Image description

বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের মুখপাত্র উমামা ফাতেমা সম্প্রতি এক অনুষ্ঠানে বলেন, আন্দোলনের পর আমাদের নারী নেত্রীদের সাইবার বুলিংয়ের শিকার হতে হচ্ছে। এটি একটি লক্ষ্যবস্তু করে করা হচ্ছে; যাতে আমরা সামনে এসে নিজেদের কণ্ঠস্বর তুলে ধরতে সাহস না পাই।

চলতি বছরের ৪ মার্চ জাতীয় নারী ফুটবল দলের খেলোয়াড় মাতসুশিমা সুমাইয়া নিজের ভেরিফায়েড ফেসবুক পেজে উল্লেখ করেন তিনি ক্রমাগত হত্যা ও ধর্ষণের হুমকি পাচ্ছেন। এ ছাড়া সাফজয়ী নারী ফুটবল দলের অন্য সদস্যদের নিয়েও সোশ্যাল মিডিয়া কিছুদিন আগে সয়লাব ছিল কুরুচিপূর্ণ মন্তব্যে। এতে অনেকে সে সময় ভেঙে পড়েন। জাতীয় নাগরিক পার্টিসহ বিভিন্ন সংগঠনের নারী নেতারা, সোশ্যাল মিডিয়ার ইনফ্লুয়েন্সাররাও প্রতিনিয়ত সাইবার বুলিংয়ের শিকার হচ্ছেন।

পর্যবেক্ষণে দেখা যাচ্ছে, বিভিন্ন ক্রিয়াশীল সংগঠন, রাজনৈতিকভাবে সক্রিয় এবং মিডিয়ার নারী কর্মীরা সমাজমাধ্যমে বেশি বুলিংয়ের শিকার হচ্ছেন। যখন কোনো নারী আন্দোলনের সম্মুখভাগে চলে আসেন, স্পষ্টভাবে কথা বলেন, পরিচিতি লাভ করেন তখন সেই নারীর সমাজমাধ্যমে চরিত্রহননসহ তার বিরুদ্ধে অপপ্রচার চালানো হয়।

বিশেষজ্ঞরা বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, শুধু আইন দিয়ে সাইবার বুলিংয়ের শিকার নারী ও মেয়েদের সাহায্য করা যাবে এমন না। বুলিংয়ের শিকার নারীদের জন্য সরকারি ও নারী অধিকার নিয়ে কাজ করা সংগঠনগুলোর মানসিক কাউন্সেলিংয়ের ব্যবস্থা করতে হবে।

বাংলাদেশ সাইবার অপরাধপ্রবণতা-২০২৪ প্রতিবেদন অনুযায়ী, সাইবার আক্রমণের ক্ষেত্রে সার্বিকভাবে আক্রান্তের প্রায় ৬০ শতাংশই তরুণী। অপরাধের ধরনের ক্ষেত্রে আছে ভুয়া অ্যাকাউন্ট থেকে অপপ্রচার ১৫ দশমিক ৪৬ শতাংশ, ১১ দশমিক ৩৫ শতাংশের ওপর আক্রমণ পর্নোগ্রাফি-সংক্রান্ত, অনলাইনে হুমকি ১১ দশসিক ৮৫ শতাংশ এবং অনলাইনে বিকৃত ছবি প্রকাশ ৫ দশমিক ১৫ শতাংশ।

অ্যাকশনএইডের অনলাইন ভায়োলেন্স অ্যাগেইনস্ট উইমেন ইন বাংলাদেশ শীর্ষক গবেষণা (২০২২) অনুযায়ী, অনলাইন নির্যাতনের জন্য সবচেয়ে বেশি ব্যবহৃত হয় ফেসবুক (৪৭ শতাংশ) এবং মেসেঞ্জার (৩৫ শতাংশ)। এ ছাড়া ইনস্টাগ্রাম, ইমো, হোয়াটসঅ্যাপ ও ইউটিউবেও নারীরা বুলিংয়ের শিকার হন। ফেসবুকে নারীদের নিয়ে সবচেয়ে বেশি আপত্তিকর, যৌন ইঙ্গিতপূর্ণ, ঘৃণা-বিদ্বেষমূলক মন্তব্য করা হয় (৮০ দশমিক ৪ শতাংশ)। ইনবক্সে নোংরা যৌন ইঙ্গিতপূর্ণ বার্তা ও ছবি পাঠানো হয় (৫৩ শতাংশ)। ১৭ দশমিক ৫ শতাংশ ক্ষেত্রে ফেক আইডি খুলে যৌন হয়রানি করা হয়। ১১ দশমিক ৮ শতাংশ ক্ষেত্রে নারীদের ফেসবুকের ব্যক্তিগত ছবি ও তথ্য অনুমতি না নিয়ে পোস্ট করা হয়। ১১ দশমিক ৮ শতাংশ নারী ফেসবুক ওয়ালে বা মেসেঞ্জারে ক্রমাগত ধর্ষণের হুমকি পেয়েছেন। কাজের বিনিময়ে যৌন প্রস্তাব পান (৪ দশমিক ৮ শতাংশ)।

অ্যাকশনএইডের মতে সাইবার বুলিংয়ের শিকার ৬৫ শতাংশ তীব্র সাইকোলজিক্যাল ট্রমা, বিষণ্নতা ও উদ্বেগজনিত সমস্যায় ভোগেন। ৪২ শতাংশ মতপ্রকাশ বা সমাজমাধ্যম ব্যবহার থেকে বিরত থাকেন। ২৫ শতাংশ আত্মবিশ্বাস ও আত্মসম্মান হারানোর সমস্যায় ভোগেন। মাত্র ১৫ শতাংশ ভুক্তভোগী এর বিরুদ্ধে অভিযোগ করেন।

রিসার্চগেটে ২০২৪-এর মার্চে প্রকাশিত কজেস অ্যান্ড কনসিকুয়েন্সেস অব সাইবার বুলিং অ্যাগেইনস্ট উইমেন ইন বাংলাদেশ : আ কমপ্রিহেনসিভ স্টাডি শীর্ষক গবেষণায় বলা হয়, সাইবার বুলিংয়ের শিকার নারীরা প্রায়ই উদ্বিগ্নতা, বিষণ্নতা ও অসহায়ত্বের মতো মানসিক চাপে ভোগেন। লাগাতার হুমকির কারণে এদের অনেকেই ভয় ও আতঙ্কে থাকেন। আক্রমণের ভয়ে এদের অনেকেই মানুষের সঙ্গে যোগাযোগ বন্ধ করে দেন।

সাইবার বুলিং প্রতিরোধে কাজ করা সংগঠন সাইবারটিনস ফাউন্ডেশনের প্রতিষ্ঠাতা ও সভাপতি সাদাত রহমান বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, এখন কারও সঙ্গে কারও মত না মিললেই অনলাইনে আক্রমণ করে বসে। বর্তমান পরিস্থিতিতে মেয়েরা এর শিকার সবচেয়ে বেশি। মেয়েরা প্রতিবাদী হলে তারা আরও বেশি বুলিংয়ের শিকার হয়। আগে যে মেয়েরা কোনো অন্যায় হলে ফেসবুকে পোস্ট দেওয়ার সাহস করত এখন তা-ও কমে যাচ্ছে। যারা বুলিং করছে তারা ভাইরাল হওয়ার জন্য এমন করছে। অনলাইনে ছেলেদের এ বিষয়গুলো প্রতিরোধে এগিয়ে আসতে হবে। দেশের রাজনৈতিক ও ইসলামি বিজ্ঞ লোকেদের নারী ও মেয়েদের সাইবার বুলিং না করার ব্যাপারে সচেতনতা তৈরি করা উচিত। সাইবার বুলিং যে অপরাধ হতে পারে এখন পর্যন্ত সে মানসিকতা আমাদের গড়ে ওঠেনি।