Image description
বুয়েটে আড়িপাতা গ্রুপের শাহবাগপন্থীরা ছাত্রলীগের নির্যাতনের সামাজিক বৈধতা তৈরি করে। বুয়েট প্রশাসন ছাত্রলীগকে সহায়তা করেছে। শিক্ষার্থী নির্যাতনে গুরুতর অভিযোগ বুয়েটের তিন ভিসি, তিন ছাত্রকল্যান পরিচালকসহ প্রভোস্টদের বিরুদ্ধে।

বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) শিক্ষার্থী আবরার ফাহাদকে ২০১৯ সালে পিটিয়ে হত্যা করে ছাত্রলীগের সন্ত্রাসীরা। আবরার হত্যায় ছাত্রলীগ দৃশ্যপটে থাকলেও  পৈশাচিক এ হত্যাকান্ডের ক্ষেত্র তৈরি করেছে ফ্যাসিবাদী শাহবাগপন্থী আরেকটি গ্রুপ। তারা বুয়েটেরই শিক্ষার্থী এবং এ হত্যাকান্ডের ক্ষেত্র প্রস্তুতে তারা নেপথ্য নায়ক হিসেবে ভূমিকা পালন করলেও রয়ে গেছে ধরাছোয়ার সম্পূর্ণ বাইরে।
আমার দেশ এর অনুসন্ধানে বেরিয়ে এসেছে আবরার হত্যার পেছনে নেপথ্য নায়ক হিসেবে ভূমিকা পালন করেছে  ‘বুয়েটে আড়িপেতে শোনা’ নামক একটি ফেসবুক গ্রুপের শাহবাগপন্থী  এবং ইসলামবিদ্বেষী হিসেবে পরিচিত বেশ কিছু সদস্য।।   

আবরার হত্যার আগে কয়েক বছর ধরে আড়িপাতা গ্রুপটির কয়েকজন এডম্যিান প্যানেল ও অনেক সদস্যের বিভিন্ন পোস্ট,  গ্রুপে তাদের বিভিন্ন কর্মকান্ড উজ্জ্বল সাক্ষী হয়ে  আছে  কিভাবে তারা ফেসবুকে ভারতের আধিপত্যাবাদের বিরোধীতা করায় বুয়েটে আবরার ফাহাদকে পিটিয়ে হত্যার পরিবেশ তৈরি করেছে। আবরার হত্যার কয়েক বছর আগে থেকেই বুয়েটে রাজনৈতিক মতপার্থক্য,সোশ্যাল মিডিয়ায় তৎকালীন আওয়ামী সরকারবিরোধী মত প্রকাশ কিংবা নামাজি শিক্ষার্থীদের শিবির আখ্যা দিয়ে পৈশাচিক নির্যাতনের এক নিষ্ঠুর অধ্যায় রচনা করেছিল ছাত্রলীগ তার সামাজিক বৈধতা তৈরিতে ভূমিকা পালন করেছিলো আড়িপাতা শোনা গ্রুপটির চিহ্নিত সদস্যরা।

২০১২ থেকে ২০১৯ সাল পর্যন্ত বুয়েটে ছাত্রলীগের হাতে যত শিক্ষার্থী আবরারের মত পৈশাচিক নির্যাতনের শিকার হয়েছে তার জন্য ভুক্তভোগীরা বুয়েট প্রশাসনকেও  দায়ী করেছেন । তাদের অভিযোগ, বুয়েট প্রশাসন ক্যাম্পাসে ছাত্রলীগের সব বর্বরতা সম্পর্কে জানত। তারা এসব বন্ধে কোন পদক্ষেপ নেয়নি বরং সহায়তা করেছে ছাত্রলীগকে। শিক্ষার্থী নির্যাতনে ছাত্রলীগকে সহায়তা বিষয়ে কয়েকজন ভুক্তভোগী ও শিক্ষক আমার দেশ এর কাছে গুরুতর অভিযোগ করেছেন তৎকালীন তিন ভিসি, তিন ছাত্রকল্যান পরিচালকসহ বিভিন্ন আবাসিক হলের প্রভোস্টদের বিরুদ্ধে। তাদের মতে প্রশাসনের প্রশ্রয়ে বুয়েটে দিনে দিনে দানবীয় রুপ ধারন করে ছাত্রলীগ।  

যেভাবে রচিত হয়  আবরার হত্যার পরিবেশ
২০১২ সালে ‘বুয়েটে আড়িপেতে শোনা’ নামক একটি ফেসবুক গ্রুপের আর্ভিভাব ঘটে। এই  গ্রুপে বুয়েটের সাবেক ও বর্তমান শিক্ষার্থীরা তাদের ব্যক্তিগত জীবনের নানা অভিজ্ঞতার কথা প্রকাশ করতেন। খুব কম সময়ে ব্যাপক জনপ্রিয়তা লাভ করে এ গ্রুপটি। 
২০১৩ সালে শাহবাগে গণজাগরণ মঞ্চের আন্দোলনের সময় শাহবাগপন্থী আর ইসলামবিদ্বেষী হিসেবে রুপ নেয় ‘বুয়েটের আড়িপেতে শোনা’   গ্রুপটি। এক পর্যায়ে গ্রুপের তৎকালীন এডমিন প্যানেল বুয়েটকে শিবিরমুক্ত করার প্রচারনায় নামে। নামে। এর অংশ হিসেবে বুয়েটের বর্তমান ও সাবেক শিক্ষার্থীদের মধ্যে যারা ছাত্রশিবিরের সাথে যুক্ত ছিলো কিংবা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে শাহবাগবিরোধী মতামত প্রকাশ করেছে তাদের সবাইকেই শিবির আখ্যা দিয়ে ২০১৪ সালের ৮ জানুয়ারি আড়িপেতে শোনা গ্রুপে নিষিদ্ধ হিসেবে চুয়াল্লিশ জনের তালিকা প্রকাশ করে গ্রুপের এডমিন, বুয়েটের ১৯৮৯ ব্যাচের এলাম্নাই ও বর্তমানে যুক্তরাষ্ট্রের ব্রাইট হরাইজন সফটওয়্যার কোম্পানিতে কর্মরত জাভেদ ইকবাল। এরপর তালিকার সবাইকে বের করে দেয়া হয় এই ফেইসবুক গ্রুপ থেকে। 

