
সারা দেশে চলতি বছর প্রথম দুই মাসে ৫১১ জন খুন হয়েছে। সেই হিসাবে প্রতিদিন গড়ে প্রায় ৯ জন করে খুন হয়। গত বছর একই সময় খুন হয়েছিল ৪৭১ জন। পুলিশ সদর দপ্তরের পরিসংখ্যানে এসব তথ্য জানা গেছে। সে অনুযায়ী এই দুই মাসে গত বছরের চেয়ে চলতি বছর ৪০ জন বেশি খুন হয়েছে।
অপরাধ বিশ্লেষকরা বলছেন, মানুষের মধ্যে অসহিষ্ণুতা, অস্থিরতা ও প্রতিহিংসা বেড়েছে। আইনের কঠোর প্রয়োগ না হওয়ায় তুচ্ছ ঘটনায় মানুষ খুনের মতো অপরাধে জড়াচ্ছে।
পুলিশ মহাপরিদর্শক (আইজিপি) বাহারুল আলম বলেন, আইন-শৃঙ্খলা নিয়ন্ত্রণে তাঁদের সর্বাত্মক চেষ্টা রয়েছে। হত্যার ঘটনায় জড়িতদের গ্রেপ্তারে পুলিশ কাজ করছে।
পুলিশ সদর দপ্তরের তথ্য মতে, নিহতদের মধ্যে শিশু, নারীসহ সব বয়সী মানুষ রয়েছে। হত্যাকাণ্ডে আগ্নেয়াস্ত্র, ধারালো অস্ত্রসহ লাঠিসোঁটা ব্যবহার করা হচ্ছে।
পুলিশ সদর দপ্তর সূত্র জানায়, চলতি বছরের জানুয়ারি ও ফেব্রুয়ারি মাসে দেশে ৫১১ জন খুন হয়েছে। এই হিসাবে প্রতিদিন গড়ে প্রায় ৯ জন করে খুন হয়। এর মধ্যে জানুয়ারি মাসে খুন হয় ২৪০ জন। ফেব্রুয়ারিতে এই সংখ্যা বেড়ে হয়েছে ২৭১। গত বছর একই সময়ে (জানুয়ারি-ফেব্রুয়ারি) দেশে খুন হয় ৪৭১ জন। এর মধ্যে জানুয়ারিতে ২৩১ জন এবং ফেব্রুয়ারিতে ২৪০ জন। অর্থাত্ আগের বছরের চেয়ে চলতি বছরের প্রথম দুই মাসে দেশে খুনের ঘটনা ৪০টি বেশি।
তবে পুলিশ সদর দপ্তরের মাসিক অপরাধ প্রতিবেদনে চলতি বছরের ফেব্রুয়ারি মাসের ঘরে ৩০০ জন খুন হওয়ার তথ্য রয়েছে। জানুয়ারিতে খুন হয়েছে ২৯৪ জন। গত দুই মাসে ৫৯৪টি হত্যাকাণ্ড ঘটে দেশে।
এ বিষয়ে পুলিশ সদর দপ্তরের (এআইজি মিডিয়া অ্যান্ড পিআর) ইনামুল হক সাগর কালের কণ্ঠকে বলেন, ৫৯৪টি হত্যাকাণ্ডের মধ্যে মামলা সূত্রে আগের ৮৩টি হত্যাকাণ্ড যোগ হয়েছে। এই ৮৩টি হত্যাকাণ্ড বাদ দিলে দুই মাসে হত্যার মোট সংখ্যা দাঁড়ায় ৫১১।
পুলিশ সদর দপ্তরের প্রতিবেদনে জানা গেছে, চলতি বছর প্রথম দুই মাসে ঢাকা বিভাগে সবচেয়ে বেশি, ১৪২ জন খুন হয়েছে। এর মধ্যে জানুয়ারিতে ৭৬ জন, ফেব্রুয়ারিতে ৬৬ জন। এতে এই দুই মাসে প্রতিদিন গড়ে দুজনের বেশি খুন হয়েছে।
চট্টগ্রামে গত দুই মাসে খুন হয়েছে ১০১ জন; জানুয়ারিতে ৫১ জন এবং ফেব্রুয়ারিতে ৫০ জন। সিলেটে খুন হয় ৩৪ জন; জানুয়ারিতে ২১ জন এবং ফ্রেব্রুয়ারিতে ১৩ জন। খুলনায় খুন হয় ৫০ জন; জানুয়ারিতে ২৮ জন এবং ফেব্রুয়ারিতে ২২ জন। রাজশাহীতে খুন হয় ৫২ জন; জানুয়ারিতে ৩০ জন এবং ফেব্রুয়ারিতে ২২ জন। রংপুরে খুন হয় ৪২ জন; জানুয়ারিতে ১৯ জন এবং ফেব্রুয়ারিতে ২৩ জন। ময়মনসিংহে খুন হয়েছে ৩২ জন; জানুয়ারিতে ১৩ জন এবং ফেব্রুয়ারিতে ১৯ জন। বরিশালে খুন হয়েছে ২৮ জন; জানুয়ারিতে ১২ জন এবং ফেব্রুয়ারিতে ১৬ জন।
গত বছরের সেপ্টেম্বর থেকে নভেম্বর পর্যন্ত তিন মাসে দেশে ৭৪৩ জন খুন হয়। এর মধ্যে নভেম্বরে ২১১ জন, অক্টোবরে ২৪৯ জন এবং সেপ্টেম্বরে ২৮৩ জন।
হত্যার ঘটনা বেড়ে যাওয়ার বিষয়ে পুলিশ সদর দপ্তরের (এআইজি মিডিয়া অ্যান্ড পিআর) ইনামুল হক সাগর কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘নানা কারণে হত্যার ঘটনা বেড়েছে। তবে আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আমরা সর্বাত্মক চেষ্টা করছি।’
সাম্প্রতিক চাঞ্চল্যকর হত্যাকাণ্ড : ফেসবুকে পরিচয়ের সূত্র ধরে গাড়িচালক রবিনের সঙ্গে পরিচয় অষ্টম শ্রেণির ছাত্রীর। দেড় মাসের পরিচয়ের সূত্রে সাক্ষাতের জন্য তাকে গত ১৬ জানুয়ারি রাজধানীর মহাখালী এলাকায় ডেকে নেন রবিন। সেখান থেকে হাজারীবাগে বন্ধুর ভাড়া করা বাসায় নিয়ে হাত-পা বেঁধে পাঁচজন মিলে ধর্ষণের পর মেয়েটিকে হত্যা করা হয়। ১৭ দিন পর হাতিরঝিল থেকে মেয়েটির বস্তাবন্দি অর্ধগলিত লাশ উদ্ধার করা হয় বলে জানান দক্ষিণখান থানার ওসি মোহাম্মদ তায়েফুর রহমান।
গত ২৫ জানুয়ারি রাতে খুলনা নগরীর তেঁতুলতলা মোড়ে গুলি ছুড়ে হত্যা করা হয় খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র অর্ণব কুমার সরকারকে। অর্ণবের বাবা নীতীশ কুমার সরকার বলেন, ‘কারো সঙ্গে কোনো দিন দুর্ব্যবহার করেনি আমার বাবা। আমিও কোনো দিন কারো ক্ষতি করিনি। তাহলে আমার ছেলেকে ওরা কেন এভাবে হত্যা করল?’
