
দেশের অন্যতম পর্যটন নগরী কক্সবাজার, যেখানে সমুদ্রের ঢেউ আর বালুকাবেলার সৌন্দর্যের আড়ালে ছড়িয়ে পড়ছে এক গভীর অন্ধকার—মাদকের ভয়াবহ থাবা। তবে আশ্চর্যজনক বিষয় হচ্ছে, মাদক দমনের দায়িত্বপ্রাপ্ত সংস্থারই কিছু কর্মকর্তা এ অন্ধকার জগতের অংশ হয়ে উঠেছেন।
সম্প্রতি কক্সবাজার মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের সহকারী পরিচালক (এডি) এ.কে.এম দিদারুল আলমের বিরুদ্ধে অভিযোগ উঠেছে, তিনি সময়ের কণ্ঠস্বরের কক্সবাজারের স্টাফ করেসপন্ডেন্ট সাংবাদিক শাহীন মাহমুদ রাসেলকে ষড়যন্ত্রমূলকভাবে মিথ্যা মাদক মামলায় ফাঁসানোর অপচেষ্টা করেছেন। এ ঘটনায় সময়ের কণ্ঠস্বরসহ দেশের শীর্ষস্থানীয় জাতীয় ও স্থানীয় গণমাধ্যমগুলোতে প্রতিবেদন প্রকাশিত হলে বিষয়টি নিয়ে ব্যাপক চাঞ্চল্যের সৃষ্টি হয়।
এ ঘটনাকে কেন্দ্র করে মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের চট্টগ্রাম বিভাগের অতিরিক্ত পরিচালক মো. জাহিদ হোসেন মোল্লার নেতৃত্বে চার সদস্যের একটি তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়। সেই কমিটিতে রয়েছেন স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক হুমায়ুন কবির খন্দকারসহ আরও তিনজন কর্মকর্তা। মঙ্গলবার (১১ মার্চ) দুপুর থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত কক্সবাজারে তদন্ত কার্যক্রম চালানো হয়।
তদন্ত দল অভিযুক্ত এডি দিদারুল, তার টিমের অন্যান্য সদস্য, ভুক্তভোগী সাংবাদিক শাহীন মাহমুদ রাসেল, সিএনজি চালক বজল করিমের স্ত্রী রাশেদা বেগম এবং সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের সাক্ষ্য গ্রহণ করে ও লিখিত জবানবন্দি নেয়। একই সঙ্গে ঘটনার সাথে সংশ্লিষ্ট ভিডিও ও অন্যান্য প্রমাণাদি সংগ্রহ করা হয়।
এ বিষয়ে জানতে তদন্ত কমিটির সদস্য মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের চট্টগ্রাম বিভাগীয় অতিরিক্ত পরিচালক মো: জাহিদ হোসেন মোল্লাকে বুধবার সকালে একাধিকবার কল করা হলেও তিনি ফোন রিসিভ করেননি।
তবে মঙ্গলবার রাতে তিনি গণমাধ্যমকে বলেন, মহাপরিচালকের (ডিজি) নির্দেশনায় আমরা চারজনের টিম সকালে কক্সবাজার পৌঁছাই। দুপুর হতে অভিযুক্ত এডি, টিমের অন্য সদস্য, ভিকটিম সাংবাদিক শাহীন মাহমুদ রাসেলসহ অন্যদের জবানবন্দি নেয়া হয়। তদন্তে গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিদের বক্তব্য লিখিত নেয়া হয়েছে। সংগ্রহ করা হয়েছে তদন্ত সংশ্লিষ্ট ভিডিও এবং অন্যান্য প্রমাণাদি। সবকিছু এক জায়গায় করে গোছানো একটি প্রতিবেদন উর্ধ্বতন মহলের কাছে সন্ধ্যার পরই পাঠানো হয়েছে।
উল্লেখ্য, ঘটনার সূত্রপাত হয় ৯ মার্চ কক্সবাজার সদরের ঝিলংজার বাংলাবাজার এলাকায়। রবিবার সকালে লিংকরোড থেকে সিএনজি চালক বজল করিমকে ধরে নিয়ে যায় মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের একটি টিম। আটক চালকের স্ত্রী রাশেদা বেগম তার স্বামীর মুক্তির জন্য সাংবাদিক শাহীন মাহমুদ রাসেলের কাছে মানবিক সাহায্য চান। এরপর সাংবাদিক শাহীন মাহমুদ রাসেল তার ফেসবুকে একটি ভিডিও পোস্ট করেন।
ভিডিও সূত্রে জানা যায়, রাশেদা বেগম অভিযোগ করেন, মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের কর্মকর্তা দিদারুল আলম তার স্বামীকে (সিএনজি চালক বজল করিম) মাদক মামলায় ফাঁসিয়ে দিয়েছেন। ফেসবুক পোস্টের ক্যাপশনে রাসেল লেখেন—"অপকর্মে মশগুল মাদকদ্রব্যের এডি দিদারুল। মাদক দিয়ে ফাঁসিয়ে দেওয়া সিএনজি চালক বজল করিমের স্ত্রী রাশেদার আহাজারি!"
