
বাংলাদেশে ঢাকা মহানগর পুলিশের কমিশনার শেখ মো. সাজ্জাত আলী সম্প্রতি একটি অনুষ্ঠানে 'ধর্ষণ' শব্দটির পরিবর্তে 'নারী নির্যাতন বা নিপীড়ন' শব্দ ব্যবহার করার অনুরোধ করে কড়া সমালোচনার মুখে পড়েছেন। তার মধ্যে প্রধান উপদেষ্টার দপ্তর থেকে ওই বক্তব্যের নিন্দা জানানো হলেও তার বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা না নেয়ারও প্রতিক্রিয়া তৈরি হয়েছে।
গত শনিবার রাজধানীতে গণপরিবহনে নারীদের নিরাপত্তা নিশ্চিতে একটি অ্যাপের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে মি. আলী ওই বিতর্কিত বক্তব্য দিয়েছিলেন।
দেশে একের পর এক ধর্ষণের ঘটনা নিয়ে যখন মানুষ প্রতিবাদ, বিক্ষোভ, আন্দোলন করছে তখনই আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর উর্ধ্বতন ওই কর্মকর্তার কাছ থেকে এ ধরনের বক্তব্য আসে।
ওই বক্তব্যে তিনি দুইটা শব্দ অপছন্দ করেন জানিয়ে সেগুলো ব্যবহার না করার অনুরোধ করেন।
তার এই বক্তব্য তীব্র প্রতিক্রিয়া তৈরি করেছে। মানবাধিকার কর্মী, আইনজীবী ও নারী অধিকার কর্মীরা তার বক্তব্য প্রত্যাখ্যান ও নিন্দা জানিয়েছেন।
গতকাল রোববার রাতে মি. আলীর বক্তব্যের তীব্র নিন্দা জানিয়ে অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টার প্রেস উইং থেকে একটি বিবৃতি পাঠানো হয়েছে।
বিবৃতিতে উল্লেখ করা হয়, " আট বছর বয়সী বা ৮০ বছর বয়সী, যার সঙ্গেই হোক না কেন—ধর্ষণ ধর্ষণই। এমন জঘন্য অপরাধকে অবশ্যই যথাযথভাবে উল্লেখ করতে হবে।"
প্রধান উপদেষ্টার দপ্তর থেকে ওই বিবৃতির পর সোমবার সকালে নিজের বক্তব্যের জন্য দুঃখপ্রকাশ করেছেন মি. আলী।
যদিও পুলিশের সাবেক মহাপরিদর্শক নুরুল হুদা মনে করছেন, আইন শৃঙ্খলা বাহিনীর একজন উর্ধ্বতন কর্মকর্তার এ ধরনের বক্তব্যে প্রশাসনিক ব্যবস্থা না নিয়ে নিন্দা জানানো বাঞ্চনীয় নয়।
বিবিসি বাংলাকে মি. হুদা বলেন, " যে উক্তি বা বক্তব্য সন্দেহ সৃষ্টি করতে পারে, একটা ধোঁয়াশার পরিবেশ সৃষ্টি করতে পারে এবং যেটা আইনত গ্রাহ্য না, সেটা যখন কেউ করে তখন তার বিরুদ্ধে প্রশাসনিক ব্যবস্থা নেয়াটাই বাঞ্চনীয়।"
তবে প্রধান উপদেষ্টার দপ্তর বলছে ডিএমপি কমিশনারের ওই বক্তব্যকে ঘিরে যে বিবৃতি দেয়া হয়েছে এটি একটি সতর্কবার্তা।
প্রধান উপদেষ্টার প্রেস সচিব শফিকুল আলম বিবিসি বাংলাকে বলেন, "যে স্টেটমেন্টটা দেয়া হয়েছে এটা ওনার জন্য একটা সতর্কবার্তা। এটা দিয়ে ওনাকে সতর্ক করা হলো।"
সরকারি কর্মচারী হিসেবে তার বিরুদ্ধে প্রশাসনিক ব্যবস্থা নেয়ার সুযোগ থাকলেও ওই পুলিশ কর্মকর্তার জন্য এই বিবৃতিটিই একটি সতর্কবার্তা হিসেবে বিবেচিত হবে বলে জানান মি. আলম।

ছবির উৎস,DMP News

ছবির উৎস,Getty Images
" আইনের প্রয়োগকারীর কাছ থেকে এ ধরনের বক্তব্য গ্রহণযোগ্য না "
