পুলিশ সংস্কার কমিশনের সুপারিশে কিছু বিষয়ে অস্পষ্টতা নিয়ে এবং কিছু দরকারি সুপারিশ না করায় পুলিশ সদস্যদের মধ্যে ক্ষোভ তৈরি হয়েছে। এর মধ্যে স্বাধীন পুলিশ কমিশন গঠনের বিষয়টি অন্যতম।
সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলো বলছে, পুলিশকে রাজনৈতিক প্রভাবমুক্ত রেখে পেশাদারত্বের সঙ্গে পরিচালনার জন্য স্বাধীন পুলিশ কমিশন গঠনের প্রয়োজনীয়তা নিয়ে আলোচনা ছিল, কিন্তু সংস্কার কমিশন এ বিষয়ে কোনো রূপরেখা দেয়নি। এ বিষয়ে বিশেষজ্ঞ মতামতের ভিত্তিতে সিদ্ধান্ত এবং ‘পরীক্ষা-নিরীক্ষা’ ও ‘বিচার-বিশ্লেষণ’ করা প্রয়োজন বলে উল্লেখ করেছে অভিজ্ঞ ও বিশেষজ্ঞদের দিয়ে গঠিত সংস্কার কমিশন।
এ ছাড়া পুলিশ সদস্যদের অপরাধ তদন্তে স্বতন্ত্র অভিযোগ কমিশন গঠনে সুপারিশ না থাকা এবং জাতীয় ঐকমত্য কমিশনে পুলিশ সংস্কারের বিষয়টি না রাখাসহ কিছু বিষয় নিয়ে বাহিনীর মধ্যে ক্ষোভ আছে।
এতে আমন্ত্রিতদের মধ্যে ১৩ জনের সঙ্গে কথা বলে অনুষ্ঠানে পুলিশের পক্ষ থেকে কী ধরনের বক্তব্য আসতে পারে, সে সম্পর্কে ধারণা পাওয়া গেছে।
আগামীকাল সোমবার পুলিশের বিভিন্ন পর্যায়ের কর্মকর্তাদের নিয়ে বসবেন প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস। সংশ্লিষ্ট সূত্র বলছে, এ বৈঠকে পুলিশের কর্মকর্তারা আইনশৃঙ্খলা রক্ষা ও বাহিনী পরিচালনায় তাঁদের সীমাবদ্ধতা ও সমস্যার পাশাপাশি সংস্কার কমিশনের ‘দুর্বল’ প্রতিবেদন এবং তাতে গুরুত্বপূর্ণ সংস্কারের বিষয়গুলো উপেক্ষিত থাকার প্রসঙ্গ সরকারপ্রধানের কাছে তুলে ধরবেন।
পুলিশ সূত্র থেকে জানা গেছে, প্রধান উপদেষ্টার কার্যালয়ে ওই অনুষ্ঠানে দেশের সব জেলার পুলিশ সুপার (এসপি), রেঞ্জ ডিআইজি (উপমহাপরিদর্শক), মহানগর পুলিশ কমিশনার, সব ইউনিটের প্রধান, পুলিশ সদর দপ্তরের তিনজন ডিআইজি ও সব অতিরিক্ত আইজিপি এবং আইজিপি উপস্থিত থাকবেন। এদিন প্রধান উপদেষ্টা পুলিশের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের উদ্দেশে দিকনির্দেশনামূলক ভাষণ দেবেন।
১২ মার্চ পুলিশ সদর দপ্তর থেকে চিঠির মাধ্যমে সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে এ অনুষ্ঠানের কথা জানানো হয়। এতে আমন্ত্রিতদের মধ্যে ১৩ জনের সঙ্গে কথা বলে অনুষ্ঠানে পুলিশের পক্ষ থেকে কী ধরনের বক্তব্য আসতে পারে, সে সম্পর্কে ধারণা পাওয়া গেছে।
