Image description

পুঁজিবাজার নিয়ন্ত্রক সংস্থা বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশনের (বিএসইসি) চেয়ারম্যান খন্দকার রাশেদ মাকসুদসহ তিন কমিশনারকে তাদের বোর্ড রুমে দীর্ঘ চার ঘণ্টা আটকে রেখে নানাভাবে লাঞ্চিত করেছেন কর্মকর্তারা। এ সময় তারা পুরো বিএসইসির সিসি ক্যামেরা বন্ধ করে দেন। এমনকি বোর্ড রুমের এসি এবং লাইট বন্ধ করে দেওয়া হয়। ফলে পুরো কমিশন অন্ধকারাচ্ছন্ন হয়ে পড়ে। একইসঙ্গে বোর্ড রুমে শতাধিক কর্মকর্তা-কর্মচারী ঢুকে অকথ্য ভাষায় চেয়ারম্যান ও কমিশনারদের গালি-গালাজ করেন।

রোববার (১৬ মার্চ) কমিশনের চেয়ারম্যান খন্দকার রাশেদ মাকসুদসহ তিন কমিশনার সারাবাংলাসহ কয়েকটি গণমাধ্যমকে বিষয়টি অবহিত করেন। সেদিনের ঘটনার বর্ণনা দিতে গিয়ে চেয়ারম্যানসহ একাধিক কমিশনার আবেগে আপ্লুত হয়ে পড়েন। এ সময় একাধিক কমিশনারের চোখে জল টলমল করছিল।

তারা জানান, দীর্ঘ চার ঘণ্টা বোর্ড রুমের লাইট ফ্যান ও এসি বন্ধ রাখায় তারা সাফোকেশনের (দমবন্ধ) শিকার হন। এ সময় কমিশনার আলী আকবর অসুস্থ হয়ে পড়েন, একই অবস্থা হয় অপর দুই কমিশনার মু. মোহসিন চৌধুরী ও ফারজানা লালারুখের। তারা বারবার এসি চালু করে কথা বলার দাবি জানালেও কর্মকর্তারা কর্ণপাত করেননি। উচ্ছৃঙ্খল কর্মকর্তারা চেয়ারম্যান ও তিন কমিশনারকে লক্ষ্য করে এ সময় সাউন্ড বক্স ছুড়ে মারেন, টিস্যুর ভেতরে ময়লা ঢুকিয়ে ঢিল মারেন। এমনকি ডিম দিয়েও ঢিল দেন। শুধু তাই নয়, বিএসইসির কর্মকর্তারা অশ্লীল ভাষায় গালিগালাজ করেন এবং তাদের পদত্যাগ করতে চাপ দেন বলে জানিয়েছেন কমিশনাররা।

জানা গেছে, বিএসইসির কর্মকর্তারা চেয়ারম্যান ও কমিশনারদের অবরুদ্ধ করার আগে সংস্থাটির মেইন গেট বন্ধ করে দেন। সেইসঙ্গে তারা ভেতরে থাকা সমস্ত দর্শনার্থীদের কমিশন থেকে বের করে দেন। এমনকি বাহির থেকে কোনো দর্শনার্থীর ভেতরে প্রবেশেও বাধা দেন। এ ছাড়া, প্রতিটি ফ্লোরের কলাপসিবল গেইট ও দরজা তালা মেরে দেওয়া হয়। যাতে কেউ ভেতর থেকে বাইরে যেতে না পারেন, এবং বাহির থেকে কেউ ভেতরে ঢুকতে না পারেন। এভাবে তারা পুরো কমিশনের নিয়ন্ত্রণ নেন। ফলে আইন-শৃঙ্খলাবাহিনীও ভেতরে প্রবেশ করত পারেনি। পরবর্তী সময়ে সেনাবাহিনীর সদস্যরা এসে দেয়াল টপকে এবং বিভিন্ন গেট ভেঙে ভেতরে ঢুকে চেয়ারম্যান এবং কমিশনারদের উদ্ধার করেন।

এর আগে বিএসইসির চেয়ারম্যানের ব্যক্তিগত কর্মকর্তাকে (পিএস) শারীরিকভাবে লাঞ্ছিত করেন এবং তার শার্ট ছিঁড়ে ফেলেন। চার ঘণ্টা পর সেনাবাহিনী উপস্থিত হলে তারা সেনাবাহিনীর সদস্যদের অকথ্য ভাষায় গালিগালাজ করেন।— চেয়ারম্যানসহ তিন কমিশনার বিষয়টি গণমাধ্যমকে নিশ্চিত করে বলেন, ‘সেনাবাহিনীর যে ধৈর্যের পরিচয় দিয়েছে, তা বিরল ঘটনা।’

