
রমজান ও ঈদকে ঘিরে বাজারে নগদ টাকার চাহিদা বাড়ে। নতুন নোট ছেড়ে সে চাহিদা মেটায় বাংলাদেশ ব্যাংক। এবার শেখ মুজিবুর রহমানের ছবিসংবলিত নতুন নোট বাজারে ছাড়া নিয়ে কেন্দ্রীয় ব্যাংক পড়েছে বিড়ম্বনার মুখে।
রমজান ও ঈদকে ঘিরে বাজারে নগদ টাকার চাহিদা বাড়ে। নতুন নোট ছেড়ে সে চাহিদা মেটায় বাংলাদেশ ব্যাংক। এবার শেখ মুজিবুর রহমানের ছবিসংবলিত নতুন নোট বাজারে ছাড়া নিয়ে কেন্দ্রীয় ব্যাংক পড়েছে বিড়ম্বনার মুখে। প্রথমে বলা হয়, ঈদ উপলক্ষে পুরনো ডিজাইনের নতুন নোটই বাজারে ছাড়া হবে। যদিও পরে সে সিদ্ধান্ত থেকে সরে এসে জানানো হয়, ব্যাংকের শাখায় থাকা নতুন নোটও বাজারে ছাড়া যাবে না। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের এ দ্বিধাদ্বন্দ্বের জেরে তৈরি হয়েছে নগদ টাকার সংকট। দেশের অনেক জেলায় ব্যাংকগুলো চাহিদা অনুযায়ী নগদ টাকা পাচ্ছে না বলে জানা গেছে।
রাজধানীর মতিঝিলের প্রধান কার্যালয়সহ সারা দেশে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ১০টি আঞ্চলিক কার্যালয় রয়েছে। নগদ টাকার প্রয়োজন হলে বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলো এসব আঞ্চলিক কার্যালয় থেকে তা সংগ্রহ করে। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের যেখানে উপস্থিতি নেই, সে জেলায় প্রাথমিকভাবে নগদ টাকার জোগান দেয় সোনালী ব্যাংক। ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন জেলা থেকে পাওয়া তথ্য অনুযায়ী, গতকাল সপ্তাহের প্রথম দিনে দেশের অনেক ব্যাংকই চাহিদামতো বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে নগদ টাকা সংগ্রহ করতে পারেনি। মেলেনি সোনালী ব্যাংক থেকেও। তাই জরুরি প্রয়োজন মেটাতে এক ব্যাংকের শাখা অন্য ব্যাংকের শাখা থেকে নগদ টাকা সংগ্রহ করে গ্রাহকদের প্রয়োজন মিটিয়েছে।
ভুক্তভোগী একাধিক ব্যাংকের শাখা ব্যবস্থাপক বণিক বার্তাকে বলেছেন, রোজার অর্ধেক এখনো বাকি। আগামী মাসের শুরুতে ঈদুল ফিতর। রোজা ও ঈদকে কেন্দ্র করে বাজারে বিপুল নগদ অর্থের প্রয়োজন হয়। এখন বাজারে যাওয়া নোটের বড় অংশ ব্যাংকে ফিরবে ঈদের পর। এ অবস্থায় নোটের সংকট তৈরি হলে গ্রাহকদের মধ্যে ব্যাংক খাত নিয়ে নতুন আতঙ্ক তৈরি হতে পারে। তাই জরুরি ভিত্তিতে কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে নোট সরবরাহ স্বাভাবিক করার দাবি জানান তারা।
