
১১ই মার্চ প্রথম আলোর ৩-এর পাতার ছোট্ট খবরটি ছোট নয়। শিরোনাম ছিল, এক বিশেষ সহকারীর পদত্যাগ, নতুন আরেকজন নিয়োগ। পদত্যাগকারী বিশেষ সহকারী অধ্যাপক এম আমিনুল ইসলাম। তিনি শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বে ছিলেন। এই মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা ছিলেন ওয়াহিদউদ্দিন মাহমুদ। এম আমিনুল ইসলামের পদত্যাগের কারণ জানানো হয়নি। একটি পত্রিকা শিরোনাম করেছে, ‘অভিমানে পদত্যাগ করেছেন এম আমিনুল ইসলাম।’ প্রথম আলোকে তিনি বলেছেন, ‘সরকারের চাওয়া অনুযায়ী পদত্যাগ করেছেন।’
সরকার কেন তাকে বিশেষ সহকারী পদে নিয়োগ দিলো, আবার কেনই-বা পদত্যাগ করতে বললো? বিষয়টা এমন নয় যে, সরকারে বিশেষ সহকারীর সংখ্যা বেশি হয়েছিল বলে তাকে পদত্যাগ করতে বলা হয়েছে। একই দিন সরকার আরেক বিশেষ সহকারী নিয়োগ দিয়েছে।
শুরুতে সরকারকে ঠাট্টা করে ‘এনজিওগ্রাম’ সরকার বলা হতো। সরকারে যারা এসেছেন, বেশির ভাগই এনজিও পটভূমি থেকে অথবা তাদের বাড়ি চট্টগ্রাম। উত্তরবঙ্গ থেকে উপদেষ্টা নেয়ার দাবিতে আন্দোলনও হয়েছিল। কিন্তু তারপরও সেখান থেকে কোনো উপদেষ্টা নেয়া হয়নি। এরপর বেশ কয়েকজন সামরিক ও বেসামরিক সাবেক কর্মকর্তাকে যুক্ত করে ভারসাম্য আনা হলো। হালে প্রধান উপদেষ্টা তার পরিষদ গোছাতে শিক্ষকদেরই বেশি টানছেন।
ওয়াহিদউদ্দিন মাহমুদ এখনো উপদেষ্টা আছেন। তবে তার হাতে শিক্ষা নেই, আছে পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়। শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব নিয়ে নতুন উপদেষ্টা হয়েছেন সি আর আবরার। একই দিন নতুন বিশেষ সহকারী পদে নিয়োগ দেয়া হয়েছে আনিসুজ্জামান চৌধুরীকে। তিনি অর্থ উপদেষ্টা সালেহউদ্দিন আহমেদকে সহায়তা করবেন বলে জানানো হয়েছে। সালেহউদ্দিনের হাতে প্রথমে অর্থ ও বাণিজ্য ছিল। পরে ব্যবসায়ীদের প্রতিনিধি হিসেবে বাণিজ্যে আসেন শেখ বশিরউদ্দীন। এরপরও ব্যবসায়ীরা খুব একটা আশ্বস্ত হয়েছেন বলে মনে হয় না। সরকার নানাভাবে প্রভাবশালী ব্যবসায়ীদের ‘সন্তুষ্ট’ করতে চাইছে।
ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে গত বছরের ৫ই আগস্ট শেখ হাসিনা সরকারের পতন হয়। এরপর ৮ই আগস্ট অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে অন্তর্বর্তী সরকার গঠিত হয়। বর্তমানে প্রধান উপদেষ্টাসহ অন্তর্বর্তী সরকারে এখন উপদেষ্টা ২৩ জন। তাদের সঙ্গে ছয়জন বিশেষ সহকারী মেলালে সংখ্যা দাঁড়ায় ২৯ জন। প্রথমদিকে ব্যবসায়ীদের মতো এই সরকারে আন্দোলনকারী ছাত্রনেতাদের প্রতিনিধিও ছিলেন না। পরে প্রধান উপদেষ্টা তাদের পক্ষ থেকে তিনজন প্রতিনিধি নেন। সমপ্রতি তাদের একজন নাহিদ ইসলাম পদত্যাগ করে জাতীয় নাগরিক পার্টি নামে নতুন দল করেছেন। অপর দুজন এখনো সরকারে আছেন। এ নিয়ে রাজনৈতিক মহলে সমালোচনাও কম হচ্ছে না। তারা মনে করেন, এতে সরকারের নিরপেক্ষতা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। ওই দুই উপদেষ্টাও নতুন দলের সঙ্গে তাদের সম্পর্কের বিষয়টি ব্যাখ্যা করেননি।
