
Sanaullah Patowary (সানাউল্লাহ পাটোয়ারী)
দিনটি ছিলো ১০ ফেব্রুয়ারী, ২০১৩। আমি তখন অনার্স ফাইনাল ইয়ারে পড়ি। ঐ দিন ডিপার্টমেন্ট থেকে হলে আসার পথে আমি যখন মুহসীন হল মাঠ পার হচ্ছিলাম, সেই সময় হলে আমার ইয়ারমেট দেওয়ান তুষার (সে বর্তমানে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের ম্যানেজমন্টের সহকারী অধ্যাপক) আমাকে কল দিয়ে কোথায় আছি জানতে চায়। আমি যখন বলি হল মাঠ পার হচ্ছি, সে আমাকে বলে হল গেটে দাঁড়া, তোর সাথে জরুরি কথা আছে। তুষার আমার জেলা ফেনীর ছেলে হওয়ায় তার সাথে আমার ভালো বন্ধুত্ব ছিলো, কিন্তু ভাবিনি যে সে আমাকে এমন বিপদে ডেকে নিয়ে ধরিয়ে দিবে।
আমি হল গেটে আসার সাথে সাথে দেখি তুষার সহ হলের মাহি গ্রুপের রিপন, মেহেদী সহ কয়েকজন হন্তদন্ত হয়ে গেটের দিকে আসতেছে। তখনই আমি টের পাই, আজকে কিছু একটা ঘটতে যাচ্ছে। কিছু ভাবার আগেই সবাই আমাকে ঘিরে ধরে। রিপন আমার ঘাড়ের উপর দিয়ে শক্ত করে ধরে বলে, চল্। আমি আর কিছু না বলে তাদের সাথে হাঁটতে থাকলাম, কারণ জানি কিছু বলে লাভ নেই।
তখন শাহবাগ উত্তাল, একজন শিবির ধরতে পারা ছিলো বিশাল কৃতিত্বের বিষয়। আর মেরে ফেললে তো কথাই নেই, খুনীরাই হবে হীরো। যাই হোক, আমাকে তারা ৪৬২ নাম্বার রুমে নিয়ে যায়। রুমটা ছিলো মাহি গ্রুপের নেতা বিপ্লবের। আমি মোটামুটি নিজের শেষ পরিণতি ভেবে নিয়ে স্বাভাবিক থাকার চেষ্টা করছিলাম। কিন্তু রুমে ঢুকে যখন দেখলাম হল শাখা শিবিরের সভাপতি রাকিব ভাই এবং ছোট ভাই ১ম বর্ষের নকীকেও আমার আগেই ধরে এনে নির্যাতন করা হয়েছে, তখন ভেতর থেকে মুষড়ে পড়লাম। তারপরও বাইরে স্বাভাবিক থাকার চেষ্টা করলাম। উল্লেখ্য যে, আমি তখন হল শাখা শিবিরের সেক্রেটারি ছিলাম। মূলত নকীর ফোনে থাকা মেসেজ দেখে তাকে অমানুষিক নির্যাতন করে তারা আমাদের নাম জানতে পেরেছে। রাকিব ভাই এবং নকীকে দেখেই বুঝা যাচ্ছিলো তাদের উপর অনেক পৈশাচিক নির্যাতন হয়েছে।
সেখানে উপস্থিত ছাত্রলীগের সবার হাতেই ছিলো রাম/দা, চাপা/তি সহ দেশীয় অস্ত্রশস্ত্র। রুমে ঢোকার পরেই আমার মোবাইল কেড়ে নেয়া হয়। আমার মোবাইলে কোনো তথ্য না পেয়ে তুষার বলে এরা নেতা তো, শেয়ানা মাল, মোবাইলে কিচ্ছু রাখে নাই। বুঝলাম রাকিব ভাইয়ের মোবাইলেও কিছু পায় নাই।
সেখানে থাকা আরেক সিনিয়র তুষার, বিপ্লব এবং রিপন আমার জিজ্ঞাসাবাদ শুরু করে, সাথে চলতে থাকে এলোপাথাড়ি থাপ্পড়, লাথি। ছাত্রলীগের ইয়ারমেট মেহেদী (ইয়াবা মেহেদী হিসেবে পরিচিত, পরবর্তীতে ছাত্রলীগের হল সেক্রেটারি হয়েছিলো), তুষার এবং জাহিদও যাচ্ছেতাই গালিগালাজ করতেছিলো এবং গায়ে হাত তুলতেছিলো।
এক পর্যায়ে বিপ্লব রুমের ফ্লোরে থাকা ব্যয়ামের মোটা রড দিয়ে এবং তুষার তার হাতে থাকা চিকন রড দিয়ে আমার পায়ের মধ্যে বাড়ি দিতে থাকে। পালাক্রমে রিপনও রড দিয়ে বাড়ি দিচ্ছিলো। মাঝেমধ্যে চা/পাতি দিয়ে পায়ের মধ্যে ছোট ছোট পোঁচ দিয়ে ভয়ের সৃষ্টি করছিলো যাতে করে আমরা মুখ খুলি।
