Image description

হামজা চৌধুরী। হবিগঞ্জের সন্তান। বৃহত্তর সিলেটের তরুণ তুর্কি। ইংলিশ প্রিমিয়ার লীগে লেস্টার সিটির হয়ে খেলার সময় নজর কাড়েন ফুটবল দুনিয়ার। বৃটেনের বাঙালি কমিউনিটিতে তাকে ঘিরে তৈরি হয় উচ্ছ্বাস-উন্মাদনা। এই উচ্ছ্বাস আর উম্মাদনার ঢেউ সাত সমুদ্র তেরো নদী পাড়ি দিয়ে এসে  পৌঁছেছে হামজার পিতৃভূমিতে। দেশের ফুটবলের হয়ে লড়তে এই তরুণ ছুটে এসেছেন দেশে। লন্ডন থেকে সরাসরি সিলেটে পৌঁছে ছুটে যান হবিগঞ্জের বাহুবলে। বিমানবন্দর থেকে বাহুবল, সর্বত্র তাকে ঘিরে অন্য এক উন্মাদনা, উচ্ছ্বাস। ফুটবলপ্রেমীদের ভালোবাসায় সিক্ত হামজা খুব বেশি কথা বলার সুযোগ পাননি। তবে  দেশের হয়ে খেলে জয়ী হওয়ার আবেগময় বার্তা দিয়েছেন নিজের ভাষায়।

লেস্টার সিটি ছেড়ে হামজা এখন শেফিল্ডে। খেলছেন নিয়মিত। ক্লাবের অন্যতম তারকা তিনি। সবার নজর তার দিকে। সেই হামজা এবার খেলবেন বাংলাদেশের হয়ে। লাল-সবুজের জার্সিতে। আগামী মঙ্গলবার ভারতের বিপক্ষে হবে তার অভিষেক।

সোমবার বাংলাদেশ সময় রাত দু’টায় বাংলাদেশ বিমানের ফ্লাইটে ম্যানচেস্টার থেকে সিলেটের উদ্দেশ্যে রওনা হন হামজা। স্মরণীয় এ সফরে তার সঙ্গী মা, স্ত্রী ও সন্তানেরা। বাংলাদেশে ১১.৪০ মিনিটে হামজাকে বহনকারী বিমানটি সিলেট ওসমানী আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে অবতরণ করেন। এর আগেই সিলেটে হামজাকে রিসিভ করতে আসা বাফুফের এক কর্মকর্তা বলেন, এতটা আশাবাদী ছিলাম না আমরা। হামজা আসবে। দেশের কথা শুনলেই অনেকেই চোখ ফিরিয়ে নেন। কিন্তু হামজা ব্যতিক্রম। বাংলাদেশের হয়ে খেলার প্রস্তাবে সাড়া দিলেন। দেশকেই দিলেন প্রাধান্য। নাগরিকত্ব জটিলতা কাটিয়ে হামজা হয়ে ওঠেন বাংলাদেশের একজন। এখন তিনি বাংলাদেশ ফুটবলের মহাতারকা। ছোটবেলায় পিতা