কেন্দ্রীয় ব্যাংক ও সোনালী ব্যাংকের দায়িত্বশীল কর্মকর্তারা যদিও বলেছেন, বাজারে নগদ অর্থের কোনো সংকট নেই। নতুন নোট ছাড়াও বাংলাদেশ ব্যাংকের হাতে পর্যাপ্ত পুরনো নোট রয়েছে। পুরনো নোটগুলোই চাহিদা অনুযায়ী বাজারে ছাড়া হচ্ছে। কোনো জেলায় যদি সংকট তৈরিও হয়, সেটি ভুল বোঝাবুঝি থেকে সৃষ্টি হতে পারে।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে বাংলাদেশ ব্যাংকের কারেন্সি ম্যানেজমেন্ট বিভাগের পরিচালক কেএম ইব্রাহিম বণিক বার্তাকে বলেন, ‘কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী এ ঈদে আমরা বাজারে নতুন নোট ছাড়ছি না। নতুন ডিজাইনের নোট আগামী এপ্রিল-মে মাসে ছাড়া হবে। আর বাজারে নগদ অর্থের সরবরাহ নিশ্চিতের বিষয়টি বাংলাদেশ ব্যাংকের মতিঝিল কার্যালয় তদারকি করছে। এখন পর্যন্ত আমরা নোট সংকটের বিষয়ে কিছু শুনিনি। কোথাও যদি সংকট তৈরিও হয়, সঙ্গে সঙ্গে সরবরাহ করার মতো নোট আমাদের হাতে মজুদ আছে। আশা করছি, ঈদকে কেন্দ্র করে কোনো সংকট হবে না।’
বাংলাদেশ ব্যাংকের চট্টগ্রাম কার্যালয়ের এক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা অবশ্য নাম প্রকাশ না করার শর্তে জানান, ব্যাংকগুলোর শাখার চাহিদার ভিত্তিতে প্রধান কার্যালয়ের কাছে ৩ হাজার কোটি টাকার নোট চাওয়া হয়েছিল। কিন্তু দেয়া হয়েছে কেবল ৯০০ কোটি টাকা। এ কারণে কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে সরবরাহ কমানো হয়েছে। সোনালী ব্যাংকসহ জেলাভিত্তিক নগদ উদ্বৃত্ত থাকা অন্য ব্যাংকগুলোর সঙ্গে সমন্বয় করতে ব্যাংকগুলোকে বলা হয়েছে।
নগদ অর্থ সংকটের বিষয়টি জানিয়ে রাষ্ট্রায়ত্ত একটি ব্যাংকের লক্ষ্মীপুর জেলার শাখা ব্যবস্থাপক বলেন, ‘গত বৃহস্পতিবার ৩ কোটি টাকার জন্য সোনালী ব্যাংকের লক্ষ্মীপুর জেলার প্রধান শাখায় যোগাযোগ করি। কিন্তু আমাকে বলা হয়, সোনালী ব্যাংক বাজারে কোনো টাকা ছাড়ছে না। এ বিষয়ে আঞ্চলিক কার্যালয় থেকে নিষেধ করা হয়েছে।’
রাজশাহী, যশোর, ফেনীসহ কয়েকটি জেলা থেকেও প্রায় একই ধরনের তথ্য পাওয়া গেছে। অন্তত ছয়টি ব্যাংকের শাখা ব্যবস্থাপক জানিয়েছেন, ব্যাংকে পর্যাপ্ত তারল্য থাকা সত্ত্বেও চাহিদা অনুযায়ী তারা নগদ টাকা পাচ্ছেন না। নিজেদের ব্যক্তিগত বন্ধুত্ব ও সম্পর্ককে কাজে লাগিয়ে অন্য ব্যাংক থেকে টাকা সংগ্রহ করে গ্রাহকদের দিচ্ছেন।
নগদ টাকা সংকটের বিষয়টি কিছুটা বোঝার ভুল থেকে সৃষ্ট বলে রাষ্ট্রায়ত্ত একটি ব্যাংকের ট্রেজারি বিভাগের প্রধান বণিক বার্তাকে জানিয়েছেন। নাম প্রকাশ না করার শর্তে তিনি বলেন, ‘বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে ১০ মার্চ চিঠি দিয়ে বলা হয়েছে, ব্যাংকের শাখায় থাকা নতুন নোটও যেন বাজারে না ছাড়া হয়। এ নির্দেশনা পেয়ে ব্যাংকের কিছু শাখা ব্যবস্থাপক বাড়তি সতর্কতা অবলম্বন করছেন। এ কারণে শাখার ভল্টে থাকা ৫০০ ও ১০০০ টাকার নতুন নোটও তারা গ্রাহকদের দিতে ভয় পাচ্ছেন।’
