
সত্তর দশকের গোড়ার দিকে আবহমান বাংলার শহুরে জীবন কেমন ছিল তা বইপুস্তক পড়ে জানতে পারি। কিন্তু গ্রাম ও মফস্বল শহরের জীবনযাত্রা আমার চোখের তারায় এখনো জ্বল জ্বল করে ভাসে। গ্রামীণ জীবনের অর্থনীতি, রাজনীতি, পোশাকপরিচ্ছদ, অভ্যাস এবং খানাখাদ্যের সঙ্গে রাজনীতির যে কী নিবিড় সম্পর্ক তা ছোটবেলায় বুঝতে না পারলেও বড় হয়ে বুঝেছি। রাজনীতির হাল আমলের বেহাল দশা, সামাজিক অস্থিরতার সঙ্গে চলমান অর্থনীতি এবং মানুষের রুচি ও অভ্যাসের পরস্পরবিরোধী সম্পর্কের কারণে কী সর্বনাশ ঘটে চলেছে এবং ভবিষ্যতে আমাদের জন্য আরও কত বড় বিপর্যয় অপেক্ষা করছে তা নিয়ে আজকের নিবন্ধে আলোচনা করব কিন্তু তার আগে সত্তর দশকের নাগরা জুতো ও হাওয়াই চপ্পল নিয়ে সংক্ষেপে কিন্তু বলে নিই।
আমি যে সময়ের কথা বলছি তখন অর্থাৎ ১৯৭২-৭৪ সালে আমার সৌভাগ্য হয়েছিল বৃহত্তর ফরিদপুর, বাগেরহাট, খুলনা, পাবনা, রাজশাহী অঞ্চলের নগরবন্দর, গ্রামগঞ্জ পরিভ্রমণ করার। সেই সময়ে যা দেখেছি, বলতে গেলে প্রায় সবকিছুই আজও স্মরণ করতে পারি। অঞ্চল ভেদে মানুষের খাবারদাবার, খেলাধুলো, ক্রয়বিক্রয়ের যে ভিন্নতা দেখেছি সেই ভিন্নতার কারণে তাদের রাজনৈতিক আশা-আকাক্সক্ষার মধ্যে যে পার্থক্য থাকে সেটাকে জাতীয় পর্যায়ের রাজনীতির সঙ্গে সামঞ্জস্য বিধানের জন্যই স্থানীয় ও জাতীয় পর্যায়ের জনপ্রতিনিধি নির্বাচন করার জন্য আধুনিক রাষ্ট্রবিজ্ঞান পরামর্শ দিয়েছে। একইভাবে মানুষের রুচি-অভিরুচি, অভ্যাস, পোশাক-পরিচ্ছদ, শিক্ষা, পরিবেশ-প্রতিবেশের ওপরও রাজনীতির ভবিষ্যৎ নির্ভর করে। মহামতি ইবনে খালদুন, চাণক্য, আবুল ফজল, কনফুসিয়াস কিংবা মানসুর মতো দার্শনিক যেভাবে তাদের সমসাময়িক ও মহাকালের মানব চরিত্রের রাজনৈতিক চরিত্র বর্ণনা করেছেন, তা যদি আপনি একটু মিলিয়ে নেন, তবে ২০২৫ সালের বাংলাদেশে কী ঘটতে যাচ্ছে, তা বোঝার জন্য রকেট বিজ্ঞানী হওয়ার প্রয়োজন নেই।
২০২৫ সাল নিয়ে আলোচনা শুরুর আগে শিরোনাম প্রসঙ্গে সত্তর দশকের শিশুতোষ কাহিনিটি বলে নিই। আমার জন্ম ফরিদপুর জেলার এক অতি উন্নত ও আধুনিক গ্রামে। নাম শ্যামপুর। থানা, সদরপুর। আমার গ্রামে সেই সময়ে নজরুলজয়ন্তী হতো রবীন্দ্রজয়ন্তীও হতো। ওয়াজ মাহফিল পীর-ফকিরদের বার্ষিক ওরস, নাটক-থিয়েটার, যাত্রাপালা, জারি-সারি, মুর্শিদি, বিচার গানের পালা ছাড়াও ফুটবল, হা-ডু-ডু, নৌকাবাইচ ইত্যাদি উৎসবে আমরা সারা বছর মুখর ছিলাম। হিন্দুদের পূজা-পার্বণ, জাতীয় অনুষ্ঠান অর্থাৎ ২৬ মার্চ, ১৬ ডিসেম্বর, ২১ ফেব্রুয়ারির ভাবগাম্ভীর্য ছেলে-বুড়ো, নারী-পুরুষ সবাইকে