Image description

গত বছর প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ক্ষমতাচ্যুতির মধ্য দিয়ে বাংলাদেশের রাজনৈতিক পট পরিবর্তন হয়েছে। রাজনীতিতে এসেছে অনেক চমক। যার মধ্যে অন্যতম হলো ‘ঢাকা ও একসময়ের শত্রু পাকিস্তানের’ মধ্যে ক্রমবর্ধমান ঘনিষ্ঠতা। গত মাসে কয়েক দশকের টানাপোড়েনের পর, প্রথমবারের মতো দুই দেশ সরাসরি বাণিজ্য শুরু করেছে।  ঢাকা পাকিস্তান থেকে ৫০ হাজার টন চাল আমদানি করেছে। এছাড়া সরাসরি ফ্লাইট ও সামরিক যোগাযোগ পুনরায় চালু হয়েছে। ভিসা প্রক্রিয়া সহজ করা হয়েছে এবং নিরাপত্তা বিষয়েও সহযোগিতার খবর পাওয়া যাচ্ছে।

ভারতীয় ভূখণ্ড দ্বারা পৃথক এই দুটি দেশের মধ্যে গভীর ও বেদনাদায়ক ঐতিহাসিক সম্পর্ক রয়েছে। তাদের মধ্যে বৈরিতা ১৯৭১ সালে শুরু হয়, যখন তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান (বাংলাদেশ) স্বাধীনতার জন্য পাকিস্তানের বিরুদ্ধে সংগ্রাম শুরু করে। নয় মাসব্যাপী সেই যুদ্ধে বাঙালি বিদ্রোহীদের সমর্থন করেছিল ভারত, যার ফলে বাংলাদেশের জন্ম হয়।

PAK BDপাকিস্তান থেকে চাল আমদানির জন্য বাংলাদেশের সঙ্গে চুক্তি। ছবি: ফিনান্সিয়াল এক্সপ্রেস।

 

বাংলাদেশের একজন সাবেক সিনিয়র কূটনীতিক হুমায়ুন কবীর বলেন, গত ১৫ বছর ধরে বাংলাদেশ-পাকিস্তান সম্পর্ক কিছুটা কঠিন অবস্থায় ছিল। এখন সম্পর্ক দুই সাধারণ প্রতিবেশীর পর্যায়ে ফিরে যাচ্ছে বলে মনে হচ্ছে।

এই ঘটনাগুলো খুব ঘনিষ্ঠভাবে পর্যবেক্ষণ করা হচ্ছে, বিশেষ করে ভারতে, যার সঙ্গে আবার পাকিস্তানের দীর্ঘ বৈরী সম্পর্ক রয়েছে।

শেখ হাসিনার ক্ষমতাচ্যুতি পর থেকে ঢাকা-দিল্লি সম্পর্কও শীতল হয়ে গেছে। বাংলাদেশ তাকে মানবতাবিরোধী অপরাধ, অর্থপাচার ও দুর্নীতির অভিযোগে বিচারের জন্য প্রত্যর্পণের দাবি জানালেও, দিল্লি কোনও প্রতিক্রিয়া দেখায়নি। হাসিনা তার বিরুদ্ধে আনা অভিযোগ অস্বীকার করেছেন।
কিছু বিশ্লেষক মনে করেন, ঢাকা-ইসলামাবাদ সম্পর্কের পুনরুজ্জীবন একটি কৌশলগত পদক্ষেপ।

পাকিস্তানি শিক্ষাবিদ ও লন্ডনের কিংস কলেজের সিনিয়র ফেলো আয়েশা সিদ্দিকা বলেন, পাকিস্তান ও বাংলাদেশের মধ্যে বর্তমানে একটি কৌশলগত সম্পর্ক তৈরি হয়েছে। তারা একসঙ্গে ভারতের প্রভাব বিস্তারের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়তে চায়। 

সরাসরি বাণিজ্য শুরুর পাশাপাশি আরও কিছু গুরুত্বপূর্ণ উন্নয়ন ঘটেছে।

বাংলাদেশের অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান মুহাম্মদ ইউনূস সাম্প্রতিক মাসগুলোতে বহু-পাক্ষিক ফোরামে একাধিকবার পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী শাহবাজ শরিফের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেছেন। এছাড়াও ক্রমবর্ধমান সামরিক সম্পর্কের বিষয়টিও গুরুত্বপূর্ণ।

জানুয়ারিতে একটি উচ্চপর্যায়ের বাংলাদেশি সামরিক প্রতিনিধি দল বিরল এক সফরে পাকিস্তান গিয়েছিল এবং প্রভাবশালী সেনাপ্রধান জেনারেল আসিম মুনিরের সঙ্গে বৈঠক করেছে। ফেব্রুয়ারিতে করাচির উপকূলে পাকিস্তানের আয়োজিত একটি বহুজাতিক সামুদ্রিক মহড়ায় বাংলাদেশ নৌবাহিনীও অংশ নিয়েছে।

২০০৩ থেকে ২০০৬ সাল পর্যন্ত বাংলাদেশে ভারতের হাই কমিশনার হিসেবে দায়িত্ব পালন করা বিনা সিক্রি বলেন, তার ঢাকায় কর্মকালীন সময়ে ভারত বারবার বাংলাদেশের ভেতরে পাকিস্তানের গোয়েন্দা সংস্থা (আইএসআই)-এর সহায়তায় ভারতীয় বিদ্রোহীদের প্রশিক্ষণ বিষয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছিল।

