Image description
 

শেখ হাসিনা তার অবৈধ ক্ষমতা পাকাপোক্ত করতে রাষ্ট্রীয় যে কটি অঙ্গনকে বিনষ্ট করেছেন, তার মধ্যে বিচার বিভাগ অন্যতম। ফলে বিগত ১৬ বছর বিচার বিভাগ হয়ে দাঁড়ায় আওয়ামী রাজনৈতিক ফায়দা হাসিলের অন্যতম হাতিয়ার। এ সময় উচ্চ আদালত থেকে শুরু করে নিম্ন আদালত পর্যন্ত সব জায়গায় হয়েছে দুর্নীতি ও দলীয়করণ। হত্যা, গুম, খুন, অপহরণ হওয়ার পরও ভুক্তভোগীদের মামলা না নেওয়া, আর্জি না শোনা এবং উল্টো আদালতের সহায়তায় মিথ্যা মামলায় ফাঁসিয়ে মাসের পর মাস রিমান্ডে নির্যাতন ছিল নিত্যদিনের ঘটনা।

 

এর ফলে শেখ হাসিনার শাসনামলে বিচার বিভাগের প্রতি সাধারণ মানুষের আস্থা তলানিতে পৌঁছায়। ৮৫ শতাংশ মানুষই হয়রানির শিকার হয়ে বিচার বিভাগের প্রতি আস্থা হারায়। বিচার বিভাগ সংস্কার কমিশনের সাম্প্রতিক প্রতিবেদনে এ তথ্য উঠে এসেছে।

 

সংস্কার কমিশনের সাম্প্রতিক প্রতিবেদনে দেখা যায়, ৮৪ দশমিক ৯০ শতাংশ মানুষই বিচার বিভাগের কাজে আদালতে ঘুস দিতে বাধ্য হয়েছেন। একই ভাবে বিগত ১৬ বছরে ৯০ শতাংশ বিচারপ্রার্থী চরম হয়রানির শিকার হয়েছেন। ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ (টিআইবি) কর্তৃক পরিচালিত ২০২৩ সালের এক জরিপে দেখা যায়, ৭৪ শতাংশ মানুষকে আদালতে ঘুস দিতে বাধ্য করা হয়।

 

বিশ্লেষকরা জানান, এই জরিপ থেকে বোঝা যায় কীভাবে বিগত ১৬ বছর রাষ্ট্রের গুরুত্বপূর্ণ এই অঙ্গকে শেষ করে দিয়ে বিচারে আস্থাহীনতা তৈরি করা হয়েছিল। এ সময় বিচার পাওয়ার মানুষের ন্যায়সঙ্গত অধিকারকে দুঃস্বপ্নে পরিণত করা হয়েছিল। উক্ত জরিপগুলো বিশ্লেষণ করে বিচার বিভাগ সংস্কার কমিশন জানায়, যারা আদালতে ঘুস গ্রহণ করছে শুধু তাদের দায়ী করলেই চলবে না, যারা ঘুস দিয়ে অবৈধ নানা সুবিধা বাগিয়ে নিয়েছিল তাদেরও আইনের আওতায় আনতে হবে। বলা হয়, বিচার ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে দুর্নীতিমুক্ত করতে হলে বিচারকদের স্বচ্ছতা, দলীয়করণ বন্ধ, জবাবদিহি নিশ্চিতের পাশাপাশি বিচার প্রক্রিয়ার সঙ্গে জড়িত সব পক্ষকে জবাবদিহি ও রাজনৈতিক প্রভাবমুক্ত করতে হবে।

 

তবে ৫ আগস্টের পর প্রধান বিচারপতি হিসেবে যোগ দেওয়া সৈয়দ রেফাত আহমেদ শুরুতেই বিচার বিভাগের আস্থা ফেরাতে কাজ শুরু করেন। দীর্ঘদিনের পুঞ্জীভূত দুর্নীতি-দলীয়করণ দূর করে সাধারণ মানুষের আস্থা ফেরাতে নেন নানামুখী উদ্যোগ।

 