এই তালিকায় স্থান পাওয়া তৎকালীন ষোল জন বর্তমান শিক্ষার্থীর মধ্যে চৌদ্দজনই বুয়েট ছাত্রলীগের নির্মম নির্যাতনের শিকার হন বলে আমার দেশের অনুসন্ধানে জানা গিয়েছে। আড়িপাতা গ্রুপে প্রকাশিত এই নিষিদ্ধ তালিকা তৈরি ও  প্রকাশের সাথে জড়িত ছিলেন গ্রুপের তৎকালীন এডমিন ও ফ্লোরিডা আটলান্টিক ইউনিভার্সিটির পিএইচডি গবেষক মিশকাত আল আলভি (ইইই-০৭), জাবেদ ইকবাল (মেকানিকাল-৮৯), যুক্তরাষ্ট্রের প্যাটেন্ড এন্ড ট্রেডমার্ক অফিসের কর্মকর্তা মাসুদ করিম খান (সিএসই-৮৯), যুক্তরাষ্ট্র ভিত্তিক মানুষ মানুষের জন্য ফাউন্ডেশন দাতব্য সংস্থার প্রতিষ্ঠাতা চন্দ্র নাথ (মেকানিকাল-৯৭), শরিফুল ইসলাম শান্ত (ইইই-০৩), সৈকত বিশ্বাস (সিই/ডব্লিউআরই-০৪) তন্ময় বাড়ৈ (মেকানিকাল-০৯) সহ আরো অনেকে।  
কয়েক বছরের মধ্যেই তাদের এই ফ্যাসিবাদী কর্মকান্ডের নির্মম শিকার হয় বুয়েটের সাধারণ ধার্মিক শিক্ষার্থীরা যাদের সাথে ছাত্রশিবিরের কোন সম্পর্ক ছিল না। আবরার ফাহাদ হত্যার ঘটনা তার প্রমান। 

আড়িপাতা গ্রুপে শাহবাগপন্থী ও ইসলামবিদ্বেষী সদস্যদের পক্ষ থেকে এভাবে তালিকা করে শিবির ট্যাগিং কারনে বুয়েটে তখন এমন একটি পরিস্থিতি তৈরি হয় যে, বুয়েটে কেউ শিবির করলে তাকে নির্যাতন করা কোন অপরাধ নয়। শিবিরের সাথে কোন ধরণের সম্পৃক্ততা থাকলে তার বুয়েটে অধ্যয়ন কিংবা এদেশে থাকারও অধিকার নেই।  
যে কোন শিক্ষার্থীকে শিবির ট্যাগ দিয়ে নির্মম নির্যাতনের বৈধতা দেয়ার জন্য আড়িপাতার এডমিন প্যানেল এবং অনেক সদস্য উপস্থাপন করতে থাকে ঘৃন্য সব যুক্তি। 
যেমন গ্রুপে নিষিদ্ধদের এই তালিকায় “শিবির করলেই তাকে মারধোর কেন করতে হবে” শিরোনামে বিশাল এক কমেন্ট করে অন্যদের উস্কে দেয় অভিশেক মুহুরী (কেমিকেল ইঞ্জিনিয়ারিং ১৪)। 
সেখানে জার্মান প্রবাসী ফারাবি ইবনে জামাল (ইইই’০০) কমেন্টে  লিখেন “শিবির খোঁজা শুরু হোক।”
যুক্তরাষ্ট্রের ওক রিজ ন্যাশনাল ল্যাবে কর্মরত অনিক আন্দালিব মিজান (ইইই’০২) লেখেন, “এদের প্রতি বিন্দু পরিমান সহানুভূতি, ‘কিন্তু’ , ‘তবে’  ‘যদি’ থাকা উচিত না।”
দাতব্য প্রতিষ্ঠান ‘সংযোগের’ প্রতিষ্ঠাতা আহমেদ জাবেদ জামাল (কেমিকাল’৯৮) লেখেন “শিবির বের করতে ভোটাভুটি লাগে? বরং  হাইকোর্টে আপিল হোক শিবিরিয়ানদের সার্টিফিকেট বাতিল হোক।”
শরিফুল ইসলাম শান্ত (ইইই’০৩) লেখেন “যে অভিজিত রায় হত্যার পর কুৎসিত উল্রাস করে সেই তো জামাতি, যে অন্য ধর্মের মানুষকে কুৎসিত ইঙ্গিত করে সেই তো জামাতি, যে পদে পদে মিথ্যা কথা বলে নিজের সুবিধার জন্য সেই তো জামাতি, যে প্রশ্ন করলে বলে ইয়ে মানে ‘যুদ্ধাপরাধ বিচার হতে হবে কিন্তু ….....’  সেই তো জামাতি।” 

আড়িপেতে শোনা গ্রুপের প্রচারিত শিবিরের  তালিকা ও   তাদেরে এ ধরনের প্রচারণাকে ভিত্তি করে  বুয়েট শাখা ছাত্রলীগ বুয়েটকে শিবিরমুক্ত করার  নৃশংস  অভিযানে নামে।  এর অংশ হিসেবে  বুয়েট  ছাত্রলীগ ধার্মিক শিক্ষার্থীদেরকেও শিবির আখ্যায়িত করে শুরু করে  নির্যাতন। শুরু হয় বাংলাদেশের গৌরবজনক এই উচ্চ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে কলঙ্কজনক এক দীর্ঘ  অধ্যায়ের। প্রকাশ্য দিবালোকে ক্যাম্পাসে এবং বিভিন্ন আবাসিক হলের টর্চার সেলে একের পর এক শিক্ষার্থীদের নির্যাতন করে পঙ্গু করে দেয়া হয়। অনেক শিক্ষার্থীকে পিটিয়ে হাত পা ভেঙ্গে,  আধমরা অবস্থায় জঙ্গি খেতাব দিয়ে  তুলে দেয়া হত পুলিশের হাতে । নির্যাতন করে তারাই মিথ্যা মামলা দিত নির্যাতনের শিকার শিক্ষার্থীদের বিরুদ্ধে। এরই ধারাবাহিকতায় ২০১৯ সালের সাত অক্টোবর বুয়েটের শেরে বাংলা হলের শিক্ষার্থী আববার ফাহাদকে শিবির আখ্যা দিয়ে সারারাত ধরে পৈশাচিক নির্যাতন চালিয়ে হত্যা করে ছাত্রলীগের সন্ত্রাসীরা। 
বুয়েটে ছাত্রলীগের হাতে নির্যাতনের শিকার অনেক শিক্ষার্থী বলেছেন, আবরার ফাহাদ নিহত হয়েছেন তাই তাকে নিয়ে তোলপাড় সৃষ্টি হয় সারা দেশে। কিন্তু একই কায়দায় বুয়েটের আরো অনেক শিক্ষার্থীদের বছরের পর বছর ধরে নির্যাতন করেছে ছাত্রলীগের সন্ত্রাসীরা। তারা প্রাণে বেঁচে যাওয়ায় আড়ালেই ছিল বুয়েটে দীর্ঘদিন চলা ছাত্রীলগের এ পৈশাচিক বর্বরতা।  