প্রধান উপদেষ্টা তাঁর কার্যালয়ে আমাদের উদ্দেশে দিকনির্দেশনামূলক ভাষণ দেবেন। আশা করছি, এর মাধ্যমে পুলিশ সদস্যরা আরও বেশি উজ্জীবিত হবেন।
আইজিপি বাহারুল আলম
নাম প্রকাশ না করার শর্তে পুলিশের ওই কর্মকর্তারা বলছেন, বিগত সরকার আমলে পুলিশ কেন এত বেপরোয়া হয়েছিল, তাঁরা এ বিষয়ে প্রধান উপদেষ্টাকে অবহিত করতে চান। পাশাপাশি এটাও বলতে চান যে পুলিশ পরিচালনায় স্বাধীন কর্তৃপক্ষ তৈরি করা না গেলে ভবিষ্যতে একই রকম পরিস্থিতি তৈরি হতে পারে। তাই সংস্কার কমিশনের সুপারিশে না থাকলেও প্রধান উপদেষ্টা যেন স্বাধীন পুলিশ কমিশন গঠনসহ অন্যান্য দরকারি সংস্কারের বিষয়গুলো বাস্তবায়নের উদ্যোগ নেন, সেই দাবি তুলে ধরবেন কর্মকর্তারা।
তবে সোমবারের এ বৈঠকের বিষয়ে জানতে চাইলে পুলিশের মহাপরিদর্শক (আইজিপি) বাহারুল আলম প্রথম আলোকে বলেন, ‘প্রধান উপদেষ্টা তাঁর কার্যালয়ে আমাদের উদ্দেশে দিকনির্দেশনামূলক ভাষণ দেবেন। আশা করছি, এর মাধ্যমে পুলিশ সদস্যরা আরও বেশি উজ্জীবিত হবেন।’
কমিশনের সুপারিশ ও ভূমিকা নিয়ে ক্ষোভ
ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের আগে পুলিশের একশ্রেণির সদস্য নির্বিচার গুলি করে অসংখ্য মানুষ হত্যা করেছে। এ জন্য অন্তর্বর্তী সরকার গঠনের পর পুলিশকে প্রভাবমুক্ত ও নিরপেক্ষ রাখতে ‘স্বাধীন পুলিশ কমিশন’ গঠনের দাবি ওঠে।
অন্তর্বর্তী সরকার গত ৩ অক্টোবর পুলিশ সংস্কার কমিশন গঠন করে। কমিশন ১৫ জানুয়ারি প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূসের কাছে প্রতিবেদন জমা দেয়। সংস্কার কমিশনের শিক্ষার্থী প্রতিনিধি পুলিশের জন্য পৃথক একটি কমিশন গঠনের পক্ষে মত দেন।
সংস্কার কমিশনের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, পুলিশ সংস্কার কমিশন একটি নিরপেক্ষ প্রভাবমুক্ত ‘পুলিশ কমিশন’ গঠনের বিষয়ে নীতিগতভাবে ঐকমত্য পোষণ করে। প্রস্তাবিত পুলিশ কমিশন আইনের আওতায় অন্তর্ভুক্ত সংবিধিবদ্ধ সংস্থা হবে, নাকি সাংবিধানিক কাঠামোভুক্ত একটি প্রতিষ্ঠান হবে, সে বিষয়ে বিশেষজ্ঞ মতামতের ভিত্তিতে সিদ্ধান্ত হওয়া বাঞ্ছনীয়। এ ছাড়া পুলিশ কমিশনের গঠন, কার্যপরিধি, সাংবিধানিক বা আইনি বাধ্যবাধকতা, ইত্যাদি বিষয়াদি আরও বিচার-বিশ্লেষণ ও পরীক্ষা-নিরীক্ষা করা প্রয়োজন।
বাছাই কমিটির সুপারিশের মাধ্যমে বিভিন্ন পেশা থেকে বাকি চারজন অরাজনৈতিক ব্যক্তি পুলিশ কমিশনের সদস্য হবেন। এর মধ্যে একজন আইনজ্ঞ, একজন অবসরপ্রাপ্ত আইজিপি, সমাজবিজ্ঞান বা পুলিশিং বিষয়ে অভিজ্ঞতাসম্পন্ন শিক্ষাবিদ ও একজন মানবাধিকারকর্মী থাকবেন।
প্রতিবেদনের এ অংশ নিয়ে জোর আপত্তি রয়েছে পুলিশ সদস্যদের। সংস্কার কমিশন তাদের সুপারিশে সাধারণ মানুষের চাওয়াকে অগ্রাহ্য করেছে বলেও মনে করেন পুলিশ সদস্যরা। তাঁরা বলছেন, কমিশন গঠনই করা হয়েছে বিশেষজ্ঞ সদস্যদের মাধ্যমে। সেখানে যখন সংস্কার কমিশনের সুপারিশে ‘বিশেষজ্ঞ মতামত’ গ্রহণের কথা বলা হয়, তখন তাদের ভূমিকা ও সক্ষমতা নিয়ে প্রশ্ন ওঠে। এ ছাড়া ‘পরীক্ষা-নিরীক্ষা ও বিচার-বিশ্লেষণের’ কথাটিকে সংস্কারপ্রক্রিয়া ঝুলিয়ে দেওয়ার চেষ্টা বলেও মনে করছেন কর্মকর্তাদের অনেকে।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে পুলিশের ঊর্ধ্বতন একজন কর্মকর্তা প্রথম আলোকে বলেন, পুলিশের মূল সমস্যা হলো অবৈধ আদেশ ও রাজনৈতিক প্রভাব বিস্তার। এ প্রভাব বিস্তারের ক্ষেত্র প্রস্তুত হয় নিয়োগ, বদলি, পদোন্নতি ও পদায়ন ঘিরে। যদি স্বাধীন পুলিশ কমিশন গঠনের মাধ্যমে এ কাজগুলো করা যেত, তাহলে পুলিশে রাজনৈতিক প্রভাব কমে যেত। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের অধীন বর্তমান ব্যবস্থায় চলতে থাকলে এই পুলিশ কখনোই ঠিক হবে না।
এদিকে গত ১২ ফেব্রুয়ারি প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূসকে সভাপতি করে সংস্কার কমিশনগুলোর সুপারিশ বিবেচনা ও গ্রহণের জন্য জাতীয় ঐকমত্য কমিশন গঠন করে সরকার। এ–সংক্রান্ত প্রজ্ঞাপনে পুলিশ–বিষয়ক সংস্কারের সুপারিশ বিবেচনা ও গ্রহণের কথা বলা হয়েছিল। কিন্তু পরবর্তী সময়ে পুলিশ সংস্কার কমিশন ছাড়া বাকি পাঁচটি কমিশনের সুপারিশ নিয়ে কার্যক্রম শুরু করে ঐকমত্য কমিশন।
১০ মার্চ এক সংবাদ সম্মেলনে ঐকমত্য কমিশনের সহসভাপতি আলী রীয়াজ বলেন, পাঁচটি কমিশনের গুরুত্বপূর্ণ সুপারিশগুলোকে ছকের আকারে বিন্যস্ত করা হয়েছে। এই ছকে পুলিশ সংস্কার কমিশনের সুপারিশ যুক্ত করা হয়নি। পুলিশ সংস্কার কমিশন মনে করে, তাদের সুপারিশ প্রশাসনিক ব্যবস্থার মাধ্যমে বাস্তবায়ন সম্ভব।
সাবেক সচিব সফর রাজ হোসেনের নেতৃত্বাধীন পুলিশ সংস্কার কমিশনের এমন কথায় পুলিশ কর্মকর্তাদের মধ্যে ক্ষোভের জন্ম দিয়েছে। তাঁদের অনেকে মনে করেন, ‘প্রশাসনিক ব্যবস্থার’ মাধ্যমে পুলিশ সংস্কারের যে কথা বলা হয়েছে, এর মাধ্যমে বাহিনীতে সংস্কারের যে আশা তৈরি হয়েছিল, তা থমকে যাবে।
কেমন কমিশন দেখতে চেয়েছিল পুলিশ
পরিচালনা কর্তৃপক্ষ হিসেবে পুলিশ কমিশন কেমন হতে পারে, সে বিষয়ে সংস্কার কমিশনের কাছে বাহিনীর পক্ষ থেকে কিছু সুপারিশ দেওয়া হয়েছিল। পুলিশের দেওয়া সুপারিশে বলা হয়, পুলিশ কমিশন একটি সংবিধিবদ্ধ স্বাধীন ও নিরপেক্ষ কমিশন হিসেবে বিবেচিত হবে। কমিশনের সদস্য হবেন ১১ জন। আপিল বিভাগের একজন অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতি অথবা একজন অবসরপ্রাপ্ত আইজিপি কমিশনের চেয়ারপারসন হবেন। পুলিশ কমিশনের সদস্যরা স্থায়ী ও খণ্ডকালীন হিসেবে মনোনীত, নির্বাচিত বা নিযুক্ত হবেন।
জাতীয় সংসদের স্পিকার, সংসদনেতা ও বিরোধীদলীয় নেতার সঙ্গে পরামর্শক্রমে চারজন সংসদ সদস্য কমিশনের সদস্য মনোনীত হবেন। চারজনের মধ্যে দুজন সরকারি দলের ও একজন প্রধান বিরোধী দলের এবং একজন অন্য দলগুলোর সমঝোতার ভিত্তিতে মনোনীত হবেন। রাজনৈতিক ও অরাজনৈতিক উভয় শ্রেণির সদস্যদের মেয়াদ হবে চার বছর। দ্বিতীয় মেয়াদে কেউ সদস্য হতে পারবেন না।
বাছাই কমিটির সুপারিশের মাধ্যমে বিভিন্ন পেশা থেকে বাকি চারজন অরাজনৈতিক ব্যক্তি পুলিশ কমিশনের সদস্য হবেন। এর মধ্যে একজন আইনজ্ঞ, একজন অবসরপ্রাপ্ত আইজিপি, সমাজবিজ্ঞান বা পুলিশিং বিষয়ে অভিজ্ঞতাসম্পন্ন শিক্ষাবিদ ও একজন মানবাধিকারকর্মী থাকবেন। তবে চার ব্যক্তির মধ্যে অন্তত একজন নারী থাকতে হবে। বাকি দুই সদস্য হবেন স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সচিব ও আইজিপি। আইজিপি কমিশনের সদস্যসচিবের দায়িত্ব পালন করবেন।
কমিশনের তিন সদস্যের একটি অভিযোগ ব্যবস্থাপনা কমিটি থাকবে। এ কমিটি মূলত পুলিশ সদস্যদের বিরুদ্ধে বর্তমানে প্রচলিত যে অভিযোগ ব্যবস্থাপনা রয়েছে, তার আপিল কর্তৃপক্ষ হিসেবে দায়িত্ব পালন করবে।
পুলিশ সদর দপ্তরের ঊর্ধ্বতন একজন কর্মকর্তা প্রথম আলোকে বলেন, পুলিশ সংস্কারের ক্ষেত্রে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় ছিল স্বাধীন পুলিশ কমিশন গঠন। এ বিষয়ে পুলিশের পক্ষ থেকে নির্মোহভাবে বিস্তারিত প্রস্তাব কমিশনকে দেওয়া হয়েছিল। তাতে প্রয়োজনে সংযোজন–বিয়োজন করা যেত, কিন্তু সংস্কার কমিশন সেসবে না গিয়ে পুলিশ কমিশন গঠনে বিচার–বিশ্লেষণ ও পরীক্ষা–নিরীক্ষার কথা বলেছে। অবস্থা এমন যেন তাদের সুপারিশ পরীক্ষা–নিরীক্ষার জন্য আরেকটা কমিশন গঠন করতে হবে!