
শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে অস্থিরতা, শিক্ষকদের আন্দোলন, শিক্ষার্থীদের আন্দোলনসহ নানা কারণে পড়াশোনা থেকে পিছিয়ে পড়ছে শিক্ষার্থীরা। এ ছাড়া সময়মতো বই দিতে না পারায় গত আড়াই মাসে সঠিকভাবে পড়াশোনা করতে পারেনি শিক্ষার্থীরা। বেসরকারি স্কুল-কলেজে শিক্ষকসংকট প্রকট। এতে চলতি শিক্ষাবর্ষে শিক্ষার্থীদের শিখন ঘাটতির আশঙ্কা করছেন শিক্ষাবিদরা।
গত সাত মাসে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে ছাত্ররাজনীতি নিষিদ্ধ করাসহ নানা দাবিতে আন্দোলন জোরদার হয়। বিভিন্ন ছাত্রসংগঠনের মধ্যে মারামারি, সংঘর্ষেও বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে বড় ধরনের অস্থিরতা সৃষ্টি হয়েছে। সম্প্রতি খুলনা প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় (কুয়েট) এর বড় উদাহরণ। রাজধানীর সাত কলেজের শিক্ষার্থীদের বিশ্ববিদ্যালয়ের দাবিতে গড়ে ওঠা আন্দোলনও বড় ধরনের অস্থিরতা সৃষ্টি করে।
বর্তমানে ছোটখাটো দাবিতেও বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা বড় ধরনের আন্দোলন করছেন। এমনকি যা আলোচনার টেবিলে সমাধান সম্ভব, সেগুলো নিয়ে তাঁরা বিশ্ববিদ্যালয় ও বাইরে বিক্ষোভ করছেন, ক্লাস-পরীক্ষাও বন্ধ করছেন। জাতীয় কবি কাজী নজরুল বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রভোস্টের পদত্যাগ নিয়েও অচলাবস্থার সৃষ্টি হয়। শিক্ষার্থীরা এখন কথায় কথায় আন্দোলনে নেমে যাচ্ছে। এতে ব্যাহত হচ্ছে শিক্ষা কার্যক্রম।
সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা রাশেদা কে. চৌধূরী কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘বাংলাদেশে আগে থেকেই শিক্ষার মান নিয়ে সবার মধ্যে উদ্বেগ রয়েছে। আমরা এখনো করোনার থাবা থেকে মুক্ত হতে পারিনি। এরপর জুলাই আন্দোলন যা অবধারিত ছিল, সেটা হয়েছে। এতে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে অস্থিরতা তৈরি হয়েছে।
এখন সময় হয়েছে, সব শিক্ষার্থীর ক্লাসে ফিরে যাওয়ার। তবে যাঁরা রাজনীতি করবেন, তাঁরা তো একটি পথ বেছে নিয়েছেন। আবার শিক্ষকরাও অনেক দাবি নিয়ে মাঠে ছিলেন। তাঁদেরও কিছু দাবি পূরণ হয়েছে। তবে সবার দাবি মানতে শিক্ষায় বিনিয়োগ বাড়াতে হবে।’
সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, স্কুল-কলেজে আন্দোলন না থাকলেও তাদের সমস্যা ভিন্ন। চলতি শিক্ষাবর্ষে নতুন কারিকুলাম বাতিল করে ২০১২ সালের কারিকুলামে ফিরিয়ে আনা হয়েছে। খুব স্বল্প সময়ে পরিমার্জনের কাজ করতে গিয়ে দরপত্র প্রক্রিয়ায় দেরি হয়ে যায়। এতে শিক্ষার্থীদের সব বই পেতে পেতে অনেক দেরি হয়ে যায়। রমজানে স্কুল বন্ধ থাকায় শিক্ষার্থীরা বই না নিয়েই ছুটিতে চলে গেছে। ফলে তারা পড়ালেখা থেকে পিছিয়ে পড়েছে।
