
একটি প্রকল্পে এক বছরের জন্য স্ট্যাম্প ও সিল কিনতে ৮ লাখ ১০ হাজার টাকা আবদার করেছে পরিবার পরিকল্পনা অধিদপ্তর। এ প্রস্তাব অযৌক্তিক জানিয়ে মাত্র ১০ হাজার টাকা ব্যয়ের অনুমতি দিয়েছে পরিকল্পনা কমিশন। এছাড়া আরও অনেক ব্যয় পুরোপুরি কাটছাঁট করা হয়েছে। কমানো হয়েছে প্রকল্পের অধিকাংশ ব্যয়।
‘ইউনিয়ন স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ পুনঃনির্মাণ’ শীর্ষক প্রকল্পে এ ব্যয়প্রস্তাব করা হয়। পরিবার পরিকল্পনা অধিদপ্তর প্রস্তাবিত এ প্রকল্প নিয়ে প্রকল্প মূল্যায়ন কমিটির (পিইসি) সভা করে পরিকল্পনা কমিশন। সভায় ব্যয় কাটছাঁটের সিদ্ধান্ত হয়।
ডিসেম্বর ২০২৩ থেকে চলমান প্রকল্পটি নভেম্বর ২০২৬ নাগাদ শেষ হবে। ফলে প্রকল্পের মেয়াদ আছে মাত্র এক বছর। এই সময়ে প্রকল্পের পরিচালক, উপ-প্রকল্প পরিচালক ও অ্যাকাউন্ট্যান্ট শুধু সিল-স্ট্যাম্প ব্যবহার করবেন। যার জন্য মাত্র পাঁচ হাজার টাকাই যথেষ্ট। ফলে এ খাতে ৮ লাখ ১০ হাজার টাকা ব্যয় অযৌক্তিক মনে করে কেটেছে কমিশন।
স্বাস্থ্য শিক্ষা ও পরিবার কল্যাণ বিভাগের আওতায় পরিবার পরিকল্পনা অধিদপ্তর মোট দুই হাজার ২৩০ কোটি ৪০ লাখ টাকা ব্যয়ে ডিসেম্বর ২০২৩ থেকে নভেম্বর ২০২৬ মেয়াদে বাস্তবায়নের জন্য প্রকল্প প্রস্তাবটি করা হয়েছে। প্রকল্পটি ২০২৪-২৫ অর্থবছরের বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচিতে (এডিপি) দুই হাজার ১৮১ কোটি টাকা বরাদ্দসহ অন্তর্ভুক্ত রয়েছে।
এ প্রসঙ্গে পরিকল্পনা কমিশনের আর্থ-সামাজিক অবকাঠামো বিভাগের প্রধান (অতিরিক্ত সচিব) মো. আব্দুর রউফ জাগো নিউজকে বলেন, ‘চলমান প্রকল্পে স্ট্যাম্প-সিল কিনতে ৮ লাখ ১০ হাজার টাকা চাওয়া হয়েছিল। এটা আমরা কেটে মাত্র ১০ হাজার টাকা রেখেছি। সিল-স্ট্যাম্পে এত টাকা লাগার কথা নয়। আমার মনে হয় পাঁচ হাজার টাকাই যথেষ্ট। কারণ প্রকল্পের পরিচালক, উপ-প্রকল্প পরিচালক ও অ্যাকাউন্ট্যান্ট সিল-স্ট্যাম্প ব্যবহার করেন।’
তিনি বলেন, ‘প্রকল্পের কাজে এত টাকার প্রয়োজন নেই। তবে প্রকল্প সংশ্লিষ্টরা যদি সিল-স্ট্যাম্পের দোকান দেন তবে ৮ লাখ ১০ হাজার টাকা লাগতে পারে। প্রকল্পের প্রয়োজনে পাঁচ হাজার টাকাই যথেষ্ট মনে করি। তবুও এ খাতে ১০ হাজার টাকা রেখেছি। প্রকল্পের আরও কয়েকটি খাতের ব্যয় নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে, সেই ব্যয়গুলোও কমানোর সুপারিশ করা হয়েছে।’
