Image description
 

রেমিট্যান্সের নামে দেশে ৭৩০ কোটি টাকা আনা আলোচিত ব্যক্তি হলেন ক্ষমতাচ্যুত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নিরাপত্তাবিষয়ক উপদেষ্টা মেজর জেনারেল (অব.) তারিক আহমেদ সিদ্দিক। পরামর্শক ফি দেখিয়ে ওই অর্থ দেশে এনেছিলেন তিনি।

নিয়মানুযায়ী, কোনো বাংলাদেশি বিদেশে পরামর্শক হিসেবে যে আয় করবে তার ওপর ১৫ শতাংশ হারে আয়কর দিতে হয়। কিন্তু ক্ষমতার প্রভাব দেখিয়ে আয়কর ছাড়াই সে অর্থ ছাড় করিয়ে নেন তারিক আহমেদ সিদ্দিক। তৃতীয় এক ব্যক্তির ব্যাংক অ্যাকাউন্ট ব্যবহার করে ওই অর্থ দেশে এনে পরবর্তী সময়ে তা তারিক সিদ্দিকের ব্যাংক অ্যাকাউন্টে স্থানান্তর করা হয়। এখনো অ্যাকাউন্টে ২৭০ কোটি টাকা জমা রয়েছে। এনবিআরের একাধিক সূত্রে এসব তথ্য জানা গেছে।

সূত্র জানায়, ক্ষমতায় থাকতে এশিয়ার একটি বৃহৎ অস্ত্র রপ্তানিকারক দেশের সঙ্গে শেখ হাসিনার সরকার অস্ত্র আমদানির চুক্তি করে। অস্ত্র আমদানির কমিশন হিসাবেই তারিক আহমেদ সিদ্দিক ওই অর্থের ভাগ পেয়েছিলেন। তারিক সিদ্দিক ছাড়া আওয়ামী লীগের শীর্ষ পর্যায়ের এবং সরকারের ঘনিষ্ট আরও কিছু ব্যক্তি কমিশনের ভাগ পেয়ে থাকতে পারেন বলে তাদের অনুমান।

তারা বলছেন, কোনো বাংলাদেশি বা বাংলাদেশের কোনো একক প্রতিষ্ঠানের পরামর্শক হিসাবে এত বিপুল পরিমাণ অর্থ উপার্জনের বিষয়টি খুবই সন্দেহজনক। যে দেশ থেকে ওই অর্থ এসেছিল সে দেশটি বরং বিভিন্ন দেশে পরামর্শ দিয়ে থাকে। বাংলাদেশেও তারা বিভিন্ন বিষয়ে পরামর্শ দিয়ে থাকে। পরামর্শ ফির নামে রেমিট্যান্স হিসেবে আনা হলেও মূলত কমিশন বাণিজ্য হিসেবে সে অর্থ আনা হয়েছিল।

এনবিআরের কর্মকর্তারা জানান, পরামর্শক ফি হিসেবে ওই অর্থ দেশে আনা হলেও এর স্বপক্ষে যেসব দলিলাদি এনবিআরে জমা দেয়া হয়েছিল সেগুলোর বিশ্বাসযোগ্যতা নিয়ে সংশয় সন্দেহ তৈরি হয়। ফলে ওই অর্থের বৈধ উৎস নিয়ে আপত্তি জানান এনবিআরের সংশ্লিষ্ট কর কর্মকর্তা। পরে প্রশাসনিক চাপ তৈরি করে ওই কর্মকর্তাকে সেখান থেকে বদলি করে দেওয়া হয়। পরে কোনো ধরনের আয়কর ছাড়াই ওই অর্থ দেশে আনার প্রক্রিয়া সম্পন্ন হয়।

এনবিআর সংশ্লিষ্টরা জানান, জনৈক ফারুক আহমেদের অ্যাকাউন্টে ওই অর্থ জমা হয়। তবে ওই ব্যাংকের নাম ও শাখার নাম জানা যায়নি। ওই অর্থ কয়েকটি ধাপে আনা হয়। বিদেশ থেকে আনা সে অর্থ পরে তারিক আহমেদ সিদ্দিকের ব্যাংক অ্যাকাউন্টে স্থানান্তরিত হয়।