আব্দুল কাদের মোল্লাসহ আওয়ামী ট্রাইবুনালে বিএনপি-জামায়াতের নেতাদের ফাঁসির দাবিতে ২০১৩ সালে ফ্যাসিবাদের উত্থান ঘটে শাহবাগে। বুয়েটের তখনকার অনেক শিক্ষার্থী এবং শিক্ষকদের বক্তব্য অনুসারে শাহবাগে গণজাগরণ মঞ্চের ধারাবাহিকতায় বুয়েটে সক্রিয় হয়ে ওঠে ফ্যাসিবাদকে সমর্থনকারী এই গ্রুপটি। নানা মাধ্যমে তারা তাদের ফ্যাসিবাদী চেতনা প্রকাশের পাশাপাশি সংঘবদ্ধ হতে থাকে। তারা অস্থির  করে তোলে বুয়েটের পরিবেশ। বুয়েটের ফ্যাসিস্টপন্থী এই গ্রুপ তাদের হীন লক্ষ্য চরিতার্থ করার জন্য বেছে নেয় ‘বুয়েটে আড়িপেতে শোনা’ নামক জনপ্রিয় ফেসবুক গ্রুপটিকে। আড়িপেতে শোনা  গ্রুপ বৈধতা দিতে থাকে বুয়েটে ছাত্রলীগের নির্যাতনের পৈশাচিক সব ঘটনাকে। ক্যাম্পাসে দিনে দুপুরে আড়িপাতা গ্রুপের এই শিবির তালিকার কেউ ছাত্রলীগের নির্যাতনের শিকার হলে এবং এর প্রতিবাদ করে কেউ  কোন পোস্ট দিলে শাহবাগপন্থী সদস্যরা  গ্রুপে নানা পোস্টর মাধ্যমে ঝাপিয়ে পড়ত তার বিরুদ্ধে।  তারা প্রমান করার চেষ্টা করতো নির্যাতনের শিকার শিক্ষার্থী জামাত শিবির, ফলে এই নির্যাতন তাদের প্রাপ্য। এর ফলে ছাত্রলীগ আরো উৎসাহের সাথে চালিয়ে যেতে থাকে নির্যাতন। শিবির ট্যাগ দিয়ে ধার্মিক শিক্ষার্থীদের নির্যাতনের জন্য ছাত্রলীগ বিভিন্ন আবাসিক হলে গড়ে তোলে টর্চার সেল। টার্গেটকৃত শিক্ষার্থী ধরে এনে ঘণ্টার পর ঘণ্টা রড, পাইপ, স্ট্যাম্প, হাতুড়ি, কাচের বোতল দিয়ে পেটানো হত। দিত সিগারেটের ছ্যাকা। নির্মম নির্যাতনের শিকার কয়েকজন শিক্ষার্থী আমার দেশকে বলেছেন, তাদের শরীরে ছাত্রলীগের সন্ত্রাসীরা একের পর এক স্টাম্প ভেঙ্গেছে । এক পর্যায়ে জ্ঞান হারাত তারা। কিন্তু আড়িপাতা গ্রুপের মাধ্যমে তৈরি শিবির নির্যাতনের সামাজিক বৈধতার কারণে নির্যাতিত শিক্ষার্থীদের সহায়তা করার সাহস করতোনা তাদের সহপাঠীরাও।

২০২৪ সালের ৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে শেখ হাসিনা ভারতে পালিয়ে যাওয়ার পরে বুয়েট এলাম্নাই তোফাজ্জল হোসাইন (সিই-০৯) তার সময়ের বুয়েটের পরিবেশ নিয়ে  ফেসবুকে  লিখেছেন, “বুয়েটে একটা গ্রুপ ছিল 'আড়িপাতা’ যেইটা ছিল অনলাইন টর্চার সেল। তবে ক্যাম্পাসে, অনলাইনে কিংবা অফলাইনে, বিরুদ্ধ কাউরে পাইলে মাইর। শুরুতে শিবির। হল থেকে শিবির তাড়ানোর পর, ছাত্রফ্রন্ট তাড়াইল। এরপর নিয়মিত নামাজ পড়লে তাদের উপর অত্যাচার। ছাত্রলীগের সেই মূল গ্রুপটা মদ খাইয়া কাউরে মারার মত পেলে বুধবারে পার্টি করত।“ 

রক্ষা পায়নি শিক্ষকও
বুয়েটে শিক্ষার্থী নির্যাতনের ধারাবাহিকতায় ২০১৫ সালে ঘটে আরেক ন্যাক্কারজনক ঘটনা। যুদ্ধাপরাধ বিচার নিয়ে আওয়ামী লীগের সমালোচনা করে আড়িপাতা গ্রুপে একটি কমেন্ট করেন সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের অধ্যাপক ড. জাহাঙ্গীর আলম। এ কারনে ছাত্রলীগের সন্ত্রাসীরা প্রফেসর জাহাঙ্গীর আলমকে তার রুম থেকে কলার ধরে টেনে হিচড়ে বাইরে এনে শত শত শিক্ষার্থীদের সামনে তার গায়ে হাত তোলে । অধ্যাপক জাহাঙ্গীর আলমের ওপর হামলার পেছনেও উসকানি ছিল আড়িপাতা গ্রুপের এডমিন প্যানেলের। যেমন আড়িপাতার সাবেক এডমিন ও যুক্তরাষ্ট্রের  ইউনিভার্সিটি অফ আলাবামা, বার্মিংহামের সিএসই বিভাগের অধ্যাপক রাগিব হাসানলিখেছিলেন “ বুয়েট শিক্ষক বলে এই জামাত কর্মীকে কোন ছাড় দেয়া যাবে না।” 
ক্যাম্পাসে হামলার পর আড়িপাতা গ্রুপ থেকে ব্যান করা হয় অধ্যাপক জাহাঙ্গীর আলমকে। তাকে ব্যান করে গ্রুপের  এডমিন মিশকাত আল আলভি  লেখেন “কেপি (কাঠাল পাতা ) টেস্টে সাফল্যের সাথে পাশ করার জন্য বুয়েটের শিক্ষক Jahangir Alam কে গ্রুপ থেকে ব্যান করা হল।  #“ছাগুসব- করে -রব- ফাঁসি- হইল….”

যুক্তরাষ্টভিত্তিক মানুষ মানুষের জন্য ফাউন্ডেশনের প্রতিষ্ঠাতাচন্দ্র নাথ (মেকানিকাল’৯৭) এক পোস্টে লেখেন “সরাসরি সাম্প্রদায়িক, মুক্তিযুদ্ধবিরোধী, স্বাধীনতাবিরোধী কথা বলার অপরাধে এই শিক্ষকের অপসারন শুধু নয়, আইনের আওতায় আরো বড় পরিসরে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি চাই। …… উন্নাকে ভিন্ন মতাবলম্বী বলে দায়িত্ব এড়ালে চলবে না। “

অধ্যাপক জাহাঙ্গীর আলমের বিরুদ্ধে আড়িপাতা গ্রুপের এ ধরনের  ঘৃণার চাষ এবং উসকানি দিয়ে একের পর এক পোস্ট দেয়ার পরদিনই ছাত্রলীগের সন্ত্রাসীরা ক্যাম্পাসে তার ওপর হামলা চালায়।  কেবল হামলা করেই ক্ষান্ত হয়নি ছাত্রলীগের সন্ত্রাসীরা বরং ছাত্রলীগ এবং বুয়েটের  শাহবাগপন্থীরা অধ্যাপক জাহাঙ্গীরকে বুয়েট থেকেও বহিষ্কারের দাবি তোলে।  বুয়েট প্রশাসন ছাত্রলীগ এবং ফ্যাসিবাদীদের পক্ষ নিয়ে পদত্যাগের জন্য চাপ সৃষ্টি করে অধ্যাপক জাহাঙ্গীরের ওপর।  বাতিল করা হয় বুয়েটে তার সব একাডেমিক কার্যক্রম।