আরও যত ব্যয় কাটছাঁট
পরিকল্পনা কমিশন জানায়, এছাড়া আপ্যায়ন খরচ বাবদ ১৮ লাখ টাকার প্রস্তাব করা হয়েছিল। তবে এ খাতে মাত্র ১০ লাখ টাকা রাখা হয়েছে। বইপত্র ও সাময়িকী বাবদ ৪ লাখ ৮০ হাজার টাকার আবদার করা হলেও বাদ পড়েছে পুরোটাই। ভ্রমণব্যয় ৭৫ লাখ টাকার প্রস্তাব করা হলেও ২০ লাখ টাকা রেখেছে কমিশন।
এছাড়া অন্য মনিহারি বাবদ ১০ লাখ টাকার আবদার করা হলে ৬ লাখ টাকা, নিয়োগ পরীক্ষা ফি বাবদ ১২ লাখ টাকা কেটে মাত্র ২ লাখ ও নিবন্ধন ফি বাবদ ১১ লাখ টাকার আবদার করা হলেও পরিকল্পনা কমিশন সব টাকাই বাদ দিয়েছে। প্রচার ও বিজ্ঞাপন খাতে সাড়ে ২৮ লাখ টাকার আবদার করা হলেও মাত্র ২০ লাখ টাকা রাখতে চেয়েছে কমিশন।
আসবাবপত্র মেরামত ও সংরক্ষণ খাতে ৮ লাখ টাকা চাওয়া হলেও ৫০ হাজার ব্যয়ের পক্ষে কমিশন। একইভাবে কম্পিউটার মেরামত বাবদ ৮ লাখ টাকার পরিবর্তে ৫০ হাজার, অফিস মেরামত খাতে ৮ লাখ টাকার পরিবর্তে ৫০ হাজার এবং যন্ত্রপাতি মেরামত ও সংরক্ষণে ৮ লাখ টাকার প্রস্তাব করা হলেও এ খাতকে বাদ দিতে বলেছে কমিশন। দুটি মোটরযানে দেড় কোটি টাকা ব্যয়প্রস্তাব করা হলে অর্থ বিভাগের মতামত নিয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়ার সুপারিশ করা হয়েছে।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে পরিবার পরিকল্পনা অধিদপ্তরের পরিচালক (অর্থ) সিএইচ-সার্ভিসেস মো. এনামুল হক জাগো নিউজকে বলেন, ‘আমি অর্থের বিষয়টি দেখি ঠিক আছে, কিন্তু এটা আমি ভালো বলতে পারবো না।’
প্রকল্পের কাজে এত টাকার প্রয়োজন নেই। তবে প্রকল্প সংশ্লিষ্টরা যদি সিল-স্ট্যাম্পের দোকান দেন তবে ৮ লাখ ১০ হাজার টাকা লাগতে পারে। প্রকল্পের প্রয়োজনে পাঁচ হাজার টাকাই যথেষ্ট মনে করি। তবুও এ খাতে ১০ হাজার টাকা রেখেছি। প্রকল্পের আরও কয়েকটি খাতের ব্যয় নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে, সেই ব্যয়গুলোও কমানোর সুপারিশ করা হয়েছে।-পরিকল্পনা কমিশনের আর্থ-সামাজিক অবকাঠামো বিভাগের প্রধান (অতিরিক্ত সচিব) মো. আব্দুর রউফ
এক বছরে একটি প্রকল্পে কীভাবে ৮ লাখ ১০ হাজার টাকার সিল-স্ট্যাম্প কেনা হবে? এ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘আমি বিষয়টি ভালো বলতে পারবো না।’
বিষয়টি নিয়ে কোনো মন্তব্য করতে রাজি হননি পরিবার পরিকল্পনা অধিদপ্তরের পরিচালক (এমসিএইচ-সার্ভিসেস) ডা. মো. সুলতান আহম্মদ।
পরিকল্পনা কমিশনের আরও যত পর্যবেক্ষণ