গুমের শিকার মারুফ জামানের রিট নেয়নি কেউ

বিশিষ্ট কূটনীতিক মারুফ জামানকে রাজধানীর বিমানবন্দর এলাকা থেকে ২০১৭ সালের ৪ ডিসেম্বর প্রকাশ্যে অপহরণ করা হয়। থানায় যোগাযোগ করেও দিনের পর দিন তার কোনো হদিস না পেয়ে তার পরিবার উচ্চ আদালতে রিট আবেদন করতে যায়। কিন্তু সে সময় ফ্যাসিস্ট হাসিনার ভয়ে উচ্চ আদালতের কোনো আইনজীবী তার পক্ষে রিট করতে রাজি হননি। আমার দেশকে কূটনীতিক মারুফ জামান বিষয়টি নিশ্চিত করে বলেন, আমার মেয়ে তখন দেশবরেণ্য অনেক আইনজীবীর সঙ্গে যোগাযোগ করলেও তারা কেউই ভয়ে হাসিনা সরকারের বিরুদ্ধে আদালতে রিট করতে রাজি হননি।

 

২০১৬ সালের ২৫ জুলাই খুলনার গোয়ালপাড়া পাওয়ার হাউস এলাকায় নিজ পাড়ার সামনে থেকে বিশ্ববিদ্যালয় পড়ুয়া তরতাজা যুবক মোস্তাফিজুর রহমান সিফাতকে ছদ্মবেশী র‌্যাব সদস্য দিবালোকে উঠিয়ে নিয়ে যায়। ১৭ দিন গুম রাখার পর কথিত জঙ্গি সাজিয়ে সিফাতকে ৪৩ দিন রিমান্ডে নিয়ে চালানো হয় অমানসিক নির্যাতন। পূর্বতন কোনো ধরনের অভিযোগ না থাকার পরও নিম্ন আদালত দিনের পর দিন সিফাতের রিমান্ড নামঞ্জুর করে। একপর্যায়ে রিমান্ডে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর নির্যাতন সহ্য করতে না পেরে ২০১৬ সালের ২৪ ডিসেম্বর সিফাত কেরানীগঞ্জের কারাগারে কোনো চিকিৎসা ছাড়াই মারা যান।

 

সিফাতকে আটকের পর র‌্যাব সদস্য বিভিন্ন সময় তার পরিবারকে হুমকি দিয়ে ১৫ লাখ টাকাও আদায় করে। সিফাতের নির্মম এ হত্যার তদন্ত ও বিচারের দাবিতে তার পরিবার গত মাসে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে অভিযোগ দায়ের করে। এরকম বহু অভিযোগ প্রতিদিনই ট্র্যাইব্যুনাল ও বিভিন্ন সংস্থাগুলোয় এখনো আসছে।

 

মানবাধিকারকর্মীরা জানান, আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পর থেকেই রাজনৈতিক প্রতিপক্ষকে ভয়ভীতি ও দমনের হাতিয়ার হিসেবে ক্রসফায়ার বা বন্দুকযুদ্ধের নাটক মঞ্চায়ন করতে শুরু করে। প্রথম দিকে লিস্টে কিছু কথিত সন্ত্রাসীর নাম থাকলেও সময়ের সঙ্গে সঙ্গে বিরোধী রাজনৈতিক নেতাকর্মী, ব্যবসায়ী, নামাজি যুবক, সোশ্যাল মিডিয়া অ্যাক্টিভিস্ট ও হক্কানী আলেমদের ধরে ধরে গুম এবং ক্রসফায়ারে হত্যা করা হয়।

 

১৬ বছরে ৩ সহস্রাধিক বিচারবহির্ভূত হত্যা

আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন সরকারের ২০০৯ থেকে ২০২৩ সাল পর্যন্ত সময়ে সারা দেশে বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের শিকার হয়েছেন ২ হাজার ৬৯৯ জন। এ সময়ে গুমের শিকার হন ৬৭৭ জন, কারাগারে মৃত্যুবরণ করেন ১ হাজার ৪৮ জন। মানবাধিকার সংগঠন অধিকারের পরিসংখ্যানে এ তথ্য উঠে এসেছে। তবে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে জুলাই-আগস্টে নিহতদের তালিকাসহ ২০২৪ সালের ঘটনা যুক্ত করলে নিহতের সংখ্যা তিন হাজার ছাড়িয়ে যাবে বলে ধারণা করা হয়।

অধিকারের পরিসংখ্যান বলছে, আওয়ামী লীগ সরকার দায়িত্ব নেওয়ার বছরই ২০০৯ সালে ১৫৪ জনকে বিচারবহির্ভূতভাবে হত্যা করা হয়। আর ২০১৮ সালে বিতর্কিত দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের বছরে বিচারবহির্ভূতভাবে হত্যা করা হয় ৪৬৬ জনকে। এসব হত্যা বন্ধে কোনো উদ্যোগ নেয়নি আদালত।

 

