Image description
 

জন্ম পাঞ্জাবের লাহোরে। ইমরান তাহিরের বেড়েও ওঠা পাকিস্তানে। দেশটির অনূর্ধ্ব-১৯ দলের হয়ে খেলেছেন বিশ্বকাপেও। পাকিস্তানের এ বয়সভিত্তিক দলের হয়ে খেলতে গিয়েছিলেন দক্ষিণ আফ্রিকায়। সে সফরেই সৌম্মা দিলদার নামে ভারতীয় এক কন্যার সঙ্গে তার পরিচয়। শেষে সেই পরিচয়টা রূপ নেয় পরিণয়ে। বিয়ে করে দক্ষিণ আফ্রিকায় থিতু হয়ে যান। বিয়েসূত্রে পেয়ে যান দক্ষিণ আফ্রিকার নাগরিকত্ব। কাউন্টি ক্রিকেটে নিজেকে প্রতিষ্ঠা করার চেষ্টাও করেছিলেন; কিন্তু সফল হননি। জায়গা হয়নি তার পাকিস্তানের সিনিয়র দলেও। কিন্তু তার খুব প্রয়োজনের সময়ে দক্ষিণ আফ্রিকা একজন ভালো লেগস্পিনারের খোঁজে নেমেছিল। প্রোটিয়াদের প্রয়োজনের সঙ্গে ইমরান তাহিরের বেঁচে থাকার অবলম্বনের দরকারটা ঠিক এক বিন্দুতে মিলে যায় তখন। ২০১১ সালে সুযোগ পেয়ে যান দক্ষিণ আফ্রিকার জাতীয় দলে। আর পেছনে তাকাতে হয়নি। আফ্রিকার দেশটির জার্সি গায়ে জড়িয়ে তিনি বনে যান সময়ের অন্যতম সেরা স্পিনার।

দক্ষিণ আফ্রিকার সাবেক এ স্পিনজাদুকর ভড়কে দিয়েছেন বিশ্বের নামজাদা সব ব্যাটারকে। শুধু জাতীয় দলের হয়েই প্রতিপক্ষের ব্যাটারদের ওপর স্পিন-বিষ ছড়াননি, স্পিন নৈপুণ্যে মুগ্ধ করেছেন আইপিএলসহ বিশ্বের প্রায় সব ফ্র্যাঞ্চাইজি লিগের দর্শকদের। ক্রিকেট খেলার সঙ্গে একটি কাজে বেশ ব্যস্ত থাকতেন এক সময়। আর তা হলো নিজের চুলের রঙ বদলানো। প্রোটিয়াদের প্রতিটি সিরিজেই দর্শক উপভোগ করতেন তার নতুন রঙের চুলের নতুন স্টাইল। প্রিয় সতীর্থ হাশিম আমলা তাকে এ ব্যস্ততাকে থেকে সরিয়ে ফেলেন। ব্যস্ত করে দেন দ্বীনের দাওয়াতে। ক্রিকেট দুনিয়ার অন্যতম সেরা এ বোলার জীবনের সার্থক এক আলোকিত পথের সন্ধান পেয়ে যান তাতে।

আমলার অনুপ্রেরণায় ইমরান তাহির নিজেকে সমর্পণ করেন ইসলামের ছায়াতলে। ইসলামের পতাকাতলে হাজির হতেই বদলে যায় তার ক্রিকেট ক্যারিয়ার। এ নিয়ে ইমরান তাহির বলেন, ‘আমি অনেক বছর যাবৎ ক্রিকেট খেলছি। কিন্তু আমার ক্যারিয়ার সমৃদ্ধ হয়েছে পুরোপুরি ইসলাম ধর্মে মনোনিবেশ করার কারণেই।’
প্র্যাকটিসিং মুসলিম হিসেবে ইমরান তাহির নামাজ আদায় করেন নিয়মিত। তিলাওয়াত করেন পবিত্র কোরআনও। খেলার আগে আকাশ পানে তাকিয়ে দুই হাত তুলে দোয়া করছেন ইমরান তাহির, এই দৃশ্য নতুনকিছু নয়। ইসলামের অনুশাসনে নিজের জীবনকে পরিচালিত করে ইমরান তাহির সাফল্যের মুখও দেখেছেন।


ইংল্যান্ড সফরে এক ম্যাচে ওপেনার জেসন রয় ও জনি বেয়ারস্টোর বিপক্ষে বোলিংয়ের প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন ইমরান তাহির। স্ট্রাইকিং প্রান্তে ছিলেন জেসন রয়। ঠিক তখন এক মুহূর্তের জন্য হাত থেকে বল মাঠের ঘাসের ওপর রেখে দোয়া পড়ে নেন তারকা এ বোলার। যার সুফল ইমরান তাহির পেয়ে যান ওভারের দ্বিতীয় বলেই। প্রথম বলেই এক রান নেন জেসন রয়। স্ট্রাইকিং প্রান্তে এবার চলে আসেন অন্য ওপেনার জনি বেয়ারস্টো। ইমরান তাহিরের প্রথম বল খেলতে গিয়েই পরাস্ত হন । ইমরান তাহিরের ঘূর্ণি বল বেয়ারস্টোর ব্যাট ছুঁয়ে ধরা পড়ে উইকেটের পেছনে থাকা কুইন্টন ডি ককের গ্লাভসে। দ্বিতীয় বলেই উইকেট ফেলে দেন ইমরান তাহির।