এ ব্যাপারে বিএসইসির চেয়ারম্যান খন্দকার রাশেদ মাকসুদ বলেন, ‘বিএসইসিতে যে ঘটনা সংঘটিত হয়েছে তা মারাত্মক। যেটা দেশে-বিদেশে বাংলাদেশের ভাবমূর্তি চরমভাবে ক্ষুন্ন করেছে। এ ধরণের ঘটনা ন্যাক্কারজনক। পৃথিবীতে কোনো রেগুলেটরি সংস্থায় এমন ঘটনা প্রথম ঘটল। এটা জাতীয় জীবনে চরম দুঃখজনক অধ্যায়। বিএসইসির সামগ্রিক ঘটনার ব্যাপারে সরকারের সর্বোচ্চ কর্তৃপক্ষের পাশাপাশি বিভিন্ন এজেন্সিও অবগত আছে।’

গত ৫ মার্চ সংগঠিত ঘটনাকে চরম অনভিপ্রেত উল্লেখ করে বিএসইসির চেয়ারম্যান খন্দকার রাশেদ মাকসুদ বলেন, ‘কিছু উচ্ছৃঙ্খল কর্মচারীর প্ররোচণায়, ইন্ধনে ও অংশগ্রহণে এটি সংগঠিত হয়েছে। এ ঘটনা প্রশাসনিক শৃঙ্খলা ভঙ্গের পাশাপাশি গুরুতর ফৌজদারি অপরাধ।’

বিএসইসিসি চেয়ারম্যানসহ তিন কমিশনার রোববার সাংবাদিকদের বলেন, কমিশনের কর্মকর্তারা প্রতিবছর দুই থেকে তিন কোটি টাকা খরচ করে কক্সবাজারে গিয়ে ফাইভ স্টার হোটেলে পিকনিক করতেন। এসব টাকা কমিশনের সিএসআর ফান্ড এবং বিভিন্ন কোম্পানি থেকে সংগ্রহ করছেন, যা একেবারেই অনৈতিক। এবারও তারা একই আবেদন করেছিলেন, কিন্তু কমিশন তা আমলে নেয়নি। এ কারণে কর্মকর্তারা কমিশনের ওপর অসন্তুষ্ট ছিলেন। এ ছাড়াও, মশিউর সিকিউরিটিজসহ বেশ কয়েকটি বোকারেজ হাউজের অনিয়ম পরিদর্শনে ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জ থেকে সার্ভিলেন্স টিম পাঠানো হলেও বিএসইসির কর্মকর্তা লিখিতভাবে তাদের ওই হাউজগুলো পরিদর্শনে বাধা দেন। এতে করে ওই হাউজগুলোর বিনিয়োগকারীরা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন।

এ ছাড়া, কর্মকর্তারা এক কোটি বিশ লাখ টাকা হাউজ লোন নিয়ে তারা নিয়ম বহির্ভূতভাবে বিভিন্ন জায়গায় জমি কেনেন। পাশাপাশি কমিশনের মিটিংয়ে নেওয়া সিদ্ধান্ত পরবর্তী সময়ে পরিবর্তনেরও গুরুতর অভিযোগ উঠেছে কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে। এসব অভিযোগের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে চাইলে কর্মকর্তারা ক্ষুব্ধ হয়ে ওঠেন বলে জানান চেয়ারম্যান ও তিন কমিশনার।

ফলে গত ৫ মার্চ চেয়ারম্যানসহ তিন কমিশনারকে অবরুদ্ধ করে রাখেন বিএসইসির কর্মকর্তারা। পরদিন বৃহস্পতিবার (৬ মার্চ) রাতে বিএসইসি চেয়ারম্যানের গানম্যান মো. আশিকুর রহমান বাদী হয়ে শেরেবাংলা নগর থানায় ১৬ জনকে আসামি করে মামলা করেন। মামলা ১৬ আসামির মধ্যে এরই মধ্যে একজন পরিচালক গ্রেফতার হয়েছেন। আর একজন নির্বাহী পরিচালক পদত্যাগ করেছেন ।

মামলার এজাহারে জানা যায়, বৃহস্পতিবার (৬ মার্চ) বিএসইসি চেয়ারম্যান খন্দকার রাশেদ মাকসুদের সভাপতিত্বে এবং কমিশনার মো. মহসিন চৌধুরী, মো. আলী আকবর ও ফারজানা লালারুখের উপস্থিতিতে কমিশনের নির্ধারিত সভাকক্ষে সভা চলছিল। এ সময় কিছু কর্মকর্তা-কর্মচারী কমিশনের সভাকক্ষে জোরপূর্বক প্রবেশ করে কমিশনের চেয়ারম্যান ও কমিশনারদের অবরুদ্ধ করেন। এর মধ্যে কেউ কেউ কমিশনের মূল ফটকে তালা লাগিয়ে দেন। সিসি ক্যামেরা, ওয়াই-ফাই, কমিশনের লিফট বন্ধ করে দেয়। এমনকি বৈদ্যুতিক সংযোগ বন্ধ করে দিয়ে অরাজকতা ও ভীতিকর পরিস্থিতি সৃষ্টি করে হামলা শুরু করে। কমিশন চেয়ারম্যানের ওপর বারবার আক্রমণ করতে যান তারা।