রাষ্ট্রায়ত্ত সোনালী ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মো. শওকত আলী খানও প্রায় একই ধরনের কথা বলেছেন। নগদ টাকার সংকটের বিষয়ে জানতে চাইলে বণিক বার্তাকে তিনি বলেন, ‘এ মুহূর্তে সোনালী ব্যাংকে তারল্যের কোনো সংকট নেই। আমাদের হাতে পর্যাপ্ত নগদ অর্থও রয়েছে। আমরা চাহিদা অনুযায়ী ব্যাংক ও গ্রাহকদের নগদ টাকা সরবরাহ করছি। এখন কোনো শাখার ব্যবস্থাপক যদি না দেয়, সেটি হয়তো বোঝার ভুল।’
কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে গত ফেব্রুয়ারির দ্বিতীয় সপ্তাহে বিজ্ঞপ্তি দিয়ে বলা হয়, ঈদুল ফিতর উপলক্ষে ১৯ মার্চ থেকে বাজারে ৫, ১০, ২০ ও ৫০ টাকা মূল্যের নতুন নোট পাওয়া যাবে। এক্ষেত্রে ব্যাংকের কোন কোন শাখায় নতুন নোট মিলবে, সেটিও উল্লেখ করে দেয়া হয় বিজ্ঞপ্তিতে। যদিও ১০ মার্চ বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে সবক’টি তফসিলি ব্যাংকের শীর্ষ নির্বাহীকে চিঠি দিয়ে বলা হয়, ‘আসন্ন ঈদুল ফিতর উপলক্ষে জনসাধারণের মাঝে ফ্রেশ বা নতুন নোট বিনিময় কার্যক্রম বন্ধ রাখার পরামর্শ দেয়া হলো। পাশাপাশি ব্যাংকের শাখায় যে নতুন নোট গচ্ছিত রয়েছে, তা বিনিময় না করে সংশ্লিষ্ট শাখায় সংরক্ষণ করার জন্য বলা হচ্ছে। তবে পুনঃপ্রচলনযোগ্য নোট দ্বারা সব নগদ লেনদেন কার্যক্রম সম্পাদনে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য চিঠিতে পরামর্শ দেয়া হয়।’
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের পরস্পরবিরোধী এ সিদ্ধান্তের প্রভাবই বাজারে দেখা যাচ্ছে। সাধারণত ঈদ উপলক্ষে কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে ছোট অংকের নোটের সঙ্গে ৫০০ ও ১০০০ টাকার নতুন নোটও বাজারে ছাড়া হয়। এ কারণে নতুন নোটের প্রতি গ্রাহকদের এক ধরনের আকর্ষণ থাকে। বড় নোটের বান্ডিল নেয়ার সময়ও গ্রাহকরা নতুন নোট খোঁজেন। কিন্তু বাংলাদেশ ব্যাংকের দেয়া চিঠি আমলে নিয়ে শাখা ব্যবস্থাপকরা নিজেদের ভল্টে থাকা ৫০০ ও ১০০০ টাকার নতুন নোটও বাজারে ছাড়া থেকে বিরত থাকছেন। এ কারণেই নগদ টাকার সংকট তৈরি হয়েছে বলে জানা গেছে।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে মিউচুয়াল ট্রাস্ট ব্যাংকের (এমটিবি) ব্যবস্থাপনা পরিচালক সৈয়দ মাহবুবুর রহমান বণিক বার্তাকে বলেন, ‘গ্রাহকরা ব্যাংকে এসে নতুন নোট চাচ্ছেন। সেটি দিতে পারছি না। তবে শাখা পর্যায়ে নগদ টাকার কোনো সংকট হয়েছে বলে এখনো শুনিনি। আমাদের ব্যাংকের তারল্য পরিস্থিতি খুবই ভালো।’
বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য পর্যালোচনা করে দেখা যায়, গত এক দশকে দেশের লেনদেন ব্যবস্থায় প্রযুক্তিগত উন্নয়ন ঘটলেও নগদ টাকার চাহিদা কমেনি। বরং এ সময়ে বাজারে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ইস্যুকৃত নোটের অনুপাত অনেক বেড়েছে। ২০২৩ সালের জুনে এসে ইস্যুকৃত নোটের পরিমাণ দাঁড়ায় ৩ লাখ ১১ হাজার ৯৪৮ কোটি টাকায়। এত পরিমাণ নোটের মধ্যে ২ লাখ ৯১ হাজার ৯১৩ কোটি টাকাই ব্যাংকের বাইরে চলে গিয়েছিল। ওই সময় ব্যাংকের হাতে থাকা নগদ নোটের পরিমাণ ছিল মাত্র ২০ হাজার ৩৪ কোটি টাকা। এরপর ২০২৩ সালের ডিসেম্বর নাগাদ ইস্যুকৃত নোটের পরিমাণ কিছুটা কমে এলেও গত বছরের জুনে এসে এটি অস্বাভাবিক বেড়ে যায়। ২০২৪ সালের জুনে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ইস্যুকৃত নোটের পরিমাণ দাঁড়ায় ৩ লাখ ২০ হাজার ৩০৯ কোটি টাকায়। ওই সময় ২ লাখ ৯০ হাজার ৪৩৬ কোটি টাকাই ব্যাংকের বাইরে ছিল।
তবে গত বছরের ৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার গণ-অভ্যুত্থানে শেখ হাসিনা সরকারের ক্ষমতাচ্যুতির পর ব্যাংকের বাইরে থাকা নোটের পরিমাণ কিছুটা কমে এসেছে। এ সময়ে ১১টি বেসরকারি ব্যাংকের পর্ষদ ভেঙে দেয়া, ব্যাংক খাত নিয়ে নানা শঙ্কা ও নেতিবাচক সংবাদ সত্ত্বেও মানুষ ব্যাংকে নগদ টাকা বেশি জমা করেছে। গত ডিসেম্বর শেষে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ইস্যুকৃত নোটের পরিমাণ ৩ লাখ ৪ হাজার ৯২৯ কোটি টাকায় নেমে আসে। আর ব্যাংকের বাইরে থাকা নোটের পরিমাণ নেমে আসে ২ লাখ ৭৬ হাজার ৩৭১ কোটি টাকায়।
এখন নতুন নোট বাজারে ছাড়ার ক্ষেত্রে যে পরিস্থিতি হয়েছে, সেটি সিদ্ধান্তহীনতার ফল বলে মনে করেন বাংলাদেশ ব্যাংকের কারেন্সি ম্যানেজমেন্ট বিভাগের একজন কর্মকর্তা। বণিক বার্তাকে তিনি বলেন, ‘২০২০ সালে কভিড মহামারীর সময়ে হঠাৎ করেই নগদ টাকার চাহিদা তীব্র হয়ে ওঠে। ওই সময় আমাদের হাতে নোট ছাপানের মতো পর্যাপ্ত কাগজ-কালিও মজুদ ছিল না। কিন্তু ত্বরিত সিদ্ধান্ত নিয়ে কাগজসহ প্রয়োজনীয় উপকরণ আমদানি করা হয়। লকডাউনের মতো পরিস্থিতিতেও আমরা জরুরি ভিত্তিতে নতুন নোট ছাপাতে পেরেছিলাম। এবার সিদ্ধান্ত ছিল, কেন্দ্রীয় ব্যাংকের হাতে থাকা নতুন নোট ঈদ উপলক্ষে বাজারে ছাড়া হবে। কিন্তু শেষ মুহূর্তে সে সিদ্ধান্ত থেকে সরে আসা হয়। গণ-অভ্যুত্থানের পরপর যদি নতুন ডিজাইনের নোট ছাপানোর বিষয়ে সিদ্ধান্ত হতো তাহলে আরো আগেই তা বাজারে চলে আসত।’