এই ভিডিও ছড়িয়ে পড়তেই এডি দিদারুল আলম প্রতিশোধপরায়ণ হয়ে ওঠেন। মাত্র দুই ঘণ্টার ব্যবধানে সেদিন রাত সাড়ে ৯টায় এক যুবককে পেটে ইয়াবা বহনের দায়ে রেল স্টেশন থেকে আটক করে কক্সবাজার মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের কার্যালয়ে নিয়ে আসা হয়।
এরপর সেই আসামির মাধ্যমে সাংবাদিক রাসেলের বিরুদ্ধে মিথ্যা স্বীকারোক্তি আদায় করা হয় এবং সেটি একটি ভূঁইফোড় নিউজ পোর্টালের ফেসবুক পেইজে লাইভ সম্প্রচার করা হয়! তবে সেই লাইভ ভিডিওতে এডি দিদারুলের কোনো বক্তব্য ছিল না।
কক্সবাজারের মূলধারার সাংবাদিকদের দাবি, এটি ছিল পরিকল্পিত প্রতিশোধ।
সেদিনের ঘটনার পর কক্সবাজার জেলার মূলধারার সাংবাদিকরা সরেজমিনে যখন মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরে ছুটে যান, তখন এডি দিদারুল এবং লাইভে বক্তব্য দেওয়া সেই ছেলে কোনো সদুত্তর দিতে পারেননি।
সাংবাদিক শাহীন মাহমুদ রাসেল জানান, 'আমি সত্যের পক্ষে দাঁড়িয়েছিলাম বলেই আমাকে টার্গেট করে মিথ্যা মাদক মামলা দেওয়ার অপচেষ্টা করেছে। এডি দিদারুলের বিরুদ্ধে তদন্ত হলেও আমি শঙ্কিত, কারণ তিনি ইতোমধ্যে ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের মোটা অংকের টাকা দিয়ে ম্যানেজ করার চেষ্টা করছেন বলে গোপন সূত্রে জানতে পেরেছি। আমি চাই, সুষ্ঠু তদন্ত হোক এবং প্রকৃত সত্য যেন বেরিয়ে আসে।'
তিনি আরও বলেন, 'আমার বিরুদ্ধে যে ষড়যন্ত্র করা হয়েছে, তাতে আমার পরিবার এবং আমি সামাজিকভাবে সম্মানহানির মুখে পড়েছি। যদি নিরপেক্ষ তদন্ত না হয়, তাহলে আমি আদালতের শরণাপন্ন হবো। এডি দিদারুলের অন্যায়ের বিচারের জন্য আমাকে যেখানে যেতে হয়, সেখানেই যাবো।'
সেদিনের ঘটনায় উপস্থিত লোকজন বলেন, কক্সবাজার জেলা মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের উপ-পরিদর্শক তুন্তু মনি চাকমা সিএনজি চালক বজল করিমকে আটক করেছিলেন। শত শত মানুষের সামনে তার শরীর এবং তার সিএনজি গাড়িতে তল্লাশি চালিয়েও কোনো ইয়াবা পাওয়া যায়নি। কিন্তু বজল করিমকে কথা আছে বলে কক্সবাজার শহরের ঝাউতলায় নিয়ে আসা হয়।
