
বানিয়াবহু গ্রামের আবদুল গনি গত আমন মৌসুমে দুই বিঘা জমিতে ধান চাষ করেছিলেন। কিন্তু সেখান থেকে এক ছটাক ধানও ঘরে তুলতে পারেননি। মানবসৃষ্ট জলাবদ্ধতার কারণে তার ক্ষেতের পুরো ধান নষ্ট হয়ে যায়। নিরুপায় হয়ে বাড়ির সামনে ছোট চায়ের দোকান চালিয়ে বর্তমানে জীবিকা নির্বাহ করছেন এই কৃষক।
শুধু আবদুল গনিই নন, আশপাশের চার গ্রামের শতাধিক কৃষকের আমন ফসল নষ্ট হয়েছে কৃত্রিম জলাবদ্ধতার কারণে। পলাতক স্বৈরাচার শেখ হাসিনার সাবেক সামরিক সচিক মেজর জেনারেল (অব.) সালাহউদ্দিন মিয়াজীর তৈরি করা বিনোদন কেন্দ্রের কারণে এই জলাবদ্ধতার সৃষ্টি হচ্ছে। মিয়াজী ২০২৪ সালের ‘ডামি’ নির্বাচনে সংসদ সদস্য (এমপি) হন ঝিনাইদহ-৩ (মহেশপুর-কোটচাঁদপুর) আসন থেকে।
ভুক্তভোগীরা জানান, জমিতে গভীর গর্ত খুঁড়ে, চাকরির প্রলোভন দেখিয়ে অথবা অন্য কোনো ছলে রূপদিয়া-রুদ্রপুর এলাকায় বিপুল সম্পত্তির মালিক হয়েছেন সালাহউদ্দিন। তার বিনোদন কেন্দ্রের জন্য নির্মাণ করা বাঁধটি এখন কৃষকের গলার কাঁটা হয়ে আছে। ফলে পানি নিষ্কাশন ব্যাহত হওয়ায় জলাবদ্ধ হয়ে ক্ষেতের ফসল নষ্ট হচ্ছে।
যশোর শহরের কেন্দ্রস্থল থেকে ৯ কিলোমিটার দক্ষিণে বিলহরিণার গা-ঘেঁষে প্রায় এক যুগ আগে গড়ে তোলা হয় ‘শ্যামলছায়া’ নামের বিনোদন কেন্দ্রটি। স্থানীয় বাসিন্দারা বলেন, এটি খুব একটা চলেনি। কিন্তু এই বিনোদন কেন্দ্র ও একটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান দেখিয়ে এবং ভবিষ্যতে বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপনের কথা বলে ওই এলাকায় শত শত বিঘা জমি হাত করেছেন মিয়াজী।
জমির মালিকরা বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই ‘অন্যায্য দামে’ জমি বিক্রি করতে বাধ্য হয়েছেন। দাপুটে কর্মকর্তার ভয়ে এতদিন তারা ছিলেন অসহায়। এখন পরিস্থিতি বদলালেও ক্ষতিগ্রস্ত কৃষকদের অনেকেই অজানা ভয়ে মুখ খুলতে চান না। তবে দুয়েকজন সাহস করে আমার দেশের সঙ্গে কথা বলেছেন।
ভুক্তভোগীরা জানান, আগামী আমন মৌসুমের আগেই তারা মিয়াজীর নির্মিত বাঁধ উচ্ছেদ করে জমি থেকে জলাবদ্ধতা নিরসনে সম্মিলিত উদ্যোগ নেবেন।
শ্যামলছায়া পার্ক স্থাপনের সময় তেঁতুলিয়া গ্রামের মো. ইকবাল হোসেন বিশ্বাস নিজের ২৫ শতকসহ ভাইবোনের ছয় বিঘা জমি দিয়েছিলেন সালাহউদ্দিনকে। ইকবাল হোসেন বলেন, ‘আমার ছেলে সাদিককে ভালো কলেজে ভর্তি করে জীবন গড়ে দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন মিয়াজী।
আত্মীয়স্বজনদের চাকরিও দেবেন বলেছিলেন। বিনিময়ে অর্ধেক দামে জমি লিখে নিয়েছেন। আমার ছেলেটাকে ভালো একটি কলেজে ভর্তি করে দিয়েছিলেন ঠিকই, কিন্তু কিছুদিন পর ওই কলেজ কর্তৃপক্ষ ছেলেকে বাড়িতে পাঠিয়ে দেয়। সে এখন রাজমিস্ত্রির সহকারী। চাষের জমি হারিয়ে আমি নিঃস্ব।’