২০২০ কিংবা ২০২১ সালে ঘটে যাওয়া ওই ঘটনা গত সোমবার প্রকাশ্যে এনেছেন এনবিআর চেয়ারম্যান আবদুর রহমান খান। ইকোনমিক রিপোর্টার্স ফোরাম (ইআরএফ) ও বিসিএস কর ক্যাডারদের সঙ্গে মতবিনিয় সভায় এনবিআর চেয়ারম্যান বলেন, প্রবাসীদের রেমিট্যান্সে করমুক্ত সুবিধার সুযোগ নিয়ে এক ব্যক্তি ৭৩০ কোটি টাকা দেশে এনেছিলেন।

তিনি বলেন, শুনলে আশ্চর্য হবেন, এমন ট্যাক্সপেয়ার পাওয়া গেল, যিনি ৭৩০ কোটি টাকা নিয়ে আসলেন। তিনি বলছেন, ‘এটা তার ওয়েজ আর্নার্স এবং এটা ট্যাক্স ফ্রি।’ অথচ আমরা আইন করলাম যে, আমাদের প্রবাসী ভাইয়েরা যারা কঠোর পরিশ্রম করে বিদেশ থেকে টাকা উপার্জন করে ব্যাংকিং চ্যানেলের মাধ্যমে বাংলাদেশে নিয়ে আসে, তাদের ক্ষেত্রে আমরা বললাম, তাদের এই আয়টা ট্যাক্স ফ্রি হবে বাংলাদেশে।

রেমিট্যান্সের নামে ওই ব্যক্তির এত বিপুল অর্থ আনার ক্ষেত্রে নিয়মের ব্যত্যয় হয়েছে বলে মন্তব্য করেন তিনি। তবে তিনি ওই ব্যক্তির নাম উল্লেখ করেননি। ওই ব্যক্তির নাম জানতে চাইলে তিনি সাংবাদিকদের বলেন, ‘নাম না বলাই ভালো’। সেই ব্যক্তির নাম বহুল বিতর্কিত মেজর (অব.) তারিক আহমেদ সিদ্দিক। তবে এনবিআর সূত্র জানায়, ওই অর্থের পরিমাণ ৭২১ কোটি টাকা।

গত বছরের ৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের মুখে শেখ হাসিনা ভারতে পালিয়ে যান। তার কয়েকদিন পর তারিক সিদ্দিকও ভারতে পালিয়ে গেছেন বলে ধারণা করা হয়। পিলখানায় বিডিআর হত্যা, শাপলা চত্বরে রাতের আঁধারে হেফাজতের নেতাকর্মীদের ওপর বর্বোচিত হামলা, ছাত্র-জনতার আন্দোলনের সময় শত শত ছাত্র হত্যার অন্যতম কারিগর হিসেবে তারিক সিদ্দিকের নাম নানাভাবে ওঠে এসেছে। আয়নাঘরের মূল পরিকল্পনাকারী হিসেবেও তাকে বিবেচনা করা হয়। এ ছাড়া সরকারি বিভিন্ন সংস্থায় কমিশন বাণিজ্যের মাধ্যমে কয়েক হাজার কোটি টাকা হাতিয়ে নেওয়ার অভিযোগ রয়েছে তারিক সিদ্দিক ও তার স্ত্রী শাহনাজ সিদ্দিকীর বিরুদ্ধে।

তারিক সিদ্দিক শেখ হাসিনার ছোট বোন শেখ রেহানার স্বামী শফিক আহমেদ সিদ্দিকের ছোট ভাই। বিরোধীদলীয় নেতা থাকাকালে হাসিনার ব্যক্তিগত নিরাপত্তাপ্রধান ছিলেন তিনি। ২০১৪ সালে তিনি প্রধানমন্ত্রীর নিরাপত্তা উপদেষ্টা হিসেবে নিয়োগ পান এবং ২০১৮ সালের নির্বাচনের পর পুনরায় তাকে এ পদে নিয়োগ দেওয়া হয়। ২০২৪ সালের জানুয়ারিতে উপদেষ্টা পদে নিয়োগের অবসান হলেও সেই সময় তাকে মন্ত্রী পদমর্যাদায় উপদেষ্টা হিসেবে নিয়োগ দেন শেখ হাসিনা।

বর্তমানে তার বিরুদ্ধে অর্থ আত্মসাতের অভিযোগে দুদকের মামলা চলমান রয়েছে। এ ছাড়া তার বিরুদ্ধে খালেদা জিয়ার নিরাপত্তা বাহিনীর প্রধান কর্নেল (অব.) মো. তৌহিদুল ইসলাম চৌধুরীকে তুলে নিয়ে গুম করার অভিযোগে তার বিরুদ্ধে মামলা করা হয়েছে।