
ফ্যাসিস্ট সরকারের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ১৬ বছর আগে রাষ্ট্রক্ষমতায় আসেন। ক্ষমতায় আসার এক বছরের মাথায় ২০১০ সালে তার বিরুদ্ধে দায়ের হওয়া ৯টি দুর্নীতির মামলা বাতিল করে রায় দেন হাইকোর্ট। কিন্তু রাষ্ট্রক্ষমতায় থাকায় তখন ওইসব রায়ের বিরুদ্ধে কোনো আপিল করেনি দুদক। বিগত ৫ আগস্ট রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর হাইকোর্টের ওইসব রায়ের বিরুদ্ধে আপিল করার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। সব মামলা সচল করা হচ্ছে। এরই মধ্যে খুলনায় ভাসমান বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণের অনুমতি দিয়ে বঙ্গবন্ধু মেমোরিয়াল ট্রাস্টের নামে ৩ কোটি টাকা চাঁদা নেওয়ার অভিযোগে করা মামলায় আপিল করা হয়েছে। আপিল নম্বর ৭৩৯/২০২৫। হাইকোর্টের রায়ের ৫ হাজার ৪৫২ দিন পর এই আপিল দায়ের করা হয়। এর সঙ্গে দীর্ঘদিন পর আপিল দায়ের করার ব্যাপারে ‘বিলম্ব মার্জনা’ চেয়ে একটি আবেদনও করা হয়েছে।
গত মঙ্গলবার আপিল বিভাগের চেম্বার বিচারপতির আদালতে আপিল মামলাটি শুনানির জন্য উত্থাপন করা হয়। পরে আদালত এ বিষয়ে আগামী ১৮ মে আপিল বিভাগের নিয়মিত বেঞ্চে শুনানির জন্য পাঠিয়েছেন। ওইদিন প্রধান বিচারপতির নেতৃত্বাধীন বেঞ্চে এ বিষয়ে শুনানি হবে। বিলম্ব মার্জনার আবেদনে বলা হয়েছে, ‘শেখ হাসিনা প্রধানমন্ত্রী থাকায় তার বিরুদ্ধে কারও পদক্ষেপ নেওয়ার সাহস ছিল না। পটপরিবর্তনের পর দুদক আপিল করার সিদ্ধান্ত নেয়।’ চেম্বার আদালতে দুদকের পক্ষে শুনানি করেছেন আইনজীবী আসিফ হাসান এবং মামলাটিতে ফাইলিং লইয়ার হিসেবে রয়েছেন অ্যাডভোকেট সত্য রঞ্জন মণ্ডল। জানতে চাওয়া হলে দুদকের এক মহাপরিচালক বলেছেন, ‘২০১০ সালে যেসব মামলা হাইকোর্ট বাতিল করে রায় দিয়েছিলেন, সেসব রায়ের বিরুদ্ধে পর্যায়ক্রমে আপিল দায়ের করা হবে।’
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, ২০১০ সালে সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ১০টি দুর্নীতির অভিযোগের মামলা প্রত্যাহারের সুপারিশ করে সরকারিভাবে দুদকে পাঠানো হয়। তবে দুদকের চেয়ারম্যান গোলাম রহমান ওই সুপারিশ নাকচ করে দেন। পরে হাইকোর্টের রায়ের মাধ্যমে মামলাগুলো বাতিল করে দেওয়া হয়। ২০১০ সালের ৩ মার্চ থেকে ৩০ মে পর্যন্ত তিন মাসে ৯টি দুর্নীতির অভিযোগের মামলা বাতিল করেন হাইকোর্টের দুটি বেঞ্চ। এর মধ্যে একটি বেঞ্চের নেতৃত্বে ছিলেন বিচারপতি মো. শামসুল হুদা মানিক এবং অপর বেঞ্চের নেতৃত্বে বিচারপতি ছিলেন বিচারপতি এ এইচ এম শামসুদ্দিন চৌধুরী মানিক। এদের মধ্যে বিচারপতি শামসুল হুদা মানিক ছিলেন গোপালগঞ্জ জেলা আওয়ামী লগের সভাপতি। শেখ হাসিনা ক্ষমতা ছাড়ার পাঁচ মাস আগে ২০০১ সালের ফেব্রুয়ারিতে শামসুল হুদা মানিক এবং শামসুদ্দিন চৌধুরী মানিককে অতিরিক্ত