তার বিরুদ্ধে দায়ের করা হয় রাষ্ট্রদ্রোহ এবং ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে দুটি মামলা। অধ্যাপক জাহাঙ্গীর আলম সম্প্রতি ফেসবুকে  দেওয়া এক পোস্টে তার ওপর অত্যাচারের বিস্তারিত ঘটনা তুলে ধরেছেন। অধ্যাপক জাহাঙ্গীর তার বিরুদ্ধে মিথ্যা মামলা এবং বুয়েট থেকে চাকরি ছাড়তে বাধ্য করার জন্য সরাসরি দায়ী করেছেন তারই বিভাগের শিক্ষক অধ্যাপক ড. আব্দুল জব্বার খানকে যিনি তখন ছিলেন বুয়েটের প্রোভিসি । অধ্যাপক জাহাঙ্গীর আমার দেশকে বলেন, চাকরি এবং বৃয়েটের বাসা ছাড়ার জন্য বিভিন্ন লোক মারফত চাপ দিতে থাকেন প্রফেসর আব্দুল জব্বার খান।  অন্যথায় আরো মামলা ও গ্রেফতারের ভয় দেখানো হয় । অবশেষে নিরাপত্তার কারনে আমি চাকরি ছাড়তে বাধ্য হই ২০২০ সালে। 

অভিযোগ বিষয়ে জানার জন্য অধ্যাপক আব্দুল জব্বার খানকে আমার দেশের পক্ষ থেকে ফোন করা হলে তিনি বলেন, “আমি এ বিষয়ে কিছু বলতে চাই না।”

চন্দ্র নাথকে ফোন করা হলে তিনি ফোন ধরেননি। পরে সাংবাদিক পরিচয় দিয়ে  টেক্সট মেসেজ করা হলে তিনি ফোন করার কারন জানতে চান। কারন লিখে জানালে তিনি অভিযোগের পক্ষে প্রমান চেয়ে  মেসেজ পাঠান। অধ্যাপক জাহাঙ্গীরের বিরুদ্ধে তার করা  একটি  পোস্টের  ছবি তুলে পাঠিয়ে বারবার ফোন করা হয় তাকে। কিন্তু  তিনি ফোন ধরেননি।   
  
আহমেদ মুছাফ্ফা (সিএসই’০৭) নামে বুয়েটের সাবেক একজন শিক্ষার্থী অধ্যাপক জাহাঙ্গীরের গায়ে হাত তোলা বিষয়ে ফেসবুকে লিখেছেন ‘শিক্ষার্থীদের দ্বারা শিক্ষক পেটানোর ঘটনা বুয়েটের ইতিহাসে এই প্রথম। এ ঘটনার ইন্ধনদাতা হল আড়িপাতা গ্রুপ।’
 
অধ্যাপক জাহাঙ্গীরের বিরুদ্ধে আড়িপাতা গ্রুপে উস্কানিমূলক মন্তব্য এবং অতীত জীবনের ভুলের জন্য অনুতাপ প্রকাশ করে সম্প্রতি দীর্ঘ এক পোস্ট দিয়েছেন রাগিব হাসান। এ পোস্টে তিনি অধ্যাপক জাহাঙ্গীর আলমসহ সবার কাছে ক্ষমা চেয়েছেন।। আমার দেশের পক্ষ থেকে যোগাযোগ করা হলে তিনি বলেন, “আমার জীবনের সবচেয়ে বড় একটা ভুল ছিল ওই পোস্ট। সেজন্য আমি আল্লাহর কাছে এবং অধ্যাপক জাহাঙ্গীর আলমের কাছে ক্ষমা চেয়েছি। অধ্যাপক জাহাঙ্গীর আলম আমাকে ক্ষমা করেছেন এবং তার সাথে আমার বর্তমানে খুব ভাল সম্পর্ক।”
আডিপাতা গ্রুপের সাবেক এডমিন নাসরুল ইসলাম সোহানও (কেমিকেল’০২)  ২০২০ সালে আবরার হত্যাকান্ডের পরে আড়িপাতা গ্রুপের ফ্যাসিবাদী কর্মকান্ডে তার অংশগ্রহণের জন্য ক্ষমা চেয়ে পোস্ট দিয়েছিলেন।

আবরার হত্যায় আড়িপাতা গ্রুপের বিরুদ্ধে শিক্ষার্থীদের অভিযোগ
নুরে আলম সিদ্দিকি নামে বুয়েটের একজন শিক্ষার্থী ফেসবুকে লিখেছেন “আবরার হত্যার পটভূমি তৈরির জন্য আড়িপাতা এবং এর এলিট অনেকে দায়ী।” 
এনামুল হক রাইয়ান নামে বুয়েটের আরেক শিক্ষার্থী লিখেছেন, “এরাই  আবারার ফাহাদ হত্যাকারীদের উত্তরসুরী। এদেরও বিচার হওয়া উচিত। জামাত শিবির ট্যাগিং দিয়ে গ্রুপ থেকে বের করে দেয়া শুরু করেছেন উনারা আর দুনিয়া থেকে বের করে দেয়ার কাজটা করেছে  এদের অনুসারীরা।” 
সাফফাত হোসেন নামে আরেক শিক্ষার্থী লিখেছেন “শিবির ট্যাগিং ব্যাপারটা জাভেদ ইকবাল সাহেব এবং তার সহমত ব্রাদার্স যেভাবে উৎসবের আমেজের সেলিব্রেট করসে, তাতে ছাত্রলীগের অনুসারীরা যা ইচ্ছা তা করার লাইসেন্স পাইসে। এর ফলাফল ছিল ৫ বছরের মাথায় আবরারের মৃত্যু।”
জুয়েল ফাহাদ নামে একজন শিক্ষার্থী লিখেছেন, “আবরার ফাহাদ হত্যার পরিবেশ তৈরিতে এরকম শত শত জাভেদ সাহেবের রক্তাক্ত হাত আছে। “ 
আল আমিন খান চৌধুরী নামের আরেক শিক্ষার্থী লিখেছেন “ এই গ্রুপটি ফ্যাসিবাদের হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহৃত  হয়েছে। সরকার বিরোধীদের হেনস্থার জন্য ঘৃণার চাষ করেছে। যার কারনে অপদস্থ হয়েছেন বুয়েটের শিক্ষক, নিষ্ঠুরভাবে হত্যা করা হয়েছে একজন মেধাবী ছাত্রকে ।”