ঢাকার পুলিশ কমিশনার শেখ মো. সাজ্জাত আলীর ওই বক্তব্য দেয়ার পর সেটি ব্যাপক প্রতিক্রিয়া তৈরি করেছে।
অনেকেই এর বিরুদ্ধে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন। এর বাইরে আইনজীবী ও মানবাধিকার কর্মীরা সভা-সমাবেশ করে তাদের প্রতিক্রিয়া জানিয়েছেন।
ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ (টিআইবি), সেভ দ্য চিলড্রেন, আইন ও সালিশ কেন্দ্র (আসক), মানুষের জন্য ফাউন্ডেশন, ব্রেকিং দ্য সাইলেন্সসহ নারী ও শিশু সুরক্ষা নিয়ে কাজ করা পাঁচটি এনজিও পুলিশ কমিশনারের এ মন্তব্যের নিন্দা জানিয়েছে।
তাদের দাবি, " ধর্ষণকে ধর্ষণই বলতে হবে। সঠিক ভাষা প্রয়োগ না করলে আইন প্রয়োগেও দুর্বলতা আসবে"।
মো. নাহিদ হাসান নামে এক ব্যক্তি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকে অন্য নারী নির্যাতনের সাথে ধর্ষণের পার্থক্য রয়েছে উল্লেখ করে একটি স্ট্যাটাস দিয়েছেন।
তিনি লিখেছেন, "কেন? ধর্ষণকে কেন নারী নির্যাতন বলবে? স্বামী স্ত্রীর গায়ে হাত তুললে,শশুর বাড়ির বা অন্যকেউ হাত তুললেও সেটা নারী নির্যাতন হয় মা-বাবা হলেও। কিন্তু ধর্ষণকে কেন নারী নির্যাতন বলতে হবে? ধর্ষণ ধর্ষণই হয়।এটাকে নির্যাতন বললে কি নারীর কোন লাভ হবে না কষ্ট কম হবে?"
বিমান ধর নামে আরেকজন ব্যক্তি ফেসবুকে লিখেছেন, "মাননীয় ডিএমপি কমিশনারের সাথে একমত নই। কেন ধর্ষণকে "ধর্ষণ" বলব না? শব্দটি ব্যবহার করতে ভালো না লাগলেও বলব।"
" ধর্ষণ কি আর দশটা নারী নির্যাতনের সমান? সমান নয়। কিন্তু উনারা ধর্ষণকে অন্য সব নারী নির্যাতনের পরিসংখ্যানে ফেলে নিজেদের ব্যর্থতা কমাতে চান। ধর্ষণকে ধর্ষণই বলুন। চাপ তৈরি করুন। নইলে সরকার ঝিমিয়ে ঝিমিয়ে জাবর কাটতেই থাকবে" লিখেছেন মি. ধর।
ডিএমপি কমিশনার 'ধর্ষণ' শব্দটি ব্যবহার না করার অনুরোধের মাধ্যমে আসলে ধর্ষকের পক্ষ নিচ্ছেন বলে অভিযোগ করেছেন ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের (টিআইবি) নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান।
পুলিশের সাবেক মহাপরিদর্শক নুরুল হুদা মনে করেন, ডিএমপি কমিশনারের এ ধরনের বক্তব্যের উদ্দেশ্য ভালো হলেও এটি গ্রহণযোগ্য নয়।
মি. হুদা বলেন, "এটা বুঝতে হবে যে উনি হচ্ছেন একজন আইনের প্রয়োগকারী। উদ্দেশ্য ভালো হলেও যেভাবে বলেছেন সেটা গ্রহণযোগ্য না।"
পুলিশের এই সাবেক কর্মকর্তা বলছেন, আইনের বিষয়ে সুনির্দিষ্ট করেই বলতে হবে। কারণ নারী নির্যাতন ও নিপীড়ন অনেক 'ব্যাপক' ব্যাপার।
"এই ক্লাস্টারের অধীনে অনেকগুলো অপরাধ রয়েছে। ধর্ষণ, ধর্ষণই, এটা একটা সিরিয়াস অপরাধ হিসেবে বিবেচিত। অতএব এখানে শব্দ নিয়ে তার সাহিত্যিক গুণাগুণ বিচার করার বিষয় না। আইনের বিষয় খুবই স্পেসিফিক হতে হবে। যেটা যেভাবে বলা হয়েছে, সেটাকে সেভাবেই উপস্থাপন করতে হবে। আইনের বিষয়ে স্পেসিফিক ডেফিনিট হতে হয়। অতএব এটা কাঙ্খিত না," বলেন মি. হুদা।