তারা মূলত আমি শিবিরের সেক্রেটারি এবং রাকিব ভাই সভাপতি এটা আমাদের কাছ থেকে স্বীকারোক্তি নেয়ার চেষ্টা করছিলো। আর বিশ্ববিদ্যালয়ের কমিটি এবং সকল হল কমিটিতে কারা আছে তা জানতে চাচ্ছিলো। মুহসীন হলে আর কারা আছে তাদের নাম জানতে চাচ্ছিলো। আমরা স্বীকারই করি নাই যে আমরা শিবির করি, অন্যদের নাম বলা তো দূরের কথা।
আমাদের কাছ থেকে কোনো তথ্য বের করতে না পেরে তারা দিশেহারা হয়ে রড দিয়ে এলোপাথাড়ি বাড়ি দিতে থাকে। কিছু বলছি না দেখে রিপন তখন হুমকি দিয়ে বলে, "এই শালাগুলারে শাহবাগে নিয়া ছাইড়া দে, সবাই কুকুরের মতো খাবলাইয়া খাইবো, আর আমরা হবো নতুন প্রজন্মের মুক্তিযোদ্ধা"।
পালাক্রমে কখনো রাকিব ভাইয়ের উপর, কখনো আমার উপর দিয়ে অমানুষিক নির্যাতন চলছিলো। আমি প্রচন্ড যন্ত্রণায় কাঁতরাচ্ছিলাম আর মনে মনে কালেমা পড়ে রেডি হচ্ছিলাম। ক্যান্সার আক্রান্ত আমার আব্বা এবং আম্মার কথা মনে পড়ছিলো খুব। নির্যাতনের মাত্রা বাড়তে থাকায় আমার বাম পা থেকে ফিনকি দিয়ে রক্ত বের হতে থাকে এবং আমার রক্তে বিপ্লবের রুমের ফ্লোর ভেসে যায়। বিপ্লব তখন বলে, "শিবিরের রক্তে আমার রুমটা অপবিত্র হয়ে গেছে"। একটা পর্যায়ে আমি হুঁশ হারিয়ে ফেলি।
কতক্ষণ হুঁশ হারিয়েছিলাম জানি না। এরই মধ্যে তারা রাকিব ভাইকে চার তলার গ্রিল বিহীন জানালা দিয়ে ফেলে দিয়েছে। আমাকে হয়তো মৃত মনে করে আর ফেলে দেয় নাই বা আমার হুঁশ আসার অপেক্ষায় ছিলো। আমাদের ২ জন থেকে কোনো তথ্য না পেয়ে ইতোমধ্যে নকীকে আলাদা রুমে নিয়ে যায় আরো তথ্য বের করার জন্য।
আমার যখন হুঁশ আসে তখন বুঝতে পারি আমাকে ০৪ জন মিলে পাঁজাকোলা করে ধরে কোথাও নিয়ে যাচ্ছে। রক্ত শুন্য হয়ে আমার শরীরের নীচের অংশ অবস হয়ে গিয়েছিলো। লোকজনের কথাবার্তা শুনে বুঝলাম হল প্রশাসন এসেছে, আমাকে হল প্রভোস্টের রুমের সামনে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। আমার হুঁশ এসেছে সেটা আর কাউকে বুঝতে দেই নাই। সেখানে নিয়ে প্রভোস্টের রুমের সামনে ফ্লোরের উপর আমাকে ফেলে রাখা হয়।
সেখানে অনেকের কথাবার্তায় বুঝতে পারি যে ইতোমধ্যে পুলিশও এসেছে। হলের আরেক ছাত্রলীগ ক্যাডার রাহাত হঠাৎ করে আমার বুকের উপর প্রচন্ড জোরে লাথি মেরে বলে, "এই শু..য়োরের বাচ্চা ভান ধরে আছে"। আমার মনে হলো যেন, বুকের ছাতি ভেঙে গেছে। তারপরও জীম খিঁচে বেহুঁশের ভান ধরে থাকলাম। এতে করে পাশে থাকা হল প্রশাসনের কেউ বা পুলিশের কোনো এক অফিসার বললো, "এ মনে হয় আর বাঁচবে না, এরে আর মাইরো না"।
সেখানে আগে থেকেই ০৪ তলা থেকে ফেলে দিয়ে পা ভাঙা অবস্থায় রাকিব ভাই এবং নকীকে এনে রাখা হয়েছিলো। রাকিব ভাইয়ের পরিণতি কী হয়েছিলো তখনও আমি জানতাম না। পরে জানতে পারি ওনার ২ পায়ের পাতা একেকটা ০৫-০৬ খন্ড হয়েছে (উনি এখনো স্বাভাবিক ভাবে হাঁটতে পারেন না)।
এরপর আমাদেরকে পুলিশের ভ্যানে তুলে ঢাকা মেডিকেলে নিয়ে যাওয়া হয়। এরপর হাসপাতালের চিকিৎসা শেষে আমাকে ও নকীকে থানায় নিয়ে যাওয়া হয়। রাকিব ভাইকে হাসপাতালেই পুলিশী পাহারায় থাকতে হয় অনেক দিন।
- সানাউল্লাহ পাটোয়ারী
এডভোকেট, বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্ট