বিচারপতি হিসেবে হাইকোর্টে নিয়োগ দেওয়া হয়। নিয়ম অনুযায়ী দুই বছর পর রাষ্ট্রপতি তাদের চাকরি স্থায়ী করার ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নেন। ২০০৩ সালে বিএনপি নেতৃত্বাধীন চারদলীয় জোট সরকার তাদের নিয়োগ স্থায়ী করেনি। এরপর ২০০৯ সালে শেখ হাসিনা ক্ষমতায় এলে ওই বছরের ২২ মার্চ তারা হাইকোর্টে বিচারপতি হিসেবে আবার স্থায়ী নিয়োগ পান।
মামলাগুলো বাতিলের ক্ষেত্রে হাইকোর্ট বেশিরভাগ রায়ে বলেন, স্বার্থান্বেষী একটি মহল শেখ হাসিনার ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন করতে মামলাগুলো করেছিলেন। মামলায় অভিযোগ প্রমাণের জন্য কোনো উপাদান পাওয়া যায়নি; তাই মামলাগুলো বাতিল করা হয়েছে। শেখ হাসিনাকে রাজনৈতিকভাবে হয়রানি করার উদ্দেশ্যে মামলাগুলো করা হয়েছিল। হাইকোর্টের ওই রায়ের পর দুদক আর কোনো পদক্ষেপ নেয়নি। সর্বোচ্চ আদালতে কোনো আপিল করার সাহস দেখায়নি।
৯টি মামলা বাতিল হওয়ার পর শেখ হাসিনার আইনজীবী ব্যারিস্টার শেখ ফজলে নূর তাপস সাংবাদিকদের তখন জানিয়েছিলেন, আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে বিগত চারদলীয় জোট সরকারের আমলে ৯টি এবং তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে ছয়টি মামলা হয়। এর মধ্যে ৯টি মামলা হাইকোর্ট বাতিল করেছেন। এ ছাড়া তত্ত্বাবধায়ক সরকার আমলে ব্যবসায়ী আজম জে চৌধুরী, নূর আলী ও তাজুল ইসলাম ফারুক শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে চাঁদাবাজির তিনটি মামলা করেন। পরে তারা মামলাগুলো প্রত্যাহার করে নেন। অন্যদিকে পল্টন হত্যা হামলার চূড়ান্ত অভিযোগপত্রে শেখ হাসিনাকে অব্যাহতি দেওয়া হয়। এ ছাড়া হুমায়ুন আজাদকে দেখতে সেনানিবাসে ঢোকার জন্য অনধিকার প্রবেশ সংক্রান্ত মামলা এবং বঙ্গবন্ধু স্মৃতিসৌধ নির্মাণ সংক্রান্ত দুর্নীতি মামলার অভিযোগপত্র থেকেও তাকে অব্যাহতি দেওয়া হয়।
‘যে ৯ মামলা সচল হচ্ছে’:
বিচারপতি শামসুল হুদার নেতৃত্বাধীন বেঞ্চ তিন মাসে শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে করা পাঁচটি মামলা বাতিল করেছিলেন। মামলাগুলো হলো ফ্রিগেট (যুদ্ধজাহাজ) ক্রয় দুর্নীতি মামলা, মেঘনাঘাট বিদ্যুৎকেন্দ্র দুর্নীতি মামলা, নাইকো দুর্নীতি মামলা, ভাসমান বিদ্যুৎকেন্দ্র দুর্নীতি মামলা ও বেপজায় পরামর্শক নিয়োগে দুর্নীতির মামলা। একই সময়ে বিচারপতি শামসুদ্দিন চৌধুরী মানিকের হাইকোর্টের অপর বেঞ্চ শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে চারটি মামলা বাতিল করে দেন। মামলাগুলো হলো নভোথিয়েটার দুর্নীতির অভিযোগ সংক্রান্ত তিনটি মামলা ও মিগ যুদ্ধবিমান ক্রয়সংক্রান্ত দুর্নীতির অভিযোগের মামলা। এই ৯টি মামলা সচল করার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে বলে দুদক সূত্র জানিয়েছে।
‘খুলনায় ভাসমান বিদ্যুৎকেন্দ্র’:
এই বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণের অনুমতি দিয়ে ৩ কোটি টাকা ঘুষ নেওয়ার অভিযোগে করা মামলাটি ২০১০ সালের ১৩ এপ্রিল বাতিল করেন হাইকোর্ট। বঙ্গবন্ধু মেমোরিয়াল ট্রাস্টের নামে ৩ কোটি টাকা চাঁদা নিয়ে বিদ্যুৎকেন্দ্রটি স্থাপনে সর্বনিম্ন দরদাতাকে বাদ দিয়ে দ্বিতীয় দরদাতাকে কাজ দেওয়ার অভিযোগ ছিল মামলাটিতে। শেখ হাসিনাসহ ছয়জনের বিরুদ্ধে ২০০৭ সালের ২ সেপ্টেম্বর তেজগাঁও থানায় মামলা করে দুদক। আটটি চেক/পে-অর্ডারের মাধ্যমে সামিট গ্রুপের মোহাম্মদ আজিজ খান শেখ হাসিনাকে ৩ কোটি টাকা প্রদান করেন, যার দ্বারা ধানমন্ডিতে বঙ্গবন্ধু মেমোরিয়াল ট্রাস্টের জন্য দোতলা বাড়িসহ ১৯.১১ কাঠা জমি কেনা হয়। ২০০৮ সালের ১৮ মে অভিযোগ গঠনের পরে বিশেষ জজ আদালতে মামলার সাক্ষ্য গ্রহণ শুরু হয়। পরবর্তী সময়ে ক্ষমতায় এসে মামলাটি বাতিল করানো হয়। এই মামলা বাতিলের রায়ের বিরুদ্ধে এরই মধ্যে আপিল দায়ের করা হয়েছে। ১৮ মে এ বিষয়ে শুনানি হবে।
‘নাইকো দুর্নীতি’:
সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে ২০০৭ সালের ৯ ডিসেম্বর বিদেশি প্রতিষ্ঠান নাইকোকে তিনটি গ্যাস ফিল্ড থেকে অবৈধভাবে গ্যাস উত্তোলনের সুযোগ দেওয়ার অভিযোগে শেখ হাসিনাসহ সাতজনের বিরুদ্ধে মামলাটি করা হয়। মামলায় আসামিরা পরস্পর যোগসাজশে নাইকো রিসোর্সকে অবৈধভাবে ১ হাজার ৭৯৪ বিসিএফ গ্যাস উত্তোলনের সুযোগ দিয়ে রাষ্ট্রের ১৩ হাজার ৬৩০ কোটি ৫০ লাখ টাকা আর্থিক ক্ষতিসাধনের অভিযোগ আনা হয়। ২০১০ সালের ১১ মার্চ শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে করা এ মামলাটি বিচারপতি শামসুল হুদার নেতৃত্বাধীন হাইকোর্ট বেঞ্চ বাতিল ঘোষণা করে রায় দেন।
‘মেঘনাঘাট বিদ্যুৎকেন্দ্র’:
কেন্দ্রটি স্থাপনে দুর্নীতির অভিযোগে ২০০১ সালের ১১ ডিসেম্বর রমনা থানায় মামলা করে দুর্নীতি দমন ব্যুরো। ২০০২ সালের ১৪ অক্টোবর শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে এ মামলায় চার্জশিটও দেওয়া হয়। অভিযোগে বলা হয়, কেন্দ্রটি স্থাপনে অনিয়ম এবং দুর্নীতির কারণে রাষ্ট্রের ১৭ কোটি ৮৪ লাখ টাকা ক্ষতি হয়েছে। চার্জশিটে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, বিদ্যুৎ প্রতিমন্ত্রী অধ্যাপক রফিকুল ইসলাম, সাবেক যোগাযোগমন্ত্রী সৈয়দ আবুল হোসেন ও সাকো গ্রুপের ব্যবস্থাপক এএমএন ইসলামকে আসামি করা হয়।
২০১০ সালের ২২ এপ্রিল বিচারপতি শামসুল হুদার নেতৃত্বাধীন হাইকোর্ট বেঞ্চ শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে মামলাটি বাতিল ঘোষণা করে রায় দেন।
‘কোরিয়ান ফ্রিগেট ক্রয়’:
বিএনপি-জামায়াত জোট সরকার আমলে বিলুপ্ত দুর্নীতি দমন ব্যুরো ২০০২ সালের ৭ আগস্ট শেখ হাসিনাসহ পাঁচজনের বিরুদ্ধে এ মামলা করে। মামলায় দুর্নীতি ও অনিয়মের মাধ্যমে নৌবাহিনীর জন্য পুরোনো যুদ্ধজাহাজ ফ্রিগেট কেনায় সর্বনিম্ন দরদাতা চীনা কোম্পানির পরিবর্তে চতুর্থ সর্বনিম্ন দরদাতা দক্ষিণ কোরীয় কোম্পানিকে কাজ দিয়ে রাষ্ট্রের ৪৪৭ কোটি টাকা ক্ষতিসাধনের অভিযোগ আনা হয়। ২০০৩ সালের ৩ আগস্ট মামলার অভিযোগপত্র দেওয়া হয়। ২০১০ সালের ১৮ মে বিচারপতি শামসুল হুদা মানিকের নেতৃত্বাধীন বেঞ্চ এ মামলাটি বাতিল করেন।
‘বেপজায় পরামর্শক নিয়োগ’:
২০০১ সালের ১১ ডিসেম্বর তেজগাঁও থানায় শেখ হাসিনা ও সাবেক পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী আবুল হাসান চৌধুরীসহ পাঁচজনের বিরুদ্ধে বেপজা দুর্নীতি মামলাটি করেন বিলুপ্ত দুর্নীতি দমন ব্যুরোর উপপরিচালক আবদুল্লাহ আল জাহিদ। এ মামলায় তাদের বিরুদ্ধে রাষ্ট্রের ১০ লাখ ৯ হাজার ৯৮৮ টাকা ক্ষতি করার অভিযোগ আনা হয়। ২০০২ সালের ১৮ জুন এ মামলায় অভিযোগপত্র দেওয়া হয়।
মামলাটি বাতিলে শেখ হাসিনার আবেদনে ২০০২ সালের ১৪ ডিসেম্বর হাইকোর্ট মামলাটির কার্যক্রম স্থগিত করেন। ২০১০ সালের ৩০ মে বিচারপতি শামসুল হুদা মানিকের নেতৃত্বাধীন বেঞ্চ মামলাটি বাতিল ঘোষণা করেন।
‘নভোথিয়েটার দুর্নীতির অভিযোগ সংক্রান্ত তিন মামলা’:
বঙ্গবন্ধু নভোথিয়েটার নির্মাণে দুর্নীতির অভিযোগে শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে ২০০২ সালের ২৭ মার্চ দুর্নীতি দমন ব্যুরো তেজগাঁও থানায় এ মামলাগুলো করেছিল। তিনটি মামলার একটিতে সাতজন, একটিতে আটজন এবং আরেকটিতে ১২ জনকে আসামি করা হয়। বঙ্গবন্ধু নভোথিয়েটার নির্মাণে প্রকল্পের পরামর্শকের ব্যয় বৃদ্ধি, ভবন নির্মাণের ব্যয় বৃদ্ধি ও কমকর্তা-কর্মচারীদের ব্যয় বৃদ্ধির অভিযোগে মামলাগুলো হয়েছিল। ২০১০ সালের ৪ মার্চ বঙ্গবন্ধু নভোথিয়েটার নির্মাণে দুর্নীতির অভিযোগে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে দায়ের করা তিনটি মামলা বাতিল বলে রায় দেন হাইকোর্ট। শেখ হাসিনার রিট আবেদনে বিচারপতি এএইচএম শামসুদ্দিন চৌধুরী এবং বিচারপতি বোরহানউদ্দিনের বেঞ্চ রায় দিয়ে বলেছিল, অসৎ উদ্দেশ্যে মামলাগুলো করা হয়েছিল।
‘মিগ-২৯ বিমান ক্রয়’:
রাশিয়া থেকে আটটি মিগ-২৯ যুদ্ধবিমান ক্রয়ের দুর্নীতির অভিযোগে বিলুপ্ত দুর্নীতি দমন ব্যুরোর সময় ২০০১ সালের ১১ ডিসেম্বর মামলাটি করা হয়। মামলায় শেখ হাসিনাসহ পাঁচজনকে আসামি করা হয়। মামলার এজাহারে বলা হয়, ১৯৯৯ সালে শেখ হাসিনা প্রধানমন্ত্রী থাকাকালে নীতিমালা লঙ্ঘন করে রাশিয়া থেকে ১৬টি মিগ-২৯ বিমান কেনার চুক্তি হয়। এর মধ্যে আটটি সরবরাহ করা হয় এবং এর মূল্য হিসাবে ১২ কোটি ৯০ লাখ ইউএস ডলার (তৎকালীন মুদ্রামানে ৭০০ কোটি টাকা) পরিশোধ করা হয়। ১৬টির মধ্যে আটটি সরবরাহ না হওয়ায় সরকারের প্রায় ৭০০ কোটি টাকা ক্ষতি হয়। ২০১০ সালের ৯ মার্চ বিচারপতি শামসুদ্দিন চৌধুরী মানিকের নেতৃত্বাধীন বেঞ্চ মামলাটি বাতিল ঘোষণা করে রায় দেন।