ফলে আইন শৃঙ্খলা বাহিনীর পক্ষ থেকে এ ধরনের বক্তব্য না দেয়া সমুচিত বলে মনে করেন পুলিশের সাবেক এই কর্মকর্তা।
তবে এ ধরনের বিষয় ভুক্তভোগীর বিচার প্রাপ্তিতে প্রভাব ফেলবে না বলে মনে করেন মি. হুদা।

ছবির উৎস,Getty Images
আইনেই রয়েছে ধর্ষণের সংজ্ঞা
ডিএমপি কমিশনার ধর্ষণ শব্দটিকে পরিহার করতে তার দেয়া বক্তব্যের জন্য সোমবার দুঃখপ্রকাশ করে একটি বিবৃতি দিয়েছেন।
ডিএমপির মিডিয়া ও পাবলিক রিলেশনস দপ্তর থেকে পাঠানো এ বিবৃতিতে মি. আলী বলেন, "নারী ও শিশু নির্যাতন প্রসঙ্গে আলোচনাকালে ধর্ষণকে বৃহত্তর পরিসরে নির্যাতন হিসেবে অভিহিত করেছি। আমার বক্তব্যে কেউ মনঃক্ষুন্ন হলে আমি দুঃখ প্রকাশ করছি।"
তবে আইনজীবীরা বলছেন বাংলাদেশের আইনানুযায়ী ধর্ষণকে বৃহত্তর পরিসরে নির্যাতন হিসেবে বিবেচনা করা যাবে না।
কারণ আইনে এ অপরাধকে সুনির্দিষ্টভাবে সংজ্ঞায়িত করা হয়েছে। নারী নির্যাতন বা নিপীড়ন বলে ধর্ষণের মতো অপরাধকে আড়াল করার সুযোগ নেই।
সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী ইশরাত হাসান বিবিসি বাংলাকে বলেন, "ইন জেনারেলি ধর্ষণ অবশ্যই নারী নির্যাতনের মধ্যে পড়ে। কিন্তু দণ্ডবিধির ৩৭৫ ধারায় ধর্ষণকে অপরাধ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে।"
আর নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইন - ২০০০ এ 'ধর্ষণ' কে সুনির্দিষ্টভাবে অপরাধ হিসেবে সংজ্ঞায়িত করে সর্বোচ্চ শাস্তির বিধানও রাখা হয়েছে।
আইনের একটি ধারায় বলা হয়েছে, যদি কোন পুরুষ কোন নারী বা শিশুকে ধর্ষণ করে, তাহলে তিনি মৃত্যুদণ্ড বা যাবজ্জীবন সশ্রম কারাদণ্ডে দণ্ডিত হবেন। একইসাথে অর্থদণ্ডের বিধানও রাখা হয়েছে।
আইনে ধর্ষণের ব্যাখ্যা হিসেবে বলা হয়েছে, "যদি কোন পুরুষ বিবাহ বন্ধন ব্যতীত (ষোল বছরের) অধিক বয়সের কোন নারীর সাথে তার সম্মতি ছাড়া বা ভীতি প্রদর্শন বা প্রতারণামূলকভাবে তার সম্মতি আদায় করে অথবা ষোল বছরের কম বয়সের কোন নারীর সাথে তার সম্মতিসহ বা সম্মতি ছাড়া যৌন সঙ্গম করেন, তাহলে তিনি উক্ত নারীকে ধর্ষণ করেছেন বলে গণ্য হবেন।"
আইনজীবী মিজ হাসান মনে করেন, " দায়িত্বশীল পদে থেকে ধর্ষণের মতো অপরাধের বিষয়ে এভাবে কথা বললে সাধারণ মানুষ বিভ্রান্ত হতে পারেন।"
বৃহত্তর পরিসরে নারী নির্যাতনের আওতায় ধর্ষণকে সংজ্ঞায়িত না করার কারণ হিসেবে মিজ হাসান বলেন, " এটা নারীর সাথে সংগঠিত এমন একটা অপরাধ যেটার শাস্তি মৃত্যুদণ্ড, তখন সেটিকে ঢেকে বলার কিছু নেই। সাধারণ নারী নির্যাতনে শারীরিক নির্যাতন হয়, কিন্তু ধর্ষণে শুধু শারীরিক নির্যাতনই নয়, বলা হয় নারীর আত্মাকেও নির্যাতন করা হয়। ধর্ষণ, ধর্ষণই। "