
দেশের রাজনীতিতে হঠাৎ আলোচনায় এসেছে বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টি (সিপিবি)। পল্টনস্থ অফিস ঘেড়াও ইস্যুতে দলটির নাম সামনে চলে আসে। হাসিনা রেজিমে বছরের পর বছর কচ্চপের মতো ঘুমিয়ে কাটালেও হঠাৎ করে ধর্ষণ ইস্যুতে দলটি জেগে উঠেছে। দলটির হঠাৎ করে ‘দেশপ্রেম’ নিয়ে সোশ্যাল মিডিয়ায় বিতর্ক উঠেছে। কেউ লিখেছেন, সিপিবি এখন পলাতক আওয়ামী লীগের রাজনৈতিক ফৌজ। কেউ লিখেছেন, পলাতক হাসিনা দিল্লিতে আশ্রয় নেয়ার পর একের পর এক ষড়যন্ত্রের তীর ছুঁড়ে ব্যর্থ হয়ে এখন সিপিবির উপর ভর করে দাঁড়াতে চাচ্ছে। মনি সিংয়ের মাস্টার প্ল্যান অনুযায়ী শেখ মুজিব যেমন ১৯৭৫ সালে ‘বাকশাল’ করেছিলেন; তারই প্রতিদান হিসেবে শেখ হাসিনার মাস্টার প্ল্যানে অন্তর্বর্তী সরকারকে অস্থিতিশীল করতে নিষিদ্ধ ছাত্রলীগ-যুবলীগের পান্ডাদের সিপিবির ব্যানারে মাঠে নামানো হচ্ছে।
জনপ্রিয় অনলাইন অ্যাক্টিভিস্ট পিনাকী ভট্টাচার্য সিপিবির ব্যানারে আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীদের সক্রিয় করার তথ্য উপাত্ত তুলে ধরে হাটেহাড়ি ভেঙ্গেছেন। নিজের ইউটিউব চ্যানেলে তিনি এক ভিডিওতে তথ্যপ্রমাণ সহকারে সিপিবির কাঁধে ভর করে সরকার পতনে দিল্লির ষড়যন্ত্রের মাস্টার প্ল্যানের চিত্র তুলে ধরেন। তিনি বলেছেন, ‘ধর্ষণ ইস্যুকে ড. ইউনূস সরকারের বিরুদ্ধে রাজনৈতিক হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করার নীলনকশা করেছিল ফ্যাসিস্ট আওয়ামী লীগ। বিশেষ ধর্ষণ ন্যারেটিভ তৈরির জন্য জাতিসংঘের মহাসচিবের বাংলাদেশ সফরকালে ধর্ষণ ইস্যুতে পরিকল্পিতভাবে পরিস্থিতি উত্তপ্ত করার ষড়যন্ত্র করা হয়।
সিপিবির সঙ্গে আওয়ামী লীগের রাজনৈতিক ‘প্রেমবন্ধুত’¡ সেই পুরনো। ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনের বিরোধিতা করেছিল কমিউনিস্ট পার্টি উপমহাদেশের স্বাধীনতাকার্মী জনগোষ্ঠী থেকে সম্পূর্ণ বিচ্ছিন্ন ছিল। ১৯৪৭ সালে দেশ ভাগের পর কমিউনিস্ট পার্টি সেøাগান ছিল ‘ইয়ে আজাদি ঝুটা হ্যায়’। পাকিস্তানের তৎকালীন মুসলিম লীগ সরকার কমিউনিস্ট পার্টি নিষিদ্ধ ঘোষণা করেছিল। এমনকি শেখ মুজিবুর রহমানের ছয় দফা আন্দোলনের সময় দলটি ছয় দফাকে ‘সিআইএর তৈরি দলিল’ আখ্যা দিয়ে আন্দোলনের বিরোধিতা করে। এক সময় নিজেদের ভুল বুঝতে পারে দলটির ছাত্রসংগঠন ১১ দফা মুজিবের ৬ দফায় মিলেমিশে আন্দোলন শুরু হয়। অতপর স্বাধীনতার সংগ্রামে অংশ নেয়। এমনকি স্বাধীনতার পরে দলের অস্থিত্ব বিলুপ্তি ঘটিয়ে বাকশালে অঙ্গীভূত হয়। ১৯৮৬ ও ১৯৯১ সালে আওয়ামী লীগের সঙ্গে যুক্ত হয়ে নির্বাচনে অংশ গ্রহণ করলেও সিপিবি ২০০৮ সাল থেকে শুরু