মামলার এজাহারে উল্লেখ করা হয়েছে, আসামিরা অকথ্য ভাষা ব্যবহার করে ও এসির রিমোট চেয়ারম্যান ও কমিশনারদের লক্ষ্য করে ছুড়ে মারে এবং বিভিন্নভাবে পেশি শক্তির মাধ্যমে ভয়-ভীতি প্রদর্শন করে। একইসঙ্গে তারা কমিশনের চেয়াম্যানের একান্ত সচিব (সরকারের সিনিয়র সহকারী সচিব) মো. জাহাঙ্গীর হোসেনকে লাঞ্চিত করে। আসামিরা কমিশনের সাবেক নির্বাহী পরিচালক সাইফুর রহমানের বাধ্যতামূলক অবসরের আদেশ প্রত্যাহার করতে বলে। কমিশনের কিছু কর্মকর্তা-কর্মচারীর বিরুদ্ধে বিভাগীয় ব্যবস্থা গ্রহণের কারণ দর্শানোর আদেশ প্রত্যাহার করতেও বলে। গঠিত তদন্ত কমিটি রিপোর্টের ভিত্তিতে ব্যবস্থা গ্রহণ না করার দাবিতে সন্ত্রাসী কায়দায় সরকারি অফিস কক্ষ ভাঙচুর করে ও সরকারি কাজে বাধা দেয়।

এজাহারে আরও বলা হয়, বিগত দিনের পুঁজিবাজারের অনিয়ম অনুসন্ধানে বিএসইসি পুঁজিবাজারে অভিজ্ঞ পাঁচজনের সমন্বয়ে গত বছরের ১ সেপ্টেম্বর একটি অনুসন্ধান ও তদন্ত কমিটি গঠন করে। সেই অনুসন্ধান ও তদন্ত কমিটি অনিয়ম চিহ্নিত করে তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার সুপারিশ করে। কমিশন সেই অনুসন্ধান ও তদন্ত কমিটির রিপোর্ট এবং রিপোর্টের সুপারিশের সূত্রে অনিয়মের সঙ্গে জড়িতদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণে পদক্ষেপ নেয়। তারই অংশ হিসেবে কমিশনের কয়েকজন কর্মকর্তা ও কর্মচারীকে কারণ দর্শানোর জন্য বলা হয়েছে। কমিশনের সাবেক নির্বাহী পরিচালক সাইফুর রহমান বিভিন্ন অনিয়ম ও দুর্নীতিতে জড়িত থাকায় কমিশন তাকে চাকুরি থেকে অবসর দিয়েছে।

মামলার এজাহারে আরও উল্লেখ করা হয়েছে, আসামিদের কয়েকজনের বিরুদ্ধে দুর্নীতি দমন কমিশনে বিভিন্ন বিষয়ে অনুসন্ধান চলমান আছে। সাবেক নির্বাহী পরিচালক সাইফুর রহমান, নির্বাহী পরিচালক মাহবুবুল আলম, নির্বাহী পরিচালক রেজাউল করিম, পরিচালক শেখ মাহবুব-উর-রহমান, অতিরিক্ত পরিচালক মোহাম্মদ মাহমুদুল হক, অতিরিক্ত পরিচালক এস কে মো. লুৎফুল কবির ও যুগ্ম পরিচালক মো. রশীদুল আলমের বিরুদ্ধে শেয়ার কেলেঙ্কারিসহ পুঁজিবাজারে লুটপাটের সহায়তা করে অবৈধ সম্পদ গড়ার অভিযোগে তাদের পাসপোর্ট বাতিল করে দেশ ত্যাগের নিষেধাজ্ঞা ও ব্যাংক হিসাব জব্দ করা হয়েছে।

ফলে কমিশনের চেয়ারম্যান ও কমিশনারদেরকে অবরুদ্ধ করে বিভিন্ন অশোভন স্লোগান, অকথ্য ভাষা ব্যবহার এবং পেশিশক্তির মাধ্যমে ভয়-ভীতি প্রদর্শন করতে থাকে। এ ভীতিকর পরিস্থিতি চলে প্রায় চার ঘণ্টা। কমিশনের চেয়ারম্যান ও কমিশনাররা অবরুদ্ধ থাকার খবরে ও বিএসইসি একটি গুরুত্বপূর্ণ তথ্য পরিকাঠামো প্রতিষ্ঠান হওয়ায় প্রথমে পুলিশ ও পরবর্তী সময়ে সেনাবাহিনী বিএসইসিতে অবস্থান নিয়ে চেয়ারম্যান ও কমিশনারদের জিম্মি অবস্থা থেকে মুক্ত করে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনে।

সারাবাংলা