মোর্শেদ দেওয়ান চৌধুরীর সঙ্গে দেশে এসেছিলেন। এবার এলেন বহুদিন পর। তারকা হয়ে। বাংলাদেশের মুখ উজ্জ্বল করতে তার এই আসা। সিলেট বিমানবন্দরের ভিআইপি গেট দিয়ে বেরিয়ে যাওয়ার সিঁড়িতে পৌঁছাতে পৌঁছাতেই ভিড়ে চিঁড়েচ্যাপটা হওয়ার জোগাড় হামজা চৌধুরীর। বাফুফে কর্মকর্তা, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী আর উৎসুকদের ফাঁক গলে যখন সামনে এলেন, চোখের সামনে শত শত ক্যামেরা, মুঠোফোন আর মানুষের ভিড়। সবাই হামজার কাছ থেকে কিছু শুনতে চান। কিন্তু হামজা শোনাবেন কী, চারপাশের শব্দে কান ঝালাপালা হওয়ার অবস্থা। কে কী বলছে, বোঝা ভার। মিনিট তিনেক ধরে সবাইকে শান্ত করার চেষ্টা চালালেন হামজার আশপাশে থাকা কয়েকজন। হামজার দেশে ফেরা নিয়ে গত কয়েকদিন দেশের ফুটবলে আলোড়ন উঠলেও বিমানবন্দরে সংবাদ সম্মেলনের কোনো ব্যবস্থা করেনি বাংলাদেশ ফুটবল ফেডারেশন (বাফুফে)। প্রিন্ট, অনলাইন ও ইলেকট্রনিক গণমাধ্যমকর্মীদের পাশাপাশি প্রচুর ইউটিউবার ক্যামেরা হাতে বিমানবন্দরে হাজির হন। হামজাকে অভিনন্দন জানানো ব্যানার নিয়ে হাজির হওয়া সমর্থকেরাও জড়ো হন একই জায়গায়। সব মিলিয়ে বিমানবন্দরের ভিআইপি প্রবেশপথের সামনে বিশৃঙ্খল পরিস্থিতি তৈরি হয়। হামজার বাংলাদেশ দলে অভিষেক হওয়ার কথা রয়েছে আগামী মঙ্গলবার এশিয়ান কাপ বাছাইপর্বে ভারতের বিপক্ষে ম্যাচ দিয়ে। এ বিষয়ে জিজ্ঞাসা করা হলে প্রথমে হট্টগোলের কারণে বুঝতেই পারেননি হামজা। নিজেই পাল্টা জিজ্ঞাসা করেন, ‘আমি বুঝছি না, বুঝছি না।, এরপর আবার বুঝিয়ে বললে হামজা বলেন, ‘ইনশাআল্লাহ্‌ আমরা উইন খরমু। আমার বড় স্বপ্ন আছে। কোচ হাভিয়েরের সঙ্গে কাজ করবো। ইনশাআল্লাহ্‌ আমরা উইন করিয়া প্রোগ্রেস করতে পারমু।’ এরপর আরও প্রশ্নের উত্তর দিতে চেয়েছিলেন হামজা।