তবে সেই সময় পাকিস্তান ও বাংলাদেশের কর্তৃপক্ষ এসব অভিযোগ অস্বীকার করেছিল।

ভারত ও বাংলাদেশের দীর্ঘ, ঝুঁকিপূর্ণ সীমান্ত থাকার কারণে ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলের সশস্ত্র বিদ্রোহী গোষ্ঠীগুলোর পক্ষে বাংলাদেশে প্রবেশ করা তুলনামূলকভাবে সহজ। তবে ২০০৯ সালে শেখ হাসিনার আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় আসার পর এই গোষ্ঠীগুলোর বিরুদ্ধে কঠোর অভিযান চালিয়ে তাদের ঘাঁটি ধ্বংস করা হয়।

ফলে বাংলাদেশ ও পাকিস্তানের সামরিক সম্পর্কের পুনরুজ্জীবনকে ভারত ‘গুরুত্বপূর্ণ নিরাপত্তা উদ্বেগ’ হিসেবে দেখছে বলে জানান বিনা সিক্রি।
ইউনূস প্রশাসনের প্রেস অফিস ভারতীয় সংবাদমাধ্যমের সেই প্রতিবেদন সরাসরি প্রত্যাখ্যান করেছে যেখানে দাবি করা হয়েছিল যে পাকিস্তানের আইএসআই-এর শীর্ষ কর্মকর্তারা ঢাকা সফর করেছেন। তারা আরও বলেছে, বাংলাদেশের ভেতরে একটি ভারতীয় বিদ্রোহী গোষ্ঠীর ক্যাম্প পুনরায় চালু করতে পাকিস্তানের গোপন তৎপরতা চালানোর অভিযোগ ‘ভিত্তিহীন’।

ভারতের উদ্বেগ নিয়ে পাকিস্তানের সেনাবাহিনী বিবিসির প্রশ্নের কোনও উত্তর দেয়নি।

বিশ্লেষকদের মতে, বাংলাদেশের রাজনীতিবিদরা জানেন যে ঘনিষ্ঠ অর্থনৈতিক ও ভাষাগত সম্পর্কের কারণে ঢাকা ভারতের বিরুদ্ধে অবস্থান নিতে পারবে না।

এদিকে দিল্লির উদ্বেগ থাকা সত্ত্বেও বাংলাদেশি কূটনীতিকরা মনে করেন, ১৯৭১ সালের যুদ্ধ সম্পর্কিত বিষয়গুলোর সমাধান না হলে পাকিস্তানের সঙ্গে সম্পর্ক স্বাভাবিক করা সম্ভব নয়।

বাংলাদেশ যুদ্ধকালীন নৃশংসতার জন্য পাকিস্তানের কাছ থেকে আনুষ্ঠানিক ক্ষমা প্রার্থনা দাবি করলেও ইসলামাবাদ এ বিষয়ে কোনও আগ্রহ দেখায়নি।

কূটনীতিক হুমায়ুন কবীর বলেন, পাকিস্তানের উচিত স্বাধীনতা যুদ্ধ চলাকালীন সংঘটিত অপরাধগুলোর দায় স্বীকার করা। 

এমনকি পাকিস্তানের সাবেক সামরিক কর্মকর্তারা, যেমন ইকরাম সেহগালও স্বীকার করেন যে, দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কের প্রধান অন্তরায় হলো বাংলাদেশের দাবি যে পাকিস্তানকে ১৯৭১ সালের ঘটনার জন্য ক্ষমা চাইতে হবে।

তবে অবসরপ্রাপ্ত পাকিস্তানি সেনা মেজর সেহগাল দাবি করেন, স্বাধীনতা সংগ্রামের সময় বাঙালিদের হাতে উর্দুভাষী বিহারিদের ওপর হামলার বিষয়টিও বাংলাদেশকে সমাধান করতে হবে।

ইতিহাস ঢাকাকে ইসলামাবাদের সঙ্গে সম্পর্ক উন্নয়নের পথে বাধা সৃষ্টি করলেও অর্থনীতিবিদরা বলছেন, দুই দেশ প্রথমে দ্বিপাক্ষিক বাণিজ্য বাড়ানোর ওপর মনোযোগ দিতে পারে। বর্তমানে তাদের বাণিজ্যের পরিমাণ মাত্র ৭০০ মিলিয়ন ডলারেরও কম, যা বেশিরভাগই পাকিস্তানের পক্ষে।

ইউনিভার্সিটি অব ডেলাওয়ারের সহযোগী অধ্যাপক সাবরিন বেগ বলেন, পাকিস্তানের ২৫ কোটির বেশি জনসংখ্যা বাংলাদেশি পণ্যের জন্য মধ্য থেকে দীর্ঘমেয়াদে একটি সম্ভাবনাময় বাজার হতে পারে। 

বর্তমানে দুই দেশের মধ্যে উচ্চ শুল্ক, ব্যবসায়ীদের জন্য ভিসা ও ভ্রমণ সংক্রান্ত জটিলতা অন্যতম প্রধান বাধা হিসেবে কাজ করছে। তবে সাবরিন বেগ মনে করেন, উন্নত দ্বিপাক্ষিক রাজনৈতিক ও বাণিজ্যিক সম্পর্ক এই বাধাগুলো দূর করতে সহায়ক হবে।

এই বিষয়ে আলোচনার জন্য পাকিস্তানের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ইসহাক দার এপ্রিলের ঢাকা সফরে আসতে পারে।

বছরের শেষের দিকে বাংলাদেশে সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হওয়ার কথা এবং নতুন সরকার তার পররাষ্ট্রনীতিতে ভিন্ন অবস্থান নিতে পারে।

তবে যাই হোক না কেন, দিল্লির জন্য এই পরিস্থিতির গুরুত্ব অনেক। কারণ ভারত মনে করে, তার উত্তর-পূর্বাঞ্চলে শান্তি ও স্থিতিশীলতা বজায় রাখতে একটি স্থিতিশীল ও বন্ধুত্বপূর্ণ বাংলাদেশ অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।

সূত্র: বিবিসি