আড়িপাতা গ্রুপের অন্যান্য ফ্যাসিবাদী সদস্যদের নাম
আমার দেশের অনুসন্ধানে বুয়েটে আবরার হত্যার পরিবেশ তৈরিতে আড়িপাতা গ্রুপের এডমিনসহ যে সব সদস্যদের ভূমিকা জানা গিয়েছে তারা হলো- মিশকাত আল আলভী, তন্ময় বাড়ৈ,  চন্দ্র নাথ, জাভেদ ইকবাল, সৈকত বিশ্বাস, শরিফুল ইসলাম শান্ত (ইইই’০৩), চন্দন শিকদার (ইইই’০০), মাসুদ করিম খান (সিএসই’৮৯), রিসালালত বারি (ইইই'০১), ইয়াসির আরাফাত (ইইই’৯৮), , বিধান চৌধুরী (কেমিকেল’৯৬), জয়দীপ দাস (সিএসই), ফারহান ইবনে জামাল (ইইই’০০), শরিফ চয়ন (সিভিল’০৪), অর্নব মালাকার (এমএমই’১০), গোলাম মোস্তফা, হামিদুল হাসান নবিন(ইউআরপি’০৭), ফাইয়াজ জামাল (সিএসই’৯৯), মাহফুজুর রশিদ সাচ্চু (সিভিল’৯৫), আব্দুস সালেক রেজা (সিভিল’৯৬),আলবাব ইয়াফেজ ফাতমি (সিভিল’০৪), সুতপা দাস (আর্কিটেকচার), ফারহানা জিসা (আইপিই’০৫), নসরুল ইসলাম সোহান (কেমিকেল’০২), শরিফুর রহমান সৌরভ, আহমেদ জাবেদ জামাল (কেমিকেল-৯৮), খালেদ রেদওয়ান চৌধুরী (ইইই-০৩), মোহাম্মদ উল্লাহ খান (ইইই-৯৪), ফাহমিদা শাহরীন টিউলিপ (ইইই-০২), আন্দালীব নিজাম (ইইই-০২), সালওয়া মোস্তাফা (ইইই-০১), আবু মুসা আব্দুল্লাহ সৌরভ (মেকানিকাল’১১) ও চরম উদাস। 

আবরার হত্যা এবং ছাত্রলীগের নির্যাতনে বুয়েট  প্রশাসনের সহযোগিতা 

আড়িপাতা গ্রুপে শিবির আখ্যা দিয়ে ডিহিউম্যানাইজেশন এবং তালিকাভুক্ত শিক্ষার্থীদের নির্যাতনে সামাজিক বৈধতা দেওয়ার পাশাপাশি ছাত্রলীগের নির্যাতনে সহায়তা করতো বুয়েট প্রশাসনও। বুয়েটে ২০১২ থেকে ২০১৯ সালে আবরার হত্যাকাণ্ড পর্যন্ত ধার্মিক শিক্ষার্থীদের ওপর পৈশাচিক নির্যাতনে ছাত্রলীগকে কিভাবে প্রশাসন সহায়তা করেছে তার একজন অন্যতম সাক্ষী এমএমই বিভাগের প্রফেসর ড. মনিরুজ্জামান। প্রফেসর মনিরুজ্জামান আমার দেশকে বলেন, ২০১৮ সালের একটি ঘটনা।  তখন আমি বিভাগের প্রধান।  আল আরাফাত হোসেন নামে আমার এক ছাত্র একদিন আমাকে ফোন দিল। সে বলল, ছাত্রলীগ তাকে খুঁজছে। আমি যেন তাকে উদ্ধারের ব্যবস্থা করি। আমি ছিলাম আরাফাতের উপদেষ্টা । আমি তাকে জিজ্ঞেস করলাম “তুমি কোথায়”। সে আমাকে জানাল  ইসিই ভবনের ১৪ তলার একটি রুমে লুকিয়ে আছে। আমি ফোন দেই ছাত্রকল্যান পরিচালক প্রফেসর ড. সত্য প্রসাদ মজুমদারকে। সত্য প্রসাদ মজুমদার সেখানে গেলেন এবং আমাকে জানালেন ছাত্রলীগের ছেলেদের তিনি বুঝিয়ে সরিয়ে দিয়েছেন। কোন সমস্যা নেই। আমি যেন আরাফাতকে নিয়ে যাই।  


আমি আরাফাতকে আনার জন্য আমার বিভাগের  শিক্ষক হুমায়ুন আহমেদকে পাঠাই। কিন্তু তিনি সেখানে গিয়ে আমাকে ফোনে জানালেন ছাত্রলীগের লোকজন তার কাছ থেকে আরাফাতকে ছিনিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করছে। আমি  বললাম তুমি মার খেলেও আরাফাতকে তাদের হাতে দিবা না। অনেক ঘটনার পর একটি রিক্সায় করে তিনি  আরাফাতকে নিয়ে আসলেন। রিক্সায় তাদের পেছনে পেছনে মটর সাইকেলে করে সিনেমা স্টাইলে  আসল ছাত্রলীগের ১২/১৩ জন।  এসময় আমার বিভাগের আরো কয়েকজন শিক্ষক আমাদের কাছে হাজির হলেন। ছাত্রলীগের ছেলেরা আরাফাতকে শিবির আখ্যায়িত করে তাদের কাছে তুলে দেওয়ার দাবি করল। আমি তাদের দাবি মানতে অস্বীকার করলে তারা আমাদের সাথে দুব্যর্বহার করে বলল, “আপনারা রাজাকার ছেলেদের পড়ান। আপনারা স্বাধীনতাবিরোধী।” এরপর তারা এক পর্যায়ে আরাফাতকে আমাদের কাছ থেকে জোর করে  চুল ধরে মারতে মারতে নিয়ে গেল। আরাফাত তখন হাউমাউ করে কাঁদতে ছিল। ছা্ত্রলীগের ছেলরা আরাফাতকে জিমনেসিয়ামের পেছনে নিয়ে নির্মমভাবে পেটাতে লাগল। তাকে পেটানোর দৃশ্য দেখতেছিল এরকম একজন ছাত্র আমাকে সেখান থেকে ফোন করে জানাল নির্যাতনের কথা।  আমি তখন আমার বিভাগের  শিক্ষক প্রফেসর আমিনুল ইসলামকে নিয়ে  ছুটে গেলাম ভিসি প্রফেসর সাইফুল ইসলামের কাছে। আমি তাকে সব ঘটনা বলার পর তিনি বললেন, “এ ব্যাপারে আমার কিছু করার নেই।”


 আমি তার এ কথা শুনে বিস্ময়ে হতবাক হয়ে গেলোম এবং তার এ কথার প্রতিবাদ করলাম। এক পর্যায়ে আমি বললাম, আপনি কিছু না করেন অন্তত রেজিস্ট্রারকে বলেন। তখন তিনি বাধ্য হয়ে তার পিএস কামরুলকে বললেন রেজিস্ট্রারে সাথে এ বিষয়ে কথা বলতে এবং পদক্ষেপ নিতে। এসময় আমার কাছে খবর আসতে থাকে  ছাত্রলীগের ছেলেরা আরাফাতকে নির্মমভাবে অত্যাচার করে চলছে। আমি তখন অওয়ামী লীগ হিসেবে পরিচিত কয়েকজন শিক্ষক, ছাত্রলীগের যারা মারছে তাদের কয়েকজনের সরাসরি শিক্ষকদেরও ফোন দিলাম। কিন্তু কেউ কোন সাড়া দিল না। ছাত্রকল্যান পরিচালক প্রফেসর সত্য প্রসাদ মজুমদারকে জানালাম আরাফাতকে ছাত্রলীগের ছেলেরা ক্যাম্পাসে পেটাচ্ছে, তাকে উদ্ধারের ব্যবস্থা করুন। তিনি তখন আমাকে বললেন, “আমি মিটিংয়ে আছি।” তার এ কথা শুনে আমি আবারো হতবাক হয়ে গেলোম। আমি তাকে বললাম আপনি না বলেছিলেন, ছাত্রলীগের ছেলেরা চলে গেছে। আরাফাত নিরাপদ। কিন্তু তিনি আমার কথার কোন জবাব দিলেন না এবং আরাফাতকে উদ্ধারেরও কোন ব্যবস্থা গ্রহণ করলেন না। 