ঘটনায় উপস্থিত লিংকরোড সিএনজি সমিতির সভাপতি আনোয়ার বলেন, "সকাল আনুমানিক সাড়ে নয়টার সময় মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের লোকজন এসে বজল করিমের গাড়ি চারদিক থেকে ঘিরে ফেলে। তারা বলেছিল, ‘তোমার গাড়িতে মাল আছে।’ কিন্তু আধাঘণ্টা গাড়ি তন্নতন্ন করে চেক করেও কিছু পায়নি। পরে তাকে ঝাউতলায় নিয়ে গিয়ে একটি গাড়ির গ্যারেজে বসিয়ে রাখা হয়। ৩/৪ ঘণ্টা পর এডি দিদার আসার পর উপস্থিত আরেক অফিসারের ব্যাগ থেকে একটা প্যাকেট বের করে তার (বজল করিমের) হাতে দিয়ে ছবি তোলা হয়। এটা আমাদের ড্রাইভারের সাথে চরম অন্যায় করেছে। আমরা এর সুষ্ঠু বিচার চাই।"
লিংকরোড সিএনজি সমিতির সাধারণ সম্পাদক রহিম উল্লাহ বলেন, 'আমাদের জানা মতে, সিএনজি চালক বজল করিম কখনো মাদকের সঙ্গে জড়িত ছিল না। আমাদের ড্রাইভার বজল করিমের সাথে এডি দিদারুল আলম যে অন্যায় করেছেন, তার বিচার চাই। সুষ্ঠু তদন্ত করে আমাদের ড্রাইভারকে ছেড়ে দেওয়ার জন্য সরকারের কাছে অনুরোধ জানাই।'
লিংকরোড সিএনজি সমিতির সদস্য, ড্রাইভার জাহেদ বলেন, 'তুন্তু মনি চাকমা যখন আমাদের বজল ড্রাইভারকে নিয়ে যাওয়ার জন্য এসেছিলেন, তখন আমি উপস্থিত ছিলাম। আমরা শত শত মানুষের সামনে সেই গাড়ি তল্লাশি করেছিলাম, কিন্তু কোনো মাদকের ছিটেফোঁটাও পাওয়া যায়নি। পরে গাড়িসহ বজল ড্রাইভারকে নিয়ে যাওয়া হয়। পরে শুনলাম, তার গাড়িতে নাকি মাদক পাওয়া গেছে! এটা ষড়যন্ত্র ছাড়া আর কিছুই না।'
এদিকে সাংবাদিক শাহীন মাহমুদ রাসেলকে মিথ্যা মাদক মামলায় ফাঁসানোর ঘটনায় কক্সবাজারের সাংবাদিক মহল তীব্র প্রতিক্রিয়া জানিয়েছেন। সাংবাদিকরা একত্রিত হয়ে মানববন্ধন ও প্রতিবাদ সমাবেশ করেন এবং এডি দিদারুলকে ৭২ ঘণ্টার মধ্যে প্রত্যাহারের দাবি জানান।
তারা অভিযোগ করেন, দিদারুল আলম ওসি প্রদীপ কুমার দাশের কায়দায় কক্সবাজারে সাংবাদিক দমন করতে চাচ্ছেন। তার মতো বিতর্কিত কর্মকর্তা মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের দায়িত্বে থাকলে মাদকবিরোধী অভিযান কার্যকর হবে না; বরং মাদকচক্র আরও বেপরোয়া হয়ে উঠবে এবং নিরীহ মানুষ হয়রানির শিকার হবে। মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের উচিত এডি দিদারুল আলমকে স্থায়ীভাবে বরখাস্ত করা এবং যথাযথ আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণ করা।