আসবাবপত্র, চিকিৎসা ও অন্য যন্ত্রপাতির তালিকা পুনরায় পর্যলোচনা করা প্রয়োজন। একই সঙ্গে বাজারদর কমিটির মাধ্যমে যাচাই করে প্রতিটি আইটেমের দর পুনঃনির্ধারণ করে তার প্রতিবেদন প্রকল্পে সংযুক্ত করতে হবে। চিকিৎসা যন্ত্রপাতির তালিকায় স্ট্রেচার নেই, তাই প্রতিটি কেন্দ্রের জন্য প্রয়োজনীয় সংখ্যক স্ট্রেচার ও ওয়েটিং রুমে আরামদায়ক বসার আসন অন্তর্ভুক্ত করা প্রয়োজন। জরুরি স্বাস্থ্যসেবার জন্য রেফারেল সিস্টেম কার্যকরভাবে চালু করার কৌশল ও কর্মপরিকল্পনা প্রণয়ন করে তা পুনঃপঠিত ডিপিপিতে সংযুক্ত করার জন্য সুপারিশ করেছে কমিশন।
প্রকল্পের উদ্দেশ্য
স্বাস্থ্য শিক্ষা ও পরিবার কল্যাণ বিভাগ জানায়, প্রকল্পের উদ্দেশ্য হলো দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলের জনগোষ্ঠী বিশেষ করে দরিদ্র ও হতদরিদ্রদের জন্য পরিবার পরিকল্পনা, মা ও শিশু স্বাস্থ্য এবং কিশোর-কিশোরীদের স্বাস্থ্যসেবা দেওয়া। প্রজননস্বাস্থ্যের গুণগত সেবা নিশ্চিত করা, প্রথম পর্যায় দেশের ৬৪টি জেলার ৩২৯টি উপজেলার ৫৯২টি ইউনিয়ন স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ কেন্দ্র পুনঃনির্মাণের মাধ্যমে প্রাতিষ্ঠানিক স্বাস্থ্যসেবা দেওয়ার সক্ষমতা তৈরি, সেবাকেন্দ্রে সেবাদাতাদের সার্বক্ষণিক উপস্থিতি নিশ্চিত করা, প্রাতিষ্ঠানিক প্রসবসেবা বাড়ানো এবং দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলে (ইউনিয়ন পর্যায়ে) সার্বক্ষণিক সেবা নিশ্চিত করা।
পরিকল্পনা মন্ত্রণালয় আরও জানায়, প্রকল্পটির মাধ্যমে প্রত্যন্ত অঞ্চলে আধুনিক স্থাপনা নির্মাণ এবং চিকিৎসা যন্ত্রপাতি ও অন্য অসবাবপত্র সরবরাহের যে প্রস্তাব করা হয়েছে, তা অত্যন্ত প্রয়োজনীয়। স্বাস্থ্যসেবার জন্যও জরুরি। কিন্তু প্রকল্পে কোনো এক্সিট প্ল্যান উল্লেখ করা হয়নি। প্রকল্পের মাধ্যমে অস্থায়ী ভিত্তিতে জনবল নিয়োগ না করে স্থায়ী জনবল নিয়োগের মাধ্যমে স্বাস্থ্যকেন্দ্রগুলোতে যাতে প্রকল্প সমাপ্ত হওয়ার পর সার্বক্ষণিক নিরবচ্ছিন্ন স্বাস্থ্যসেবা অব্যাহত রাখা যায়, তা নিশ্চিত করার জন্য একটি এক্সিট প্ল্যান প্রকল্পে সংযুক্ত করা প্রয়োজন।
এ প্রসঙ্গে পরিবার পরিকল্পনা অধিদপ্তর জানায়, মূলত পরিবার পরিকল্পনা অধিদপ্তরের নিজস্ব জনবল দিয়েই এ প্রকল্পের কার্যক্রম পরিচালিত হবে। তবে বর্তমানে অনেক পদ শূন্য থাকায় অস্থায়ীভাবে কিছু জনবল নিয়োগের প্রস্তাব করা হয়েছে।