পরে আমি রেজিস্ট্রারের সাথে যোগাযোগ করতে লাগলাম।  তার উদ্যোগে এক পর্যায়ে ঘটনাস্থলে আসলেন লালবাগ থানার ওসি, উপ-ছাত্রকল্যান পরিচালক প্রফেসর মোস্তফা এবং চিফ সিকিউরিটি অফিসার। তারা তাকে উদ্ধার করে ঢাকা মেডিকেল কলেজে ভর্তি করায় গুরুতর আহত অবস্থায়।
প্রফেসর মনিরুজ্জামান আমার দেশকে বলেন, সেদিন যদি আরাফাতকে উদ্ধার করা না যেত তাহলে হয়ত সে ঘটনাস্থলেই মারা যেত। আরাফাত সেদিন মারা গেলে সেটা হত একটি টার্নিং পয়েন্ট এবং আবরার ফাহাদ হয়ত মারা যেত না। আবরার ফাহাদ মারা যাওয়ায় সেটা টার্নিং পয়েন্টে রুপ নেয় এবং জাতি জানতে পারে বুয়েটের অন্ধকার অধ্যায়ের কথা। 

ছাত্রলীগের নির্যাতনের শিকার আল আরাফাত হোসেন গত ফেব্রুয়ারি মাসে শাহবাগ থানায় মামলা করেছেন । মামলায় তিনি ছাত্রলীগের সন্ত্রাসীদের সাথে আসামী করেছেন বুয়েটের তখনকার ছাত্রকল্যান পরিচালক (প্রক্টর) ও পরবর্তীতে ভিসি প্রফেসর ড. সত্য প্রসাদ মজুমদারকে । আরাফাত ছিলেন ২০১৫ ব্যাচের এমএমই বিভাগের ছাত্র। আমার দেশকে আরাফাত  হোসেন বলেন, ২০১৮ সালের ২৪ জানুয়ারি ক্যাম্পাসে প্রকাশ্য দিবালোকে তাকে নির্মম নির্যাতন করে ছাত্রেলীগের সন্ত্রাসীরা।  নির্যাতনের বিস্তারিত বিবরণ তুলে ধরে আরাফাত হোসেন বলেন, ঘটনার পূর্বাপর পরিস্থিতি বিচার করে আমি বুঝতে পারি আমার ওপর নির্যাতনের ঘটনায় খুব ঘনিষ্ঠভাবে জড়িত ছিলেন ছাত্রকল্যান পরিচালক প্রফেসর সত্য প্রসাদ মুজমদার। আমাকে ইসিই ভবনে ছাত্রলীগের ছেলেরা প্রথমে ছিনিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করলে আমার বিভাগের হুমায়ুন স্যার সত্য প্রসাদ মজুমদারকে অনুরোধ করেছিলেন তিনি যেন আমাকে গাড়িতে করে নিয়ে যান। কিন্তু তিনি সেদিকে ভ্রুক্ষেপ না করে তড়িঘড়ি করে চলে যান। পরবর্তীতে আমি বুঝতে পারি, আমাকে খুঁজে বের করে ওদের হাতে দেওয়ার জন্যই তিনি এসেছিলেন ঘটনাস্থলে। তিনি আমাকে ছাত্রলীগের কাছে ধরিয়ে দেওয়ার বিষয়ে সহযোগিতা করেছেন। 
আরাফাত বলেন, আমাকে জিমনেশিয়ামের পেছনে নিয়ে শাপের মত পেটাতে থাকে। আমার পিঠে একটার পর একটা স্ট্যাম্প ভাংতে থাকে তারা। এক পর্যায়ে আমি জ্ঞান হারাই।
বুয়েটের তখনকার ভিসি প্রফেসর সাইফূল ইসলামকে আমার দেশ থেকে ফোন করা হলে তিনি প্রশ্ন শেষ করার আগেই বলেন, আমি এখন ব্যস্ত আছি। পরে কথা বলব, এই বলে ফোন রেখে দেন। পরে ফোন করা হলেও তিনি আর ফোন ধরেননি। 

সত্য প্রসাদ মজুমদারকে ফোন করা হলে তিনি ফোন রিসিভ করেননি।  তার নম্বরে সাংবাদিক পরিচয় দিয়ে টেক্সট  করার পর কয়েকবার  ফোন দেওয়া হলে বন্ধ পাওয়া যায় তার ফোন।  

এ বছর ফেব্রুয়ারি মাসে শাহবাগ থানায় মামলা করেছেন ছাত্রলীগের হাতে নির্যাতনের শিকার ও আড়িপাতার সেই তালিকাভুক্ত আরেক শিক্ষার্থী তানজিলুর রহমানের পিতা। তানজিলুর রহমান ২০১০ ব্যাচের এমএমই বিভাগের শিক্ষার্থী ছিলেন।  ফেসবুকে আওয়ামী সরকারের সমালোচনা ও আড়িপাতার তালিকায় থাকায় ছাত্র্রলীগ বুয়েটে তাকে দুই দফা নির্মম নির্যাতন করে। তানজিলুর রহমানের পিতা মামলায় তার ছেলের ওপর নির্যাতনের জন্য ছাত্রলীগের সন্ত্রাসীদের সাথে আসামী করেছেন বুয়েটের তখনকার ছাত্রকল্যান পরিচালক প্রফেসর ড. দেলোয়ার হোসেনকে।  যুক্তরাষ্ট্রে অবস্থানরত তানজিলুর রহমান আমার দেশকে জানিয়েছেন, ২০১৪ সালে তিনি একাডেমিক কাজে ক্যাম্পাসে গেলে ছাত্রলীগের সন্ত্রাসীরা তার উপরে হামলা করে। তিনি ল্যাবের গার্ডরুমে প্রবেশ করে ভেতর থেকে দরজা বন্ধ করে দিয়ে বাচার জন্য চিৎকার করতে থাকেন। তখন বিভাগের অনেক শিক্ষক সেখানে হাজির হন। এক পর্যায়ে হাজির হন ছাত্রকল্যান পরিচালক ড. দেলোয়ার হোসেন। কিন্তু দেলোয়ার হোসেন তাকে উদ্ধার না করে সেখান থেকে চলে যান। পরে ছাত্রলীগের সন্ত্রাসীরা রুমের দরজা ভেঙ্গে তাকে বের করে নির্মমভাবে পিটিয়ে হাত ভেঙ্গে দেওয়াসহ গুরুতর জখম করে। 
তানজিলুর রহমান বলেন, ছাত্রকল্যান পরিচালক দেলোয়ার হোসেন সেখানে এসেছিলেন লোক দেখানোর জন্য। এভাবে অন্য সব নির্যাতনের ক্ষেত্রেও তার ভূমিকা ছিল একই রকম। 