করে ২০২৪ সাল পর্যন্ত নির্বাচনে অংশ নেয়নি। মূলত ২০১৪ সাল থেকে পাতানো নির্বাচনে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় গেলে দিল্লির নীল নকশা অনুযায়ী সিপিবি নির্বাচনের বাইরে থাকে আওয়ামী লীগে এক্সটেনশন হিসেবে। হাসিনা রেজিমে গুম-খুন-জুলুম-নির্যাতন, মামলা-হামলার শিকার বিএনপি-জামায়াতসহ রাজনৈতিক দলগুলোর লাখ লাখ নেতাকর্মী হলেও সিপিবির কোনো নেতাকে সেগুলো স্পর্শ করেনি। এমনকি জুলাই-আগস্ট ছাত্রজনতার অভ্যুত্থানের আন্দোলনে প্রায় সব রাজনৈতিক দল সমর্থন দিয়ে মাঠে নামলেও আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন ১৪ দলীয় জোটের বাইরে একমাত্র সিপিবি আন্দোলন থেকে দূরে ছিল। এখন আওয়ামী লীগ কার্যত রাজনৈতিক ভাবে ক্রাশ হওয়ার পথে। ছাত্রলীগকে নিষিদ্ধ করা হয়েছে। পলাতক হাসিনা বাংলাদেশে অস্থিতিশীল পরিস্থিতি সৃষ্টির লক্ষ্যে জুডিশিয়াল ক্যু, আনসার বিদ্রোহ, সংখ্যালঘু নির্যাতন ইস্যু, গার্মেন্টসে অস্থিরতা, পাহাড়ে অশান্তি এমনকি শত কোটি টাকা খচর করে যুক্তরাষ্ট্রে লবিস্ট নিয়োগ করে ড. ইউনূস ও বাংলাদেশের বিরুদ্ধে আন্তর্জাতিক মহলকে সক্রিয় করার চেস্টা হয়েছে। সবকিছু ব্যর্থ হওয়ায় আগামী ত্রায়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে সংসদে আওয়ামী লীগ প্রতিনিধিত্ব রাখতে চায়। সে লক্ষ্যে দিল্লির নীল নকশা অনুযায়ী অন্তভূ্িক্তমূলক নির্বাচনের দাবির ধোঁয়া তোলা হয়েছিল। সেটা হালে পানি পায়নি। এখন রাজনৈতিক অলিগার্ক সিপিবির ব্যানারে অস্থিতিশীলতার চেস্টা শুরু হয়েছে।
আওয়ামী লীগের অনেক নেতাই পলাতক। কিছু নেতা কারাগারে রয়েছেন। কিছু নেতাকর্মী আত্মগোপনে। সেই আত্মগোপনে থাকা আওয়ামী লীগ, নিষিদ্ধ ছাত্রলীগ-যুবলীগ নেতাদের সিপিবির বন্যারে ‘ধর্ষণ, চুরি, ডাকাতি, ছিনতাই, খুন, রাহাজানি’ ইস্যুকে সামনে রেখে পরিকল্পিতভাবে মাঠে নামানো হচ্ছে। একই সঙ্গে শাহবাগের গণজাগরণ মঞ্চের কুশীলবরাও সক্রিয় হয়েছেন। তারা প্রতিদিন শাহবাগ, জাতীয় জাদুঘর প্রাঙ্গণ, কেন্দ্রীয় শহিদ মিনার, জাতীয় প্রেস ক্লাব, পল্টন মোড়, জিরো পয়েন্টে এলাকায় সমাবেশ ও বিক্ষোভ মিছিলের কর্মসূচি পালন করছে। আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরাই রাজপথ উত্তপ্তের চেস্টা চলছে সিপিবির ব্যানারে। শেখ হাসিনার শাসনামল ছিল কার্যত জংলি শাসন। অপরাধীদের সমন্বয়ে সিন্ডিকেট করে প্রশাসন চালিয়েছেন হাসিনা। আইনশৃংখলা বাহিনীর তথ্য অনুযায়ী হাসিনার শাসনামলের ২০২৪ সালের সেপ্টেম্বর পর্যন্ত (বিগত ৬ বছর) ৪৩৪৭২টি ধর্ষণের অভিযোগ ওঠে। এ সময় নারী নির্যাতনের ঘটনায় মামলা হয়েছে ১৭৫৭১টি। যৌতুক না পেয়ে