গত ৩১ জানুয়ারি ফরিদপুরে ফরহাদ প্রামাণিক নামে এক রিকশাচালককে হত্যা করা হয়। তাঁর রিকশাটিও নিয়ে যায় দুর্বৃত্তরা। ফরিদপুর কোতোয়ালি থানার ওসি বলেন, ধারণা করা হচ্ছে, রিকশাটি ছিনিয়ে নেওয়ার জন্যই ফরহাদকে হত্যা করা হয়।
গত ২৯ জানুয়ারি রাজধানীর যাত্রাবাড়ীর দনিয়া এলাকায় মিনহাজুর রহমান নামের এক তরুণ প্রকৌশলীকে ছুরি মেরে হত্যা করা হয়। নিহতের ভগ্নিপতি খালিদ মাহফুজ বলেন, বেসরকারি একটি পলিটেকনিক ইনস্টিটিউট থেকে পড়া শেষ করে সফটওয়্যার ফার্মে চাকরি করতেন মিনহাজ।
একই দিন নগরের কাশিপুর ইছাকাঠিসংলগ্ন একটি দীঘি ও আশপাশের এলাকা থেকে এক নারীর দেহের খণ্ডাংশ উদ্ধার করা হয়। গত ৯ জানুয়ারি কক্সবাজার সমুদ্রসৈকতে খুলনা মহানগর স্বেচ্ছাসেবক লীগের সহসভাপতি গোলাম রব্বানী টিপুকে গুলি করে হত্যা করা হয়।
গত ১১ ফেব্রুয়ারি কুষ্টিয়ার দৌলতপুরে গুলি করে রাজু নামের এক যুবককে হত্যা করা হয়। গত ৩ ফেব্রুয়ারি ময়মনসিংহের মুক্তাগাছায় মো. রিফাত নামের এক শিশুকে গলা কেটে হত্যা করা হয়। গত ২ ফেব্রুয়ারি বরগুনার কচুপাতা পুরাতন বাজার এলাকার আমতলিতে আরাফাত খান নামের এক যুবককে টেঁটাবিদ্ধ করে হত্যা করা হয়।
চলতি মাসেও বেশ কিছু হত্যাকাণ্ড ঘটেছে। গত মঙ্গলবার রাজধানীর উত্তরখানের পুরানপাড়া বাতান এলাকায় হাবিবুল্লাহ বাহার কলেজের উপাধ্যক্ষ মোহাম্মদ সাইফুর রহমান ভুঁইয়াকে কুপিয়ে হত্যা করা হয়। পরের দিন বুধবার রাতে রাজধানীর বাড্ডায় মো. তানভীর (২২) নামের এক যুবক খুন হন। পুলিশ ও নিহত তানভীরের পরিবারের সদস্যরা জানায়, রাত সাড়ে ৯টার দিকে বাসার কাছে স্থানীয় কিশোর সন্ত্রাসী গ্রুপের ছয়-সাতজন মিলে তানভীরকে কুপিয়ে হত্যা করে।
গত ৮ মার্চ মাদারীপুর সদর উপজেলার খোয়াজপুর উপজেলায় মসজিদে ঢুকে তিন ভাইকে কুপিয়ে হত্যা করা হয়। গত ১২ মার্চ ঢাকার ধামরাইয়ে হাত-পা বাঁধা এক যুবকের লাশ উদ্ধার করে পুলিশ।
ডিএমপি কমিশনার শেখ মো. সাজ্জাত আলী বলেন, অপরাধ নিয়ন্ত্রণে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষা বাহিনী তৎপর রয়েছে। অপরাধ করে পার পাওয়ার সুযোগ নেই।
মাওলানা ভাসানী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্রিমিনোলজি অ্যান্ড পুলিশ সায়েন্স বিভাগে অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ উমর ফারুক কালের কণ্ঠকে বলেন, হত্যার ঘটনা নিয়ন্ত্রণে আনা দরকার। উপার্জনক্ষম ব্যক্তি মারা গেলে পরিবারের অপূরণীয় ক্ষতি হয়।