২০১৬ সালের মে মাসের ২ তারিখ বুয়েটের শেরে বাংলা হলে ছাত্রলীগের নির্যাতনের শিকার হন ইউআরপি’১১ ব্যাচের সোলাইমান খান তাকে শিবির আখ্যা দিয়ে নির্মম নির্যাতন করে ছাত্রলীগের সন্ত্রাসীরা। এ বিষয়ে সোলাইমান খান সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে লিখেছেন, “রাত ১১টা থেকে পরের দিন সকাল সাতটা পর্যন্ত তিনিসহ মোট ছয়জনকে থেমে থেমে পিটিয়েছে ছাত্রলীগের সন্ত্রাসীরা। পরের দিন DSW ( ছাত্রকল্যান পরিচালক ড. দেলোয়ার হোসেন) আমাকে ফোন করে উপদেশ দিয়ে বলেন, জলে বাসা করে তো আর কুমিরের সঙ্গে লড়াই করা যায় না। তুমি বাবা তাদের সঙ্গে মানিয়ে চল”।

আড়িপাতার শিবির তালিকাভুক্ত আরেক শিক্ষার্থী সৈয়দ জিয়াউদ্দিনকে (মেকানিকাল-০৯)  বুয়েট ক্যাম্পাসে প্রকাশ্যে শত শত শিক্ষার্থী এবং শিক্ষকদের সামনে ছাত্রলীগের  সন্ত্রাসীরা শাপের মত পিটিয়ে অজ্ঞান করে। সম্প্রতি তার স্ত্রী শারিন সফি অদ্রিতা এক পোস্টে ছাত্রকল্যান পরিচালক ড. দেলোয়ার প্রসঙ্গে লিখেছেন তাকে তখন  ঘটনা জানানো হলেও তিনি বলেন, “এ ব্যাপারে আমার করার কিছু নেই।” 
ফেসবুকে সরকারের সমালোচনা করায় আড়িপাতায় একই তালিকাভুক্ত আরেক শিক্ষার্থী বুয়েট ক্যাম্পাসে নির্যাতনের শিকার এনামুল হক (কেমিকেল’১১) আমার দেশকে বলেন, ড. দেলোয়ার ছাত্রকল্যান পরিচালক থাকা অবস্থায় নির্যাতনের শিকার কোন শিক্ষার্থী তার কাছে থেকে কোন সহায়তা পায়নি। তাকে জানানো হলে তিনি তাদের উদ্ধারে এগিয়ে আসতেন না। লোক দেখানোর জন্য আসলেও তাদেরকে উদ্ধার না করে চলে যেতেন।নির্মম নির্যাতনের শিকার এনামুল হক নিরাপত্তার অভাবে বুয়েটে পড়াশোনা সমাপ্ত না করতে পেরে মালয়েশিয়ায় গিয়ে পড়াশোনা করতে বাধ্য হন।

শিক্ষার্থী নির্যাতনে সহায়তার অভিযোগ বিষয়ে ড. দেলোয়ার হোসেনকে ফোন করা হলে তিনি ক্ষিপ্ত হয়ে বলেন, “এসব আগডুম বাগডুম বলে লাভ হবে না। আপনি তদন্ত করেন, বুয়েটে যান।” 
তখন তাকে বলা হয়, তদন্তের অংশ হিসেবেই আপনার কাছে জানতে চাচ্ছি অভিযোগ বিষযে। তখন ড. দেলোয়ার হোসেন বলেন, আপনি কে তদন্ত করার। এরপর ফোন রেখে দেন তিনি। 

২০১২  থেকে ২০১৯ সালে আবরার হত্যা পর্যন্ত পর্যায়ক্রমে বুয়েটের ভিসি ছিলেন প্রফেসর এস এম নজরুল ইসলাম, প্রফেসর খালেদা একরাম, প্রফেসর সত্য প্রসাদ মজুমদার এবং প্রফেসর সাইফুল ইসলাম। ২০১২ থেকে ২০১৯ সাল পর্যন্ত   বুয়েটের ছাত্রকল্যান পরিচালক ছিলেন  . ড. দেলোয়ার হোসেন, ড. সত্য প্রসাদ মজুমদার এবং ড. মিজানুর রহমান রফিক। 

ড. মিজানুর রহমান ও ড. দেলোয়ার শিক্ষক থাকা অবস্থায়ই আওয়ামী লীগের বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি  বিষয়ক উপকমিটির সদস্য ছিলেন। 
ভুক্তভোগী কয়েকজন শিক্ষার্থী ছাত্রলীগের নির্যাতনে সহায়তা বিষয়ে গুরুতর অভিযোগ করেছেন উপরোক্ত তিন ছাত্রকল্যান পরিচালকের বিরুদ্ধে । এ ছাড়া তারা ছাত্র নির্যাতনের বিষয়ে গুরুতর অভিযোগ করেছেন ভিসি প্রফেসর নজরুল ইসলাম, প্রফেসর সত্য প্রসাদ মজুমদার ও ভিসি প্রফেসর সাইফুল ইসলামের বিরুদ্ধে। 

