
নরসিংদীতে খুনোখুনি থামছে না। জেলার একই পরিবারের চারজন সদস্য খুন হয়েছেন প্রতিপক্ষের হাতে। প্রথম খুনের ঘটনা ঘটে ১৯৭২ সালে, সর্বশেষটি ২০২৩ সালে। পাঁচ দশকের ব্যবধানে ঘটা এসব খুনের নেপথ্যে রয়েছে রাজনৈতিক দ্বন্দ্ব ও আধিপত্য বিস্তারের জের। এর পাশাপাশি জমিজমা নিয়ে বিরোধ, গোষ্ঠীদ্বন্দ্ব, পারিবারিক কলহসহ নানা তুচ্ছ কারণেও ঘটছে খুনোখুনি। পুলিশের হিসাবে, গত ২০ বছরে এ জেলায় খুন হয়েছেন দেড় হাজারের বেশি মানুষ।
যে পরিবারটি তাদের চার সদস্যকে হারিয়েছে, সেটি শিবপুর উপজেলার খান পরিবার। ২০২৩ সালে খুন হন ওই পরিবারের সদস্য হারুনুর রশিদ খান, তিনি তখন শিবপুর উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান ছিলেন। স্বাধীনতার পর ১৯৭২ সালে পরিবারটির কোনো সদস্য প্রথম খুন হন। তাঁর নাম মোক্তার খান, যিনি হারুনুর রশিদের চাচাতো ভাই। আশির দশকের মাঝামাঝিতে হারুনুর রশিদের আরও দুই চাচাতো ভাই সাজু খান ও সাবেক সংসদ সদস্য রবিউল আউয়াল খানকে (কিরণ) হত্যা করা হয়। এর মধ্যে সাজু খান ছিলেন দুলালপুর ইউনিয়ন পরিষদের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান। তাঁকে হত্যা করা হয় ১৯৮৫ সালে। পরের বছর হত্যা করা হয় রবিউল আউয়াল খানকে।
প্রথম আলোর অনুসন্ধানে পাওয়া গেছে, চারজনই খুন হয়েছেন আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীদের হাতে। যদিও খান পরিবারও আওয়ামী লীগের রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত। পরিবারটির তিন সদস্যের সঙ্গে প্রথম আলোর আলাদাভাবে কথা হয়। তাঁরা বলেন, রাজনৈতিক কোন্দল ও প্রভাব বিস্তারকে কেন্দ্র করে তাঁদের পরিবারকে বারবার লক্ষ্যবস্তু বানানো হয়েছে। এর মধ্যে দুটি ঘটনায় সর্বহারা পার্টির সন্ত্রাসীদের ব্যবহার করা হয়েছে। তাঁরা এসব হত্যাকাণ্ডের বিচার পাননি বলে জানান।
এসব খুনের নেপথ্যে রয়েছে রাজনৈতিক দ্বন্দ্ব ও আধিপত্য বিস্তারের জের। এর পাশাপাশি জমিজমা নিয়ে বিরোধ, গোষ্ঠীদ্বন্দ্ব, পারিবারিক কলহসহ নানা তুচ্ছ কারণেও ঘটছে খুনোখুনি।
অবশ্য এর মধ্যে সাবেক সংসদ সদস্য রবিউল হত্যা মামলার রায় হলেও তাতে ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠিত হয়নি বলে দাবি পরিবারের। ১৮ বছর পর ওই মামলায় একজনের ফাঁসির আদেশ দিয়েছিলেন আদালত। তবে দণ্ড কার্যকর হওয়ার আগেই ওই ব্যক্তির মৃত্যু হয়।