কী বলছেন আইনজ্ঞরা

এ বিষয়ে বিচার বিভাগ সংস্কার কমিশনের সদস্য এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক কাজী মাহফুজুল হক সুপন বলেন, বিচার বিভাগকে রাজনীতিকরণ শেখ হাসিনার ঘৃণ্য কাজগুলোর মধ্যে একটি। এর মাধ্যমে শেখ পরিবার সারা দেশের সবকিছুর নিয়ন্ত্রক হয়ে উঠেছিল। ফলে বিচারপ্রার্থী সাধারণ মানুষ ন্যায়বিচার থেকে বঞ্চিত ছিল। বিচার বিভাগকে নিয়ন্ত্রণের পাশাপাশি শেখ হাসিনা প্রশাসন এবং পুলিশ বিভাগকেও দলীয় বাহিনীতে পরিণত করেছিল। তাই আমরা বিচার বিভাগ সংস্কার কমিশনের রিপোর্টে সম্পূর্ণ আলাদা একটি রাজনৈতিক হস্তক্ষেপমুক্ত তদন্ত কমিশনের সুপারিশ করেছি, যাতে সাধারণ মানুষ হয়রানিমুক্ত ন্যায়বিচার পায়।

 

এ ব্যাপারে সুপ্রিম কোর্টের সিনিয়র আইনজীবী ও সংবিধান সংরক্ষণ কমিটির অন্যতম সদস্য সৈয়দ মামুন মাহবুব বলেন, শেখ হাসিনার বিগত ১৬ বছরে বিচার বিভাগের প্রতি মানুষের আস্থাহীনতা চরমে পৌঁছেছিল। এ সময় আদালত, পুলিশ এবং প্রশাসনকে কাজে লাগিয়ে গোটা দেশে ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করা হয়েছিল। তবে এটি ঠিক যে, বিগত সময়ে কোনো কোনো বিচারক ব্যক্তিগত স্বার্থের জন্য স্বাধীন বিচার বিভাগ চাননি এবং এগুলোর সহযোগী হয়েছিলেন। এজন্য অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতিদের বিভিন্ন পদে নিয়োগ বন্ধ করতে হবে। প্রয়োজনে তাদের অবসরকালীন সুযোগ-সবিধা বাড়িয়ে দেওয়া যেতে পারে। আর বিচারপতিদের স্মরণ রাখা উচিত-এটি কোনো চাকরি নয়, এটি সাংবিধানিক পদ। তাদের এ অনুভূতি না আসা পর্যন্ত স্বাধীন বিচার বিভাগ কল্পনা করা কঠিন।

 

সার্বিক বিষয়ে সুপ্রিম কোর্টের মুখপাত্র ও স্পেশাল অফিসার মো. মোয়াজ্জেম হোছাইন বলেন, বর্তমান প্রধান বিচারপতি ড. সৈয়দ রেফাত আহমেদ দেশের এই ক্রান্তিলগ্নে একটি স্বচ্ছ, স্বাধীন ও জবাবদিহিমূলক বিচার বিভাগ গড়ার প্রত্যয়ে গত ২১ সেপ্টেম্বর সুপ্রিম কোর্টে দেশের বিচারকদের উপস্থিতিতে রোডম্যাপ ঘোষণা করেন। বিশেষ করে গত ২৭ অক্টোবর সুপ্রিম কোর্ট থেকে পৃথক বিচার বিভাগীয় সচিবালয় গঠনসংক্রান্ত প্রস্তাব আইন, বিচার ও সংসদবিষয়ক মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হয়েছে। ওই প্রস্তাবে সংবিধানের ১০৯ অনুচ্ছেদের উদ্দেশ্য পূরণকল্পে হাইকোর্ট বিভাগ, অধস্তন আদালত ও ট্রাইব্যুনালের তত্ত্বাবধান এবং নিয়ন্ত্রণ যথাযথ রূপে পালনের উদ্দেশ্যে একটি স্বতন্ত্র সচিবালয় প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে একটি অধ্যাদেশের খসড়া, প্রস্তাবিত সচিবালয়ের অর্গানোগ্রাম এবং সম্ভাব্য সংস্কার সম্পর্কে প্রস্তাব পাঠানো হয়েছে। যার মাধ্যমে দেশের বিচার বিভাগের প্রতি গণমানুষের আস্থা অর্জনে রাজনৈতিক প্রভাবমুক্ত স্বাধীন বিচার বিভাগ প্রতিষ্ঠায় দেশ এগিয়ে যাবে।