ইকবালের ভাষ্যমতে, তিনি কয়েকবার মিয়াজীর কাছে গেছেন কিন্তু অপমান-অপদস্থ হয়ে ফিরতে হয়েছে।
রূপদিয়া-রুদ্রপুর এলাকার পার্কটি ঘুরে দেখা যায়, সেখানে বিনোদনের মোটামুটি ব্যবস্থা আছে। পার্কজুড়ে রয়েছে সবজু গাছগাছালি আর বড় পুকুর। মিনি চিড়িয়াখানায় রয়েছে কয়েকটি হরিণ। আছে পিকনিক করার ব্যবস্থা। ছোট দৃষ্টিনন্দন দোতলা একটি রেস্টহাউসও আছে, যেটি কেবল মিয়াজীর বিশেষ অতিথিরা ব্যবহার করতে পারতেন বলে জানান পার্কের কর্মী হাসিবুর রহমান।
বাম রাজনৈতিক দলের নেতা ও তেঁতুলিয়া গ্রামের বাসিন্দা শাহাবুদ্দিন বাটুল আমার দেশকে জানান, মিয়াজী যে জমি কব্জায় নিতে চাইতেন, তা যেকোনো উপায়ে নিয়ে নিতেন। শেষদিকে এসে তিনি একটি বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার নামে একের পর এক জমি নিজের আয়ত্তে নেন।’
সরেজমিন জানা যায়, মিয়াজীর কূটকৌশল ও প্রভাবে তেঁতুলিয়া গ্রামের মনসুর, শফিয়ার সরদার, মালেক, হানেফ, মুক্তার আলী, আবু বক্কার, আবদুল আজিজ বিশ্বাস, রূপদিয়ার সাত্তার, মতিয়ার, হানিফ, বাবু, জামালসহ রুদ্রপুর, মাহিদিয়ার শতাধিক কৃষক হয় জমি হারিয়েছেন অথবা ফসল উৎপাদন করতে না পেরে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন। ক্ষতিগ্রস্তদের মধ্যে মনসুরের চাকরি হয়েছিল শ্যামলছায়া পার্কে। সেখানে কর্মরত অবস্থায় বিদ্যুৎস্পৃষ্ট হয়ে তার মৃত্যু হয়।
তেঁতুলিয়া গ্রামের ইউনুস (৬০) নামে এক চাষি আমার দেশকে জানান, বিনোদন পার্ক নির্মাণের জন্য বাঁধ তৈরি করায় পানি নিষ্কাশন বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। এ কারণে দেড়গজি বিলসংলগ্ন রূপদিয়া, বানিয়াবহু, তেঁতুলিয়া এবং রুদ্রপুর গ্রামের লোকদের ২০০ বিঘার বেশি জমিতে আমন ফসল হয় না।
ক্ষতিগ্রস্ত কৃষকদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, শুধু বেড়িবাঁধ তৈরি করেই জলাবদ্ধতা সৃষ্টি করা হতো না। নিজের জমিতে এক্সকাভেটর দিয়ে গভীর গর্ত খুঁড়তেন মিয়াজী। ফলে আশপাশের জমিতে দেওয়া সেচের পানি রাখা যেত না, ফসলও ফলত না। বাধ্য হয়ে মিয়াজীর কাছে জমি বেচে দিতেন ক্ষতিগ্রস্তরা। এমন অবস্থায় কারো পক্ষে জমির ন্যায্য দাম আদায় করাও সম্ভব ছিল না। কেউ প্রতিবাদ করলে পুলিশ চলে আসত মিয়াজীর পক্ষে।
গ্রামবাসী জানান, হাসিনা পলায়নের পর অবস্থা বেগতিক দেখে মিয়াজী বৈঠকের নামে স্থানীয় প্রভাবশালীদের ডেকে আপ্যায়ন করেছিলেন তার বিনোদন কেন্দ্রে। সেখানে বিশেষ করে বিএনপি ও জামায়াতের লোকদের প্রাধান্য দেওয়া হয়। কিন্তু শেষরক্ষা হয়নি মিয়াজীর। গত ১৮ ফেব্রুয়ারি এই বিনোদন কেন্দ্র থেকে তাকে গ্রেপ্তার করা হয়। বিএনপির অফিস ভাঙচুরের মামলায় মিয়াজী এখন ঝিনাইদহ কারাগারে। এ কারণে তার বক্তব্য নেওয়া সম্ভব হয়নি।