অনুসন্ধানে পাওয়া তথ্য বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, রাজনৈতিক দ্বন্দ্বের জেরে অধিকাংশ আলোচিত খুনের ঘটনা ঘটেছে নরসিংদী শহর ও শিবপুর উপজেলায়। পলাশ উপজেলাতেও রাজনৈতিক খুনের ঘটনা আছে। এ ছাড়া সদর ও রায়পুরা উপজেলায় মেঘনার চরাঞ্চলের ১১টি ইউনিয়নে প্রভাব বিস্তার ও গোষ্ঠীদ্বন্দ্বের জেরে মাঝেমধ্যেই খুনের ঘটনা ঘটেছে।
পুলিশ বলছে, ঢাকা বিভাগের ১৩ জেলার মধ্যে সবচেয়ে বেশি খুনোখুনি হয় নরসিংদীতে। গত ২০ বছরে এ জেলায় খুন হয়েছেন দেড় হাজারের বেশি মানুষ। চলতি বছরের প্রথম চার মাসে (জানুয়ারি-এপ্রিল) খুনের শিকার হয়েছেন অন্তত ৩৯ জন।
গত ৬ বছরের তথ্য বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, নরসিংদী ছাড়া ঢাকা বিভাগের অন্যান্য জেলায় প্রতিবছর গড়ে ৫৪টি খুনের ঘটনা ঘটেছে; সেখানে নরসিংদীতে এ সংখ্যা ৭৫। অর্থাৎ ঢাকা রেঞ্জের অন্যান্য জেলার তুলনায় নরসিংদীতে খুনের ঘটনা প্রায় দেড় গুণ।
নরসিংদীতে খুনোখুনির ঘটনা অনুসন্ধানকালে এই প্রতিবেদকেরা ভুক্তভোগী পরিবার, প্রশাসন, রাজনীতিক, নাগরিক সমাজ, শিক্ষক, আইনজীবীসহ বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষের সঙ্গে কথা বলেন। প্রাপ্ত তথ্য-উপাত্ত বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, স্বাধীনতার পর খুন হওয়া ব্যক্তিদের তালিকায় রয়েছেন ২ জন সংসদ সদস্য, ১ জন উপজেলা চেয়ারম্যান, ১ জন পৌর মেয়র ও ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) ১৫ জন চেয়ারম্যান। এ ছাড়া খুন হয়েছেন ইউপি সদস্য, রাজনৈতিক দলের নেতা-কর্মী, শ্রমিকনেতা, ব্যবসায়ী ও চিহ্নিত সন্ত্রাসী। রাজনৈতিক দ্বন্দ্বে ঘটা হত্যাকাণ্ডগুলোর মধ্যে মাত্র দুটির বিচার হয়েছে।
চার দশক ধরে নরসিংদীতে রাজনীতি করেন আরিফুল ইসলাম মৃধা। তিনি শিবপুর উপজেলার সাবেক চেয়ারম্যান। খুনোখুনির কারণ সম্পর্কে তিনি প্রথম আলোকে বলেন, রাজনৈতিক দলের নেতাদের স্বেচ্ছাচারিতা ও দুর্নীতির কারণেই খুনোখুনির ধারা চলছে। তিনি মনে করেন, রাজনৈতিক সদিচ্ছার মাধ্যমে খুনোখুনি বন্ধ করা সম্ভব।
গত ৬ বছরের তথ্য বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, নরসিংদী ছাড়া ঢাকা বিভাগের অন্যান্য জেলায় প্রতিবছর গড়ে ৫৪টি খুনের ঘটনা ঘটেছে; সেখানে নরসিংদীতে এ সংখ্যা ৭৫। অর্থাৎ ঢাকা রেঞ্জের অন্যান্য জেলার তুলনায় নরসিংদীতে খুনের ঘটনা প্রায় দেড় গুণ।
চুয়াত্তরে এমপি হত্যার মধ্য দিয়ে শুরু