আন্দোলিত করত। মহররম মাস, রোজা, দুই ঈদ ছাড়াও দুর্গাপূজার উৎসব পুরো গ্রাম-থানা-সদরসহ দুই চার দশ বর্গমাইল এলাকাকে পুলকিত করত। বর্ষা-শীত-গ্রীষ্মকালীন আবহাওয়া, ফলফলাদি, ফসল, পারিবারিক অনুষ্ঠান, বিয়েশাদি ইত্যাদি সবকিছু মিলিয়ে আমাদের হাজার বছরের বাঙালি ঐতিহ্য যে ভ্রাতৃত্বের সেতুবন্ধন তৈরি করত তার ফলে মামলা-হামলা-গুম, মব জাস্টিস, খুন, ধর্ষণ, ডাকাতির মতো অপরাধের কথা আমরা সেই শৈশবে শুনিনি।
আমাদের গ্রামের শিক্ষিত লোকদের বাড়িতে লাইব্রেরি ছিল, মাধ্যমিক বিদ্যালয়গুলোতেও লাইব্রেরি ছিল। মানুষের অভাব ছিল, আবার ছিল কর্মসংস্থানও। সবাই ভোর ৫টা থেকে টানা বেলা ২টা পর্যন্ত হাড়ভাঙা পরিশ্রম করতেন। তারপর বিকাল ৪টা থেকে আবার জীবনযুদ্ধ হতো গভীর রাত অবধি। কৃষি, ব্যবসাবাণিজ্য ছাড়াও ধোপা, নাপিত, ডাক্তারি, কবিরাজি, কাপড় বুনন, মাটির হাঁড়িপাতিল নির্মাণ থেকে শুরু করে পশু চিকিৎসক অর্থাৎ জীবনজীবিকার সব শ্রেণি-পেশার মানুষ আমাদের গ্রামে ছিলেন। সেই জমানায় ব্যাংকব্যবস্থা গ্রামে পৌঁছেনি। তবে সুদি-মহাজনরা ছিলেন, যাদের নীতিনৈতিকতা আধুনিক ব্যাংক লুটেরাদের চেয়ে শত কোটি গুণ উন্নত ছিল।
গ্রামের অতি ধনী পরিবার ছিল দুই-তিনটি। বাকিরা মধ্যবিত্ত-নিম্নবিত্ত এবং বেশির ভাগই অর্থাৎ ৯০ ভাগ মানুষ ছিলেন দরিদ্র। কিন্তু সামাজিক ও মানবিক ভেদাভেদ ছিল না। আমরা শিশুরা সেটা বুঝতাম খেলার মাঠে গিয়ে। ওখানে যারা ভালো খেলত তারাই ছিল গ্রামবাসীর চোখের মণি। আর পড়ার ক্লাসে যারা ভালো ফলাফল করত তাদের সম্মান ও মর্যাদা ধনীরা যেভাবে দিতেন, তা আজকের জমানায় কল্পনাও করা যায় না। ফলে পুরো সমাজব্যবস্থা যেভাবে কর্মের বিনিময়ে অর্থ এবং কর্মের বিনিময়ে মানসম্মানের যে অনন্য ভিত্তি তৈরি করেছিল তার ফলে যেকোনো জনপ্রতিনিধিই ছিলেন অতিশয় সম্মানিত। গ্রামের লোকজন সাধারণত মেম্বার সাহেবকেই চিনতেন। চেয়ারম্যান সাহেবের কাছে সাধারণত মেম্বাররা যেতেন আর এমপি সাহেবের কাছে চেয়ারম্যান, এসডিও ডিসি এসপিরা যেতেন। ফলে রাজনীতি ও প্রশাসনের একটি চেইন অব কমান্ড ছিল এবং সম্মান ও মর্যাদার ক্ষেত্রে রাজনীতিবিদরা ছিলেন সর্বোত্তম অবস্থানে।
আমাদের সেই সমাজব্যবস্থায় মাথার যেমন কদর ছিল তদ্রুপ পায়েরও কদর ছিল। খেটে খাওয়া মানুষ বেশির ভাগ সময় খালি পায়ে থাকতেন। গরিবেরা কালেভদ্রে বেড়াতে গেলে অন্যের পুরোনো জুতো বা স্যান্ডেল ধার করে নিতেন- আবার ধনীরা মাঝে মধ্যে নিজেদের ব্যবহৃত জুতোগুলো গরিবদের দিয়ে দিতেন। সেই জমানায় জুতো বলতে প্লাস্টিকের নাগরা জুতোকেই বোঝাত। আমাদের গ্রামে চামড়ায় জুতো বা স্যান্ডেল বড় জোর চার-পাঁচজনের পায়ে শোভা পেত। তো সেই প্লাস্টিকের নাগরা জুতোও বেশির ভাগ মানুষ বগলে করে হাঁটতেন এবং গন্তব্যের কাছাকাছি পৌঁছে পা ধুয়ে জুতো পরে ভদ্রলোক সাজার চেষ্টা করতেন।