গত সাত মাসে কয়েক দফায় উপদেষ্টা পরিষদে নতুন মুখ যোগ হয়েছে। উপদেষ্টা হাসান আরিফ মারা যাওয়ায় তার মন্ত্রণালয় দেয়া হয় ছাত্র আন্দোলন থেকে আসা আসিফ মাহমুদকে। মাহফুজ আলম তথ্য মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব নেয়ার আগে এই পদে ছিলেন নাহিদ ইসলাম। এর আগে মাহফুজ ছিলেন দপ্তরবিহীন।
গত নভেম্বরে প্রতিমন্ত্রীর পদমর্যাদায় তিনজনকে বিশেষ সহকারী পদে নিয়োগ দেয়া হয়। অনূর্ধ্ব ৩০ জন উপদেষ্টা দিয়ে বাংলাদেশের মতো একটি সমস্যাসংকুল দেশ পরিচালনা করা কঠিন। সে ক্ষেত্রে উপদেষ্টা পরিষদ ও তাদের সহকারীর সংখ্যা বাড়তে পারে। জনপ্রশাসন সংস্কার কমিশনও ৪০-৪৫ জনকে নিয়ে সরকার গঠনের কথা বলা হয়েছে। প্রধান উপদেষ্টা প্রয়োজন মনে করলে উপদেষ্টা ও বিশেষ সহকারীর সংখ্যা বাড়াতে পারেন। কিন্তু কিসের ভিত্তিতে এসব নিয়োগ হয়, নিয়োগপ্রাপ্তদের যোগ্যতা ও অভিজ্ঞতা কী, তা-ও জানা প্রয়োজন।
উপদেষ্টা পদে যারা আছেন, তারা সবাই সমমর্যাদার। কিন্তু বিশেষ সহকারী পদে যারা আছেন, তাদের কেউ উপদেষ্টার, কেউ প্রতিমন্ত্রীর পদমর্যাদার অধিকারী। লেফটেন্যান্ট জেনারেল (অব.) আবদুল হাফিজ প্রধান উপদেষ্টার বিশেষ সহকারী (উপদেষ্টার পদমর্যাদা), প্রতিরক্ষা ও জাতীয় সংহতি উন্নয়নের বিষয়টি দেখেন লুৎফে সিদ্দিকী প্রধান উপদেষ্টার আন্তর্জাতিক বিষয়সংক্রান্ত বিশেষ দূত (অবৈতনিক)। অন্যদিকে ড. খলিলুর রহমান উপদেষ্টার পদমর্যাদায় রোহিঙ্গা সমস্যা ও অগ্রাধিকারপ্রাপ্ত বিষয়াবলি সংক্রান্ত হাই রিপ্রেজেন্টেটিভের দায়িত্ব পালন করছেন বলে জানানো হয়েছে। শেখ মইনউদ্দিন (প্রতিমন্ত্রীর পদমর্যাদা) সড়ক পরিবহন ও সেতু মন্ত্রণালয়ের; ফয়েজ আহমদ তৈয়্যব (প্রতিমন্ত্রীর পদমর্যাদা) ডাক, টেলিযোগাযোগ ও তথ্যপ্রযুক্তি মন্ত্রণালয়; অধ্যাপক ডা. মো. সায়েদুর রহমান (প্রতিমন্ত্রীর পদমর্যাদা) স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয়; খোদা বকশ চৌধুরী (প্রতিমন্ত্রীর পদমর্যাদা) স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের বিশেষ সহকারী হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন। সর্বশেষ বিশেষ সহকারী হলেন আনিসুজ্জামান চৌধুরী, তিনিও প্রতিমন্ত্রীর মর্যাদায়। এই যে একবার এক উপদেষ্টাকে কোনো মন্ত্রণালয় দেয়া