স্থানীয়ভাবে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, ১৯৭২ থেকে ১৯৮৯ সাল পর্যন্ত—এই ১৮ বছর শিবপুর, মনোহরদী, বেলাবসহ জেলার বিভিন্ন এলাকায় পূর্ব বাংলা সর্বহারা পার্টির ব্যাপক প্রভাব ছিল। ওই সময় দলটির নামে রাজনৈতিক নেতা-কর্মীসহ বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার অনেক মানুষকে হত্যা করা হয়।
স্বাধীনতার পর সবচেয়ে আলোচিত হত্যাকাণ্ড ছিল বেলাব-মনোহরদীর তৎকালীন সংসদ সদস্য (এমপি) গাজী ফজলুর রহমানের হত্যার ঘটনা। ১৯৭৪ সালে সর্বহারা পার্টির লোকজন তাঁকে গুলি করে হত্যা করে।
সম্প্রতি মনোহরদীর নোয়াদিয়া গ্রামে ফজলুর রহমানের গ্রামের বাড়িতে গিয়ে কাউকে পাওয়া যায়নি। তাঁর সন্তানেরা কেউ সেখানে থাকেন না বলে স্থানীয় লোকজন জানান।
ফজলুর রহমানের ছেলে গাজী সেলিম একসময় ঠিকাদারি করতেন। থাকেন ঢাকায়। তিনি ৬ মে মুঠোফোনে প্রথম আলোকে বলেন, তাঁর বাবাকে হত্যার পর পুলিশ বাড়িতে গিয়েছিল। সেই স্মৃতি আবছা মনে আছে। রাজনীতি করতে গিয়ে তাঁর বাবা খুন হয়েছেন। সে জন্য তাঁরা কেউ রাজনীতিতে জড়াননি।
১৯৮৬ সালে খুন হন শিবপুরের খান পরিবারের সাবেক সংসদ সদস্য রবিউল আউয়াল খান। তিনি যুবলীগের কেন্দ্রীয় সদস্য ছিলেন। বাকশাল গঠনের পর জেলার যুগ্ম সম্পাদক এবং পরে জেলা আওয়ামী লীগের সহসভাপতি ছিলেন। রবিউলের পরিবারের দাবি, আওয়ামী লীগের অন্তর্কোন্দলে প্রাণ হারিয়েছেন তিনি। সর্বহারা পার্টির লোকজন দিয়ে তাঁকে খুন করানো হয়।
স্বাধীনতার পর সবচেয়ে আলোচিত হত্যাকাণ্ড ছিল বেলাব-মনোহরদীর তৎকালীন সংসদ সদস্য (এমপি) গাজী ফজলুর রহমানের হত্যার ঘটনা। ১৯৭৪ সালে সর্বহারা পার্টির লোকজন তাঁকে গুলি করে হত্যা করে।
১৯৭২ থেকে ১৯৮৯ সাল পর্যন্ত নরসিংদীতে রবিউলের মতো শতাধিক ব্যক্তি পূর্ব বাংলা সর্বহারা পার্টির লোকদের হাতে খুন হন বলে জানান সংগঠনটির সাবেক দুজন সদস্য। তাঁদের দাবি, শ্রেণিশত্রু হিসেবে চিহ্নিত করে এসব ব্যক্তিকে খুন করা হয়।
স্বাধীনতা-পরবর্তী সময়ে রাজনৈতিক বিরোধ ও স্থানীয় কোন্দলের কারণেও মানুষের প্রাণ গেছে। ১৯৭২ সালের ২৬ সেপ্টেম্বর পাঁচদোনা এলাকায় গুলি করে হত্যা করা হয় সিরাজউদ্দিন আহমেদকে (নেভাল সিরাজ)। মুক্তিযুদ্ধে বীরত্বপূর্ণ অবদানের জন্য তিনি ‘বীর প্রতীক’ খেতাব পেয়েছিলেন।
সিরাজউদ্দিন আহমেদের ছেলে মোয়াজ্জেম হোসেন এখন পুলিশের পরিদর্শক। মুঠোফোনে তিনি প্রথম আলোকে বলেন, তাঁর বাবা মুক্তিযুদ্ধের পর মাওলানা ভাসানীর নেতৃত্বাধীন ন্যাপে (ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি) যোগ দেন। এতে ক্ষিপ্ত হয়ে আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীরা তাঁকে (সিরাজউদ্দিন) হত্যা করেন।