ও ধর্ষণের পর হত্যাকা-ের শিকার হয়েছেন ১৫৯ জন নারী। শুধু ২০২৪ সালের সেপ্টেম্বর পর্যন্ত ধর্ষণের অভিযোগ আসে ৪৩৩১টি, নারী নির্যাতনের ঘটনায় মামলা হয়েছে ১২৭৬৯টি। এ সময়ে যৌতুক না পেয়ে ও ধর্ষণের পর হত্যাকা-ের শিকার হয়েছেন ১৫৯ জন নারী। থানায় ‘পুলিশশূন্য সময়’ আগস্টে সবচেয়ে কম মামলা হয়েছে। ১৯৯৯ সালে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রলীগ নেতা জসিমউদ্দিন মানিক ১০০তম ধর্ষণ উদযাপন করেন। বিতর্কের মুখে শেখ হাসিনা তাকে কানাডা পাঠিয়ে দেয়। ২০১৬ সালের ২০ মার্চ কুমিল্লা ক্যান্টনমেন্টের ভেতরে শিক্ষার্থী সোহাগী জাহান তনুর ধর্ষণ ও হত্যাকা-ের ঘটনা ঘটে। ২০১৮ সালে ধানের শীষে ভোট দেয়ার অপরাধে আওয়ামী লীগ নেতার নেতৃত্বে নোয়াখালী জেলার সুবর্ণচর উপজেলার চরজুবলী ইউনিয়নের মধ্য বাগ্যার গ্রামে স্বামী-সন্তানকে বেঁধে রেখে এক গৃহবধূকে ধর্ষণ করা হয়। ২০২১ সালের ২৬ এপ্রিল রাজধানীর গুলশানের একটি ফ্ল্যাট থেকে কলেজছাত্রী মোসারাত জাহান ওরফে মুনিয়ার ঝুলন্ত লাশ উদ্ধার করে পুলিশ। এ ঘটনা মরণের পরেও হাসিনার সঙ্গে থাকার অঙ্গিকার করা বিতর্কিত এক ব্যবসায়ীর পুত্রের বিরুদ্ধে হত্যার অভিযোগ উঠে। বিশেষ করে তনু-মুনিয়া হত্যার ঘটনায় তোলপাড় হয়। অথচ সিপিবি এসব ধর্ষণ ও নারীর শ্লীলতাহানির বিরুদ্ধে প্রতিবাদে রাস্তায় নামেনি। হঠাৎ করে দলটির ধর্ষণের বিরুদ্ধে প্রতিবাদী হওয়ার নেপথ্যের রহস্য কি?
হাসিনার শাসানামলে বাংলাদেশ ভারতের সম্পর্ককে বলা হতো স্বামী-স্ত্রীর সম্পর্ক। সম্পর্ক যাই থাক বাংলাদেশ ও ভারত প্রতিবেশি রাষ্ট্র। হাসিনার শাসনামলে বাংলাদেশকে কার্যত ভারতের অঙ্গরাজ্যে পরিণত করা হয়েছিল। দুই দেশের দ্বিপাক্ষিক চুক্তির নামে যা হয়েছে সবগুলো ভারতের স্বার্থে। তাই দিল্লি সহায়তায় একের পর এক পাতানো নির্বাচন করে আওয়ামী লীগকে ক্ষমতায় রেখেছিল। হাসিনা এখন পলাতক। আওয়ামী লীগের কোনো অস্থিত্ব নেই। নানা প্রক্রিয়ায় ষড়যন্ত্র করে বাংলাদেশকে অস্থিতিশীল করে তোলা সম্ভব হয়নি। হিন্দুত্ববাদী ভারতের চানক্য নীতি এবং হাসিনাকে আশ্রয় দেয়ায় বাংলাদেশের জনগণ এবং বেশির ভাগ রাজনৈতিক দল ‘ভারত হটাও’ রাজনীতিতে অভ্যস্ত হয়ে পড়েছে। এমনকি ভারতীয় পণ্য বর্জন আন্দোলন জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে। এবারের ঈদে ভারতীয় পোশাক বিক্রি হচ্ছে না।
এ অবস্থায় ভারত বাংলাদেশে আওয়ামী লীগের বিকল্প বামদলগুলোকে ব্যবহার করছে। বামদলগুলোর একাধিক নেতা কারাগারে এবং তাদের রাজনৈতিক শক্তি না থাকায় সিপিবির ওপর সওয়ার হয়েছে। সিপিবির মাধ্যমে কি আওয়ামী লীগকে পুন:স্থাপনের চেষ্টা করছে ভারত!