হয়। আবার কিছুদিন পর মন্ত্রণালয় বদল করা হয়, সেটা কিসের ভিত্তিতে? সাখাওয়াত হোসেনকে প্রথমে স্বরাষ্ট্রের দায়িত্ব দেয়া হয়েছিল। তিনি কঠিন সময়ে কঠিন দায়িত্বটি যথাযথভাবে পালনও করেছিলেন। তারপর হঠাৎ তার মন্ত্রণালয় বদল করে অন্য একজনকে আনা হলো। এতে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির উন্নতি হয়নি। বরং গত সাত মাসে সবচেয়ে বেশি সমালোচনা এই মন্ত্রণালয়ের বিরুদ্ধে।
উপদেষ্টা পদে কাউকে বাদ দেয়া হয়নি। নাহিদ ইসলাম স্বেচ্ছায় পদত্যাগ করেছেন। কিন্তু একজন বিশেষ সহকারীকে সরকারের চাওয়াকে সম্মান জানিয়ে কেন পদত্যাগ করতে হলো, সেই প্রশ্নেরও উত্তর জানা দরকার।
আওয়ামী লীগ ও বিএনপি সরকারের আমলে আমরা দেখতাম, বিরাট আকারের মন্ত্রিসভা গঠনের পরও প্রধানমন্ত্রীর বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ভিত্তিক উপদেষ্টা থাকতেন। এখন আছেন বিশেষ সহকারীরা।
প্রধান উপদেষ্টার ছয়জন বিশেষ সহকারী তিনজন উপদেষ্টা পদমর্যাদার, তিনজন প্রতিমন্ত্রী মর্যাদার। এটা হতে পারে। কিন্তু সেই একই প্রশ্ন, কিসের ভিত্তিতে একজন উপদেষ্টা পদমর্যাদার আরেকজন প্রতিমন্ত্রীর পদমর্যাদার হলেন?
দেখতে দেখতে সরকারের বয়স সাত মাস হয়ে গেল। দেশবাসী চায়, যাকে যে দায়িত্ব দেয়া হয়েছে, সেটা তিনি ঠিকমতো পালন করুক। সরকারের কেউ কেউ করছেনও। তাদের কাজ বেশ দৃশ্যমান। কিন্তু আবার অনেকের কাজ দৃশ্যমান নয়। আড্ডা-আলোচনায় অনেকেই প্রশ্ন করেন, অমুক উপদেষ্টা বা বিশেষ সহকারী কী করছেন।
উপদেষ্টারা রাস্তাঘাট কিংবা তাদের অফিসের দেয়ালে কান পাতলেই শুনতে পাবেন জনগণ কী বলছে। কোন উপদেষ্টার কাজে তারা কতোটা সন্তুষ্ট বা অসন্তুষ্ট। কোনো পদাধিকারী দায়িত্ব পালন করতে না পারলে তাকে ‘ঘরের শোভা’ হিসেবে রাখার যুক্তি নেই। উল্লেখ করা প্রয়োজন যে, বেশ কয়েকটি মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টার পারফরম্যান্স দৃশ্যমান। পুরোপুরি সাফল্য দেখাতে না পারলেও তারা চেষ্টা করছেন। কিন্তু কয়েকটি মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টার নিষ্ক্রিয়তা বেশ পীড়াদায়ক। আবার কারও ওপর বাড়তি বোঝা চাপানোরও অভিযোগ আছে। স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরীর কাজটি বলতে গেলে ২৪ ঘণ্টার। আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি মোকাবিলায় তাকে রাত তিনটায় সাংবাদিকদের ডেকে ব্রিফিং করতে হয়, ভোর ছয়টায় থানা পরিদর্শনে যেতে হয়। তারপরও কৃষি মন্ত্রণালয়ের মতো একটি গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব তার ওপর চাপানোর যৌক্তিকতা আছে কিনা, সেটাও ভেবে দেখা প্রয়োজন।