শুধু মাঠের ক্রিকেটার হিসেবেই নন, ধার্মিক হিসেবেও সুখ্যাতি রয়েছে ইমরান তাহিরের। ধর্মীয় বিশ্বাস থেকে এক চুলও ছাড় দিতে নারাজ। ইসলাম ধর্মে মদপান নিষিদ্ধ হওয়ায় জাতীয় দল কিংবা ঘরোয়া বা ফ্র্যাঞ্চাইজি-ভিত্তিক টুর্নামেন্টের জার্সিতে ব্যবহার করেন না কোনো অ্যালকোহল কোম্পানির লোগো। এমন সিদ্ধান্ত নেন তার খুব কাছের সতীর্থ ও বন্ধু হাশিম আমলাও। তাদের দুজনের এমন সিদ্ধান্তে আক্ষেপ করা ছাড়া আর কিছুই করার ছিল না স্পন্সর বিয়ার প্রস্তুতকারক কোম্পানি ক্যাসল ল্যাগারের।


পবিত্র রমজান শুরু হলেই প্রশ্ন উঠে যায়- ইমরান তাহির কীভাবে খেলবেন বা অনুশীলন করবেন? কীভাবে সমন্বয় করবেন পেশাদারি দায়িত্ব আর ধর্মীয় বিশ্বাসের মধ্যে? অন্যদের কাছে জটিল মনে হলেও ব্যাপারটা খুব একটা কঠিন মনে করেন না তাহির। এক সাক্ষাৎকারে তিনি বলেন, ‘আমি মনে করি না পেশাদার খেলাধুলার সঙ্গে আপনার বিশ্বাসের অনুশীলনের ভারসাম্য বজায় রাখা কঠিন। যদি আপনি সঠিক পথ অনুসরণ করেন, তবে এটি খুব সহজ। আমি আল্লাহর কাছে কৃতজ্ঞ যে, তিনি আমাকে তার আরো কাছে নিয়ে এসেছেন। ক্রিকেট খেলতে খেলতে আমি বিশ্বের বিভিন্ন সংস্কৃতির মধ্য দিয়ে এসেছি এবং আমার পথ অনুসরণ করতে কোনো অসুবিধা হয়নি; বরং তারা (খেলোয়াড়, কোচ ও সাপোর্ট স্টাফ) আরো বেশি সম্মান দেন। কেউ কেউ আমাকে নামাজ পড়ার জন্য তাদের ঘরও ছেড়ে দিয়েছেন।’

 


রমজান নিয়ে ইমরান তাহির বলেন, ‘রমজানে সবগুলো রোজা রাখি, পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ পড়ি। আল্লাহকে রাজি-খুশি রাখার চেষ্টা করি। একইসঙ্গে ভালো ক্রিকেট খেলারও চেষ্টা করি। রোজা আমাকে ক্লান্ত করতে পারে না। সুন্দর মন নিয়ে রোজা রাখলে তা মানুষকে ক্লান্ত করতে পারে না।’
নামাজ আর রোজা মিস না করতে সব রকম চেষ্টাই করেন। কোনো কারণে মিস হলে তা পরে পুষিয়ে নেন। এ নিয়ে তার ভাষ্য, ‘আমি চেষ্টা করি আমার নামাজ ও রমজানের ৩০টি রোজা মিস না করার জন্য; কিন্তু ক্রিকেটের কারণে যদি আমি সেগুলো মিস করি, পরে আমি সেগুলোর ক্ষতিপূরণ দিই।’


শান্তির ধর্মে বিশ্বাস স্থাপন করেছেন ইমরান তাহির হৃদয় নিংড়ানো প্রচণ্ড ভালোবাসা নিয়েই। ক্রিকেটও খেলেন সেই মনের টানেই। স্ত্রী সৌম্মা দিলদার বলেন, ‘তাহির ঠিক যেন এক খোলা পাতা। মাঠে তার সেলিব্রেশন দেখেই সেটা সবাই বুঝতে পারেন। যা করেন, ভালোবেসে করেন। ভালোবাসার জন্য সব করতে পারেন তাহির। ভালোবাসার খাতিরে যিনি দেশ ছাড়তে পারেন, তার কাছে ভালোবাসার মানেটা কী, তা আলাদা করে বলে দিতে হয় না।’