মোয়াজ্জেম হোসেন বলেন, তাঁর বাবা যখন খুন হন, তখন বিচার চাওয়ার মতো পরিস্থিতি ছিল না। এত বছর পর আর বিচারের প্রত্যাশা করেন না।
পাঁচ দশক ধরে নরসিংদীতে সাংবাদিকতা করেন নিবারণ রায়। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, নরসিংদীর খুনোখুনির ইতিহাস পুরোনো। স্বাধীনতার পর পূর্ব বাংলা সর্বহারা পার্টির হাতে বহু মানুষ খুন হন। রাজনৈতিক দ্বন্দ্ব, আধিপত্য বিস্তার ও গোষ্ঠীদ্বন্দ্বে খুনোখুনির জন্য নরসিংদী এখনো আলোচিত হচ্ছে।
খুন নিয়ে ‘রাজনীতি’
২০০৪ সালের ১৭ জানুয়ারি প্রথম আলোয় প্রকাশিত একটি প্রতিবেদনের শিরোনাম ছিল, ‘তিন বছরেও মিছরি বেগম পাননি পুত্র হত্যার বিচার’। ২০০১ সালের ১ জানুয়ারি মিছরি বেগমের ছেলে ওয়ার্ড কাউন্সিলর মানিক মিয়াকে নরসিংদী শহরে গুলি করে হত্যা করা হয়।
প্রথম আলোর ওই প্রতিবেদন ছাপা হওয়ার পর ১১ বছর বেঁচে ছিলেন মিছরি বেগম। ছেলে হত্যার বিচার দেখে যেতে পারেননি। তাঁর মৃত্যুর পর পেরিয়ে গেছে আরও এক দশক। এখনো শেষ হয়নি মানিক হত্যার বিচার।
মানিক হত্যার প্রধান আসামি ছিলেন জেলা ছাত্রলীগের তৎকালীন সাধারণ সম্পাদক লোকমান হোসেন। লোকমান পরবর্তী সময়ে নরসিংদী পৌরসভার মেয়র হন। মিছরি বেগম বেঁচে থাকা অবস্থায় ২০১১ সালের নভেম্বরে খুন হন মেয়র লোকমান হোসেন। এই খুনেরও বিচার শেষ হয়নি।
হত্যাকাণ্ড দুটি নিয়ে স্থানীয় আওয়ামী লীগের তিনজন নেতার সঙ্গে কথা হয়। তাঁরা জানান, দুটি খুন নিয়েই ‘রাজনীতি’ হয়েছে। লোকমানের পরিবার রাজনৈতিকভাবে প্রভাবশালী হওয়ায় মানিকের পরিবার বিচার পায়নি। লোকমান ব্যাপক প্রভাবশালী ছিলেন। লোকমান খুন হওয়ার পর তাঁর পরিবার ‘সহানুভূতির’ সুযোগ নেয়। তাঁর ভাই কামরুজ্জামান পৌরসভার মেয়র হয়েছিলেন। লোকমানের স্ত্রী তামান্না নুসরাত সংরক্ষিত আসনের সংসদ সদস্য হয়েছিলেন।
নরসিংদীর খুনোখুনির ইতিহাস পুরোনো। স্বাধীনতার পর পূর্ব বাংলা সর্বহারা পার্টির হাতে বহু মানুষ খুন হন। রাজনৈতিক দ্বন্দ্ব, আধিপত্য বিস্তার ও গোষ্ঠীদ্বন্দ্বে খুনোখুনির জন্য নরসিংদী এখনো আলোচিত হচ্ছে।নিবারণ রায়, সাংবাদিক
লোকমানের ভাই কামরুজ্জামানও মানিক হত্যা মামলার আসামি। গণ-অভ্যুত্থানে গত বছরের ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর থেকে কামরুজ্জামান আত্মগোপনে রয়েছেন। তাই তাঁর বক্তব্য নেওয়া সম্ভব হয়নি।