আবরার হত্যার পর ঘটনা ধামাচাপা দেওয়া, ঘটনাকে অন্যখাতে প্রবাহিত করা, সিসিটিভি ফুটেজ ধ্বংস করা এবং আবরারকে শিবির প্রমানের চেষ্টা করে ছাত্রলীগ। ছাত্রলীগের এ কাজে প্রশাসন সহায়তা করে বলে অভিযোগ করেছেন অনেক শিক্ষার্থী। তবে সাধারণ শিক্ষার্থীদের প্রতিবাদের কারনে তাদের এসব হীন চেষ্টা ব্যর্থ হয়ে যায়।  
আবরার হত্যার সময় বুযেটের ভিসি ছিলেন প্রফেসর সাইফুল ইসলাম এবং ছাত্রকল্যান পরিচালক ছিলেন ড. মিজানুর রহমান। ড. মিজানুর রহমানকে বারবার ফোন এবং টেক্সট করো হলেও তিনি ফোন ধরেননি।
আবরার হত্যার সময় বুয়েটের ভিসি প্রফেসর সাইফুল ইসলাম বর্তমানে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়  এআইইউবির  উপাচার্য। 
ছাত্রলীগের হাতে নির্মম নির্যাতনের শিকার কয়েকজন শিক্ষার্থী আমার দেশকে বলেছেন,  প্রশাসনের দায়িত্ব ক্যাম্পাসে  প্রতিটি শিক্ষার্থীর নিরাপত্তা নিশ্চিত করা। বছরের পর বছর ধরে বুয়েটে ছাত্রলীগ যে পৈশাচিক বর্বরতা চালিয়ে আসছিল সে বিষয়ে সম্পূর্ণরুপে অবহিত ছিল বুয়েট প্রশাসন। কিন্তু তারা ছাত্রলীগের এ বর্বরতা থেকে সাধারণ শিক্ষার্থীদের রক্ষায় এগিয়ে আসেনি।  বিভিন্ন সময় প্রশাসনকে লিখিত ও মৌখিক উভয়ভাবে ছাত্রলীগের নির্যতানের কথা জানানো হলেও তারা কোন ব্যবস্থা নেয়নি। এমনকি বিভিন্ন হলের টর্চার সেলে সারারাত ধরে পেটানোরত অবস্থায়ও দায়িত্বরত শিক্ষকদের কাছে অন্য শিক্ষার্থীরা ছুটে গিয়েও সাড়া পাননি প্রশাসনের । ভুক্তভোগী শিক্ষার্থীরা আমার দেশকে অভিযোগ করে বলেছেন প্রশাসন যদি চাইত তাহলে কোন অবস্থাতেই ছাত্রলীগ এ ধরনের নির্যাতন চালাতে পারত না এবং আবরার হত্যার মত কলঙ্কিত ঘটনা ঘটত না । প্রশাসনই ছাত্রলীগকে সহায়তা করেছে বুয়েটে দানবীয় রুপে আবির্ভূত হতে। 

ভুক্তভোগী শিক্ষার্থীদের অভিযোগ বিশ্ববিদ্যালয়ের গুরুত্বপূর্ণ প্রশাসিনক পদে দায়িত্বপ্রাপ্ত শিক্ষকরা ছিলেন মূলত আওয়ামী লীগের। প্রশাসনের পদে থেকে তারা ছাত্রলীগকে সহায়তা করেছে শিবির দমনের নামে সাধারণ ধার্মিক শিক্ষার্থীদের নির্মম নির্যাতন এবং বুয়েটে তাদের শিক্ষা জীবন ধ্বংসের জন্য। 

আবরার ফাহাদের ছোট ভাই ফাইয়াজ আবরার আমার দেশকে বলেন, আবরার হত্যা এবং তার আগে বুয়েটে ছাত্রলীগের হাতে শিক্ষার্থী নির্যাতনের ঘটনায় প্রশাসনের দায় আছে।  ছাত্রলীগের নির্যাতনের শিকার বুয়েটের শিক্ষার্থী ইকবাল মাহমুদ আমার দেশকে বলেন, প্রশাসনকে জানানো হলে তারা উল্টো নির্যাতনের শিকার শিক্ষার্থীদের দোষারোপ করত। 

নির্যাতনের শিকার এনামুল হক বলেন, আড়িপাতার উস্কানি ও বুয়েট প্রশাসনের সহায়তায় উপাচার্য নজরুল ইসলামের সময় শুরু হয় শিবির আখ্যা দিয়ে ধার্মিক শিক্ষার্থী নির্যাতনের এক পৈশাচিক অধ্যায়। এনামুল হক বলেন, ভিসি নজরুল ইসলাম ক্যাম্পাসে ছাত্রলীগকে ব্যবহার করেছেন তার লাঠিয়াল  বাহিনী হিসেবে। 
ভিসি নজরুল ইসলামকে ফোন করা হলে তিনি ফোন রিসিভ করেননি। পরে সাংবাদিক পরিচয় দিয়ে টেক্সট পাঠানোর পর আবার ফোন করা হলেও তিনি ফোন ধরেননি। 
এনামুল হক বলেন, বুয়েট ক্যাম্পাসে দীর্ঘদিন ধরে ছাত্রলীগের অন্যতম পৃষ্ঠপোষক ছিলেন সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের প্রফেসর প্রোভিসি ড. আব্দুল জব্বার খান। তিনিও আওয়ামী লীগের বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিষয়ক উপকমিটির সদস্য ছিলেন। 

বিভিন্ন সময়ে আড়িপাতার সেই তালিকাভুক্ত শিক্ষার্থীদের নির্যাতনে জড়িত থাকায় ছাত্রলীগের যে সব সন্ত্রাসীদের নামে নির্যাতিত শিক্ষার্থীরা অভিযোগ অথবা মামলা করেছেন তারা হলো- রওনক আহসান (সিএসই’০৪), ফাইরুজ চৌধুরী (সিভিল’০৬), আমিনুল হক পলাশ (কেমিকেল’০৬, তানভীর মাহমুদ আরাফাত (সিএসই’০৭), ইমরান হোসেন (ডাব্লিউআরই’০৭), সাইফুল্লাহ সিকদার মিঠুন (এমএমই০৮), সুজিত সাহা (এমএমই’০৮), শুভ্র জ্যোতি টিকাদার (মেকানিকাল’০৯), আরিফ রায়হান দিপ (মেকানিকাল’০৯), সিয়াম হোসেন (মেকানিকাল’০৯), আবু আনাস শুভম (মেকানিকাল’০৯), আরিফুর রহমান কাজল (সিভিল’০৯), জয় প্রকাশ রায় (কেমিকেল’০৯), আবু সাইদ কনক (মেকানিকাল’১০), সাদমান প্রতীক (সিভিল’১০), শিহামুজ্জামান শান্ত (সিভিল’১০), সৌম্য কান্তি দাশ (ইইই’১০), আনোয়ার হাবিব অনিক (সিভিল’১০), প্রতীক দত্ত (ইইই’১১), অনির্বান সাহা (সিভিল’১১), শেখ তানভীর রায়হান (সিভিল’১১), আহসান উল্লাহ (মেকানিকাল’১১), মাহমুদুল হাসান সাগর (নেভাল’১১), অনুপ কুমার বিশ্বাস (ইউআরপি’১১), আকাশ দেবনাথ (সিভিল’১২), জামিউস সানি (মেকানিকাল’১২), অভিজিত সাহা নয়ন (সিভিল’১২), দেবদ্যুতি সরকার (সিভিল’১২), শাফায়েত চৌধুরী জয় (সিভিল’১২) ও ইমতিয়াজ হোসেন (সিভিল’১২)।

বুয়েট শিক্ষার্থীদের অভিযোগ- আবরার হত্যার জন্য ছাত্রলীগের ২৫ জনের সাজা হয়েছে। কিন্তু আবরার হত্যা এবং তার আগে ২০১২ সাল থেকে ছাত্রলীগের যে পৈশাচিক নির্যাতনের জন্য আড়িপাতা গ্রুপের অনেক সদস্য এবং বুয়েট প্রশাসন দায়ী হলেও তারা রয়ে গেছে ধরাছোয়ার সম্পূর্ণ বাইরে। তাদেরও বিচারের আওতায় আনার দাবি জানিয়েছেন ভুক্তভোগী শিক্ষার্থীরা। 





























সূত্রঃ দৈনিক  আমারদেশ, ১৬ মার্চ ২০২৫