্রিসভার অন্য সদস্যদের সঙ্গে আত্মগোপনে চলে যান খালিদ মাহমুদ চৌধুরী। তার সঙ্গে আত্মগোপনে গেছেন একান্ত অনুসারীরাও। লাশের গাড়িতে করে খালেদ মাহমুদ চৌধুরী, তার এপিএস আবুল বাশার ও ক্যাশিয়ার আরশাদ পারভেজ ভবানীপুরের সীমান্ত দিয়ে ভারতে পালিয়ে যান। এসব কারণে তাদের কোনো বক্তব্য নেওয়া সম্ভব হয়নি।