নাগরা জুতোর রমরমা অবস্থার মধ্যে হঠাৎ করেই হাওয়াই চপ্পলের উদ্ভব হলো। আজকের দিনে যেগুলোকে আমরা স্পঞ্জের স্যান্ডেল বলি সেগুলোই সেই জমানায় ছিল হাওয়াই চপ্পল। রং-বেরঙের উঁচু উঁচু হাওয়াই চপ্পল কেনার জন্য শিশু-কিশোররা বায়না ধরত এবং মুরুব্বিরা কিনে দিলে বেশির ভাগ শিশু-কিশোর কয়েক মাস সেসব চপ্পল পা না দিয়ে বুকে চেপে অথবা বালিশের নিচে রেখে রাতে ঘুমাত। সকাল বিকাল সাবান দিয়ে ধৌত করত- তেল মাখাত এবং মনের আনন্দে প্রাণভরে সেই চপ্পলের ঘ্রাণ নিত এবং নিজেকে দুনিয়ার সুখী মানুষ ভাবত।
সত্তর দশকের নাগরা জুতো এবং হাওয়াই চপ্পলের গল্প শেষ। এখন এই দুইটি জিনিসের সঙ্গে রাজনীতির কী সম্পর্ক এবং সেই সম্পর্কের পরিণতি কী তা নিয়ে সংক্ষেপে আলোচনা করে আজকের নিবন্ধের ইতি টানব। আপনি যদি সত্তর দশকের নিম্নবিত্ত ও দরিদ্র জনগোষ্ঠীর মনমানসিকতা চিন্তা করেন তবে দেখতে পাবেন যে তারা জুতো-স্যান্ডেলকে মাথার তাজ বা টুপির চেয়ে বেশি মূল্যবান মনে করত। তারা এটা করত তাদের আর্থিক দৈন্য এবং জুতো-স্যান্ডেলের দুষ্পাপ্যতার কারণে। কিন্তু আধুনিক সত্তর দশকের সেই আর্থিক অনটন নেই। ফলে হাল আমলের নাগরা জুতো বা হাওয়াই চপ্পল তো দূরের কথা পৃথিবীর সবচেয়ে দামি দামি ব্র্যান্ডের লাখ টাকা দামের জুতো বা স্যান্ডেল নিয়েও কেউ ঘুমোতে যাবে না কিংবা বোগল দাবা করে খালি পায়ে পথ চলবে না। অর্থনীতির সাধারণ সূত্র হলো, অভাবের কারণে কিছু নিম্নমানের জিনিস হঠাৎ অতি মূল্যবান হয়ে পড়ে। আবার পর্যাপ্ত পরিমাণে অতিমূল্যবান বস্তুর সরবরাহ থাকলে তা মূল্যহীন হয়ে পড়ে। অর্থনীতির এই সূত্রমতে, দেশের রাজনীতির দুর্ভিক্ষ ও রাজনীতিবিদদের মহামারির কারণে পুরো রাষ্ট্রব্যবস্থায় যে রাজনীতির শূন্যতা তৈরি হেয়েছে তার কারণে অনেক মূল্যহীন বস্তু অমূল্য হয়ে পড়েছে। গুরুত্বহীন বিষয় মহাগুরুত্ব পাচ্ছে এবং নিম্নগামী বিষয় ঊর্ধ্বগামী হয়ে গেছে। টুপির মর্যাদা কমে গেছে এবং সেই সত্তর দশকের শিশু-কিশোরের হাওয়াই চপ্পল প্রীতি এবং সাধারণ মানুষের নাগরা জুতোর কদরের মতোন করে আমাদের চলমান রাজনীতিতে এমন কিছু ঘটছে যা আমাদের ক্রমশ সভ্যতা থেকে অসভ্যতা এবং শিক্ষা থেকে অশিক্ষার দিকে প্রবলভাবে টেনে নিয়ে যাচ্ছে।
লেখক : সাবেক সংসদ সদস্য ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক
গোলাম মাওলা রনি