তবে বাফুফে কর্মকর্তারা তাকে সরিয়ে নিয়ে যান। সিলেট বিমানবন্দর থেকে পরিবারের সদস্যদের নিয়ে হবিগঞ্জের দিকে রওনা দেন হামজা। একফাঁকে বেরিয়ে আসেন হামজার পিতা বাহুবলের স্নানঘাটের সন্তান মোর্শেদ আহমদ চৌধুরী। সাংবাদিকের কাছে অনুভুতি জানাতে গিয়ে বলেন; হামজা দেশকে ভালোবাসে। সে ফুটবলের উন্নতি চায়। এর এই ভালোবাসা থেকে তার দেশে আসা। এজন্য তিনি দেশবাসীর কাছে দোয়াও চান। হামজার সঙ্গে এবার দেশে এসেছেন তার পরিবারের প্রায় সবাই। স্ত্রী -সন্তানও। ছাদখোলা জিপে করে এয়ারপোর্টের ভিআইপি’র সামনে থেকে বাড়ির উদ্দেশ্যে রওয়ানা দেন হামজা চৌধুরী। তখনও উৎসব চলছিল বাইরে। হামজা সবার উদ্দেশ্যে হাত নেড়ে হাসি দিয়ে রওয়ানা দিলেন হবিগঞ্জের পথে। হামজা গতকাল বিকাল ৩ টায় বাহুবলের নিভৃত জনপদ স্নানঘাট গ্রামে প্রবেশ করেন।  সেহ্‌রির খাওয়ার পর থেকেই মূলত দু’-একজন করে লোক আসতে শুরু করে হামজা চৌধুরীদের গ্রামের বাড়িতে। বেলা গড়ানোর সঙ্গে সঙ্গে ইট-সিমেন্টের প্রাচীরে ঘেরা বাড়ি লোকে লোকারণ্য হয়ে ওঠে। সেখানে নারী, শিশুসহ সব বয়সী মানুষ ছিলেন। সবাই উদগ্রীব; কখন দেখা মিলবে ঝাঁকড়া চুলের বাবরি দোলানো সেই টগবটে তরুণ তুর্কির। এক সময় প্রহর গুনা শেষ হয়। নিশ্ছিদ্র নিরাপত্তা বেষ্টনীর মধ্য দিয়ে তিনি বাড়িতে প্রবেশ করেন বাড়িতে। সবাই হুমড়ি খেয়ে পড়লো তাকে এক নজর দেখার জন্য। একপর্যায়ে জনমানুষের এ স্রোত স্বেচ্ছাসেবী ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর লোকজন আর সামাল দিতে পারলেন না। এ অবস্থায়ই ঘণ্টার পর ঘণ্টা দাঁড়িয়ে থাকা ভক্ত, অনুরাগী, পাড়া-প্রতিবেশী, স্বজন-পরিজনরা ফুলের তোড়া দিয়ে এবং ফুল ছিটিয়ে তাকে বরণ করে নেয়। এ সময় ‘হামজা’ ‘হামজা’ স্লোগানে মুখরিত হয়ে ওঠে গোটা এলাকা। হামজা চৌধুরী তখন ‘আই প্রাউড’, ‘ইমেজিং’ ইত্যাদি ইংরেজি শব্দ বলে সমবেত লোকজনের ভালোবাসার জবাব দেন।
বিকাল ৩টা ৪০ মিনিটে তার জন্য বাড়ির উঠানে স্থাপিত অস্থায়ী মঞ্চে কথা বলার জন্য তাকে তোলা হয়। এ সময় ‘হামজা’ ‘হামজা’ স্লোগান দিতে দিতে বাঁধভাঙা মানুষের ঢল আছড়ে পড়ে ছোট্ট মঞ্চের উপর। আয়োজকরা এ পরিস্থিতি সামাল দিতে হিমশিম খেতে থাকেন। এ সময় লোকজনকে আশপাশের বাড়িঘরের ছাদ, চাল ও গাছের ডালে ঝুলে উঁকি দিয়ে হামজা চৌধুরীকে দেখার চেষ্টা করেন। সব বাধা ঢেলে বিপুলসংখ্যক মানুষ মঞ্চের উপর উঠে পড়লে সবকিছু এলোমেলো হয়ে যায়। এ অবস্থায় মাইক্রোফোনের কাছে গিয়ে হামজা চৌধুরী সবার উদ্দেশ্যে কথা বলেন, ‘আস্‌সালামুআলাইকুম, আমার খুব ভালা লাগছে, আপনারা হকলে আইছন আমারে দেখার লাগি।’ এককথা বলে তিনি ‘বাংলাদেশ-জিন্দাবাদ’ বলে স্লোগান দিতে শুরু করেন। এ সময় সমবেত লোকজনও তার সঙ্গে সঙ্গে স্লোগানে স্লোগানে দেশপ্রেমের আবহ তৈরি করেন। একপর্যায়ে সবাইকে ইংরেজিতে অভিবাদন জানিয়ে তার ও বাংলাদেশ ফুটবল দলের ভারত জয়ের জন্য দোয়া চেয়ে কথা বলা শেষ করেন। এ সময় সমবেত লোকজন ‘বাংলাদেশ, বাংলাদেশ’ বলে স্লোগান দিতে থাকেন।

এর আগে হামজা চৌধুরীকে বহনকারী গাড়িবহর ঢাকা-সিলেট মহাসড়কের বাহুবল উপজেলার পুটিজুরী বাজারে পৌঁছলে সেখান থেকে মোটরসাইকেল শোভাযাত্রার মাধ্যমে তাকে গ্রামে নিয়ে যাওয়া হয়। এ সময় রাস্তায় দাঁড়িয়ে থেকে স্থানীয় লোকজন হাত উঁচিয়ে এবং ফুল ছিটিয়ে তাকে স্বাগত জানায়। এ সময় তিনিও হুডখোলা গাড়িতে দাঁড়িয়ে হাত নেড়ে স্থানীয় লোকজনকে জবাব দেন।