মানিকের ভাই আমিরুল ইসলাম আক্ষেপ করে বলেন, বিচারের অপেক্ষা করতে করতে মা মারা গেলেন। আসামিদের হুমকিতে তাঁরা সাক্ষ্য পর্যন্ত দিতে পারেননি। বিচার আদৌ শেষ হবে কি না, তাঁর জানা নেই।
১৯৯৫ সালে নরসিংদী সদরের তৎকালীন বিএনপিদলীয় সংসদ সদস্য সামশুদ্দিন আহমেদ এছহাকের ছেলে মাসুদ আহমেদ খুন হন। ওই সময় আলোচিত এই হত্যা মামলায় যাঁদের আসামি করা হয়, তাঁরা ছাত্রদল ও যুবদলের রাজনীতিতে যুক্ত ছিলেন। এই মামলায় ২০০১ সালে আবদুস সালাম নামের একজনের ফাঁসির আদেশ হয়েছিল। যাবজ্জীবন সাজা হয়েছিল ছয়জনের। পরে ২০০৪ সালে উচ্চ আদালতে আপিলের পর সব আসামি খালাস পান।
নিম্ন আদালতের রায়ে যাঁদের সাজা হয়েছিল, তাঁদের মধ্যে আবদুর রহমান এখন রায়পুরা উপজেলা বিএনপির সাধারণ সম্পাদক, মহসীন হোসেন নরসিংদী যুবদলের সভাপতি এবং হাসানুজ্জামান সরকার জেলা যুবদলের সাধারণ সম্পাদক।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, প্রায় ২৫ বছর ধরে চান্দেরকান্দি ইউনিয়নের আবিদ হাসান গোষ্ঠী ও আবদুল বাছেদ গোষ্ঠীর মধ্যে দ্বন্দ্ব ও সংঘর্ষ চলছে। ঘটেছে হত্যাকাণ্ড। গত বছরের ৭ ডিসেম্বর এ দুই গোষ্ঠীর দ্বন্দ্বে ইউপি সদস্য মানিক মিয়া ও সাবেক সংরক্ষিত নারী ইউপি সদস্য কল্পনা বেগম নিহত হন।
৩০ বছর আগের ওই ঘটনা সম্পর্কে জানতে চাইলে আবদুর রহমান প্রথম আলোকে বলেন, রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে তাঁদের বিরুদ্ধে মামলা হয়েছিল। খুনে জড়িত না থাকায় উচ্চ আদালত তাঁদের খালাস দিয়েছেন।
মাসুদ হত্যার বিষয়ে তাঁর ভাই জেলা বিএনপির সাবেক যুগ্ম আহ্বায়ক হারুন-অর-রশিদ বিস্তারিত কথা বলতে চাননি। তিনি শুধু বলেন, আসামিদের তাঁরা ক্ষমা করে দিয়েছেন।
গত তিন দশকে খুনের শিকার আওয়ামী লীগের ছয়জন এবং বিএনপির পাঁচজনের স্বজনদের সঙ্গে কথা বলেছে প্রথম আলো। তাঁরা বলেন, বিচারের দীর্ঘসূত্রতা, রাজনৈতিক চাপ ও সাক্ষীর অভাবে মামলাগুলোর ভবিষ্যৎ নিয়ে তাঁরা সন্দিহান।
জেলা বিএনপির সাবেক যুগ্ম আহ্বায়ক এবং নরসিংদী জেলা ও দায়রা জজ আদালতের সরকারি কৌঁসুলি (পিপি) আবদুল বাছেদ ভূঁইয়া প্রথম আলোকে বলেন, রাজনৈতিক খুনের মামলাগুলোতে আসামি করার ক্ষেত্রেও রাজনৈতিক উদ্দেশ্য থাকে। ফলে খুনে জড়িত ব্যক্তিদের বাইরেও প্রতিপক্ষের লোকজনকে আসামি করা হয়। এতে সাক্ষীরা সাক্ষ্য দেন না। ফলে এসব মামলার সঠিক বিচার হয় না।
বিচারপ্রার্থীরা এখন আসামি
জুলাই গণ-অভ্যুত্থানে আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পরও নরসিংদীর পরিস্থিতি খুব একটা বদলায়নি। ২০২৩ সালের মে মাসে হামলায় নিহত হন জেলা ছাত্রদলের সাবেক যুগ্ম আহ্বায়ক ছাদিকুর রহমান। এ হত্যাকাণ্ডে বিএনপির নেতাদের আসামি করায় এখন বিপাকে তাঁর পরিবার।
ছাদিকুরের পাঁচ ভাইকে গণ-অভ্যুত্থানের সময়ের হত্যা মামলার আসামি করা হয়েছে। তাঁদের মধ্যে রয়েছেন জেলা যুবদলের সাংগঠনিক সম্পাদক ফারুক হোসেন। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, তাঁর পরিবার বিএনপির রাজনীতিতে যুক্ত। অথচ ছাত্র-জনতার ওপর হামলা ও হত্যার ঘটনায় করা চার মামলায় তাঁদের পাঁচ ভাইকে আসামি করা হয়েছে। তাঁর ভাই আলতাফ হোসেন (ছাদিকুর হত্যা মামলার বাদী) আট মাস ধরে কারাগারে।
ফারুক হোসেনের ভাষ্য, ছাদিকুর হত্যা মামলার আসামিরা বিএনপির রাজনীতিতে যুক্ত। একজন আসামি সমঝোতা করার জন্য চাপ দিচ্ছেন। তিনি জেলা বিএনপির সভাপতি খায়রুল কবিরের (খোকন) ঘনিষ্ঠ। খায়রুল কবিরও ছাদিকুর হত্যা মামলার আসামি।
ফারুক ও তাঁর ভাইদের বিরুদ্ধে করা মামলাগুলোর মধ্যে তিনটির তথ্য-উপাত্ত সংগ্রহ করা সম্ভব হয়েছে। এর মধ্যে দুটি মামলায় ফারুকসহ পাঁচ ভাইকে আসামি করা হয়েছে। অন্য মামলার আসামি ফারুকসহ তিন ভাই।
একটি মামলার বাদী আমির হোসেন নিজেকে শ্রমিক দলের নেতা বলে পরিচয় দেন। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, আন্দোলনের সময় গুলিবিদ্ধ হয়ে তাঁর চাচাতো ভাই জাহাঙ্গীর আলম নিহত হন। জাহাঙ্গীরও শ্রমিক দলের নেতা ছিলেন। জেলা বিএনপির সভাপতির সঙ্গে পরামর্শ করে তিনি মামলা করেছেন। হত্যায় জড়িত ব্যক্তিদেরই আসামি করা হয়েছে বলে দাবি করেন আমির হোসেন।
ছাদিকুরের ভাইদের বিরুদ্ধে করা মামলার বিষয়ে জেলা বিএনপির সভাপতি খায়রুল কবির প্রথম আলোকে বলেন, নিশ্চয়ই কোনো না কোনোভাবে এসব ঘটনায় জড়িত ছিলেন তাঁরা। এ জন্যই হয়তো তাঁদের বিরুদ্ধে মামলা হয়েছে। তবে তাঁর যোগসাজশে কোনো মামলা হয়নি বলে দাবি করেন খায়রুল কবির।
রাজনৈতিক খুনের মামলাগুলোতে আসামি করার ক্ষেত্রেও রাজনৈতিক উদ্দেশ্য থাকে। ফলে খুনে জড়িত ব্যক্তিদের বাইরেও প্রতিপক্ষের লোকজনকে আসামি করা হয়। এতে সাক্ষীরা সাক্ষ্য দেন না। ফলে এসব মামলার সঠিক বিচার হয় না।নরসিংদী জেলা ও দায়রা জজ আদালতের সরকারি কৌঁসুলি (পিপি) আবদুল বাছেদ ভূঁইয়া
রাজনৈতিক আধিপত্য বিস্তারে খুন
আওয়ামী লীগের সাড়ে ১৫ বছরের শাসনামলে নরসিংদীতে পাঁচজন সাবেক ও তৎকালীন ইউপি চেয়ারম্যান, একজন উপজেলা চেয়ারম্যান এবং একজন পৌর মেয়র খুন হয়েছেন। তাঁরা সবাই আওয়ামী লীগের রাজনীতি করতেন। এই সময়ে বিএনপি ও এর অঙ্গসংগঠনের পাঁচজন নেতা-