জানা যায়, বেতন-ভাতার দাবিতে গত সাত মাসে শ্রেণিকক্ষের চেয়ে আন্দোলনের মাঠেই বেশি ব্যস্ত ছিলেন শিক্ষকরা। রাজধানীতে এমন কোনো শিক্ষক সংগঠন নেই, তারা তাদের দাবি নিয়ে আন্দোলন করেনি। একাধিক শিক্ষক সংগঠন রাজধানীতে অবস্থান কর্মসূচি, অনশন, কর্মবিরতি, বিক্ষোভ-ঘেরাওয়ের মতো কর্মসূচি পালন করেছে। অনেক সময় শিক্ষকদের আন্দোলন থামানোর জন্য জলকামান, লাঠিপেটা ও সাউন্ড গ্রেনেডের ব্যবহার করতে হয়েছে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষা বাহিনীকে।
সূত্র জানায়, সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষকরা বর্তমানে ১৩তম গ্রেডে বেতন পান। তাঁরা দশম গ্রেডে বেতনের দাবিতে জোরদার আন্দোলন করছেন। নন-এমপিও শিক্ষকরা এমপিওভুক্তির দাবিতে আন্দোলন করছেন। এমপিওভুক্ত শিক্ষকরা বাড়িভাড়া, শতভাগ উৎসব ভাতার দাবিতে আন্দোলন করেছেন। পাশাপাশি তাঁরা মাধ্যমিক পর্যায়ের সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান জাতীয়করণ চান। বেসরকারি প্রাথমিকের শিক্ষকরা জাতীয়করণের দাবিতে আন্দোলন করছেন। স্বতন্ত্র ইবতেদায়ি মাদরাসার শিক্ষকরা এমপিওভুক্তি চান। এ ছাড়া বিভিন্ন ধরনের শিক্ষকরা তাঁদের দাবি আদায়ে আন্দোলনের মাঠে রয়েছেন।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক অধ্যাপক ও অর্থনীতিবিদ ড. মাহবুব উল্লাহ কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘শিক্ষকরা যদি আন্দোলনে থাকেন, ছাত্ররা যদি নানা কাজে ব্যতিব্যস্ত থাকে, তাহলে শিক্ষার মান আরো খারাপ হবে। তবে যে দেশে এ ধরনের রাজনৈতিক পরিবর্তন এসেছে, সেখানে অস্থিরতা হয়েছে। আমার বিশ্বাস এ অবস্থা দীর্ঘদিন থাকবে না। তবে এটা স্বীকার করতেই হবে, আমাদের শিক্ষাব্যবস্থা খাদের কিনারে চলে গেছে। এটাকে উদ্ধার করা না গেলে দেশ এগোতে পারবে না। রাজনৈতিক দল ও সরকারকে এ ব্যাপারে বিশেষ নজর দিতে হবে।’
মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা (মাউশি) অধিদপ্তর সূত্র জানায়, দেশের ৩২ হাজারের বেশি এমপিওভুক্ত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে বর্তমানে লক্ষাধিক শিক্ষকের পদ শূন্য। গত বছরের শুরুতে ৯৬ হাজার ৭৩৬ জন শিক্ষক নিয়োগের লক্ষ্যে পঞ্চম গণবিজ্ঞপ্তি দেওয়া হয়। কিন্তু পদ্ধতিগত জটিলতায় মাত্র ২৩ হাজার ৯৩২ জন আবেদন করতে পেরেছেন। এর মধ্যে মাত্র ২০ হাজার জনকে নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। ফলে আগে থেকেই ৭৬ হাজার পদ খালি। এর সঙ্গে গত দেড় বছরে প্রায় ২০ হাজার শিক্ষক পদ শূন্য হয়েছে। ফলে শিক্ষকসংকটের কারণে মাধ্যমিক পর্যায়ের স্কুলগুলোতে শ্রেণি কার্যক্রম ব্যাহত হচ্ছে।
সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, শুরুতে অন্তর্বর্তী সরকারের শিক্ষা ও পরিকল্পনা উপদেষ্টার দায়িত্ব পান ড. ওয়াহিদউদ্দিন মাহমুদ। শুরুতে ভিসি-প্রোভিসি নিয়োগে উপদেষ্টাকে বেশ বেগ পেতে হয়। তারপর নতুন পাঠ্যবই নিয়ে প্রচণ্ড চাপে পড়তে হয়। ফলে শিক্ষার অন্যান্য কাজে খুব একটা সময় দিতে পারেননি তিনি। এ অবস্থায় মন্ত্রণালয় ও অধিদপ্তর শুধু বদলি-পদায়ন নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়ে। ফলে শিক্ষার্থীদের পড়ালেখা থেকে আরো পিছিয়ে পড়ে। তবে গত ৫ মার্চ শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের নতুন উপদেষ্টা হিসেবে দায়িত্ব পেয়েছেন অধ্যাপক সি আর আবরার। এখন শিক্ষাসংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা তাঁর পদক্ষেপের অপেক্ষায় রয়েছেন।
জানা যায়, গত বছরের জুন মাস থেকেই বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে অস্থিরতা সৃষ্টি হয়। পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক-কর্মকর্তা-কর্মচারীরা সর্বজনীন পেনশন স্কিমে তাঁদের অন্তর্ভুক্তি বাতিলের দাবিতে কর্মবিরতি শুরু করেন। এতে ক্লাস-পরীক্ষা বন্ধ হয়ে যায়। একই সঙ্গে চলতে থাকে কোটা আন্দোলন। তবে জুলাই মাস থেকে এই আন্দোলন জোরদার হয়, যা শুধু বিশ্ববিদ্যালয়েই নয় দেশের সব স্কুল-কলেজেও ছড়িয়ে পড়ে।
ছাত্র-জনতার আন্দোলনে গত বছরের ৫ আগস্ট সরকার পতনের পর শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে নতুন অস্থিরতা সৃষ্টি হয়। জোর করে প্রতিষ্ঠান প্রধানদের পদত্যাগে বাধ্য করা হয়। এ ছাড়া অনেক বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য স্বেচ্ছায় পদত্যাগ করেন। ফলে ভিসি, প্রোভিসি ও ট্রেজারার নিয়োগ দিতে দিতেই আরো দু-তিন মাস চলে যায়। এ অবস্থায় স্কুল-কলেজগুলোতে পরীক্ষা নিয়ে শিক্ষাবর্ষ শেষ করা হলেও শিক্ষার্থীরা ভালো করতে পারেনি। তাদের শিখন ঘাটতি নিয়েই পরবর্তী শ্রেণিতে উত্তীর্ণ হতে হয়েছে। কিন্তু নতুন শিক্ষাবর্ষেও আন্দোলন-অস্থিরতা-সংকট পিছু ছাড়েনি।
ব্র্যাক বিশ্ববিদালয়ের ইমেরিটাস অধ্যাপক ড. মনজুর আহমদ কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘শিক্ষায় সমস্যা আগে থেকেই ছিল। তবে নতুন সরকার এসে শিক্ষায় তেমন কোনো উদ্যোগও নেয়নি। একটা কমিশন করার কথা ছিল, সেটাও হয়নি। প্রাথমিকে একটা পরামর্শক কমিটি হয়েছে। এখন তাদের সুপারিশ বাস্তবায়ন হতে হবে। বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে পড়ালেখার সার্বিক পরিবেশ ফিরিয়ে আনতে হবে। এ জন্য ছাত্রনেতারাও উদ্যোগ নিতে পারেন। শিক্ষা মন্ত্রণালয়ে নতুন উপদেষ্টা যোগ দিয়েছেন, তিনি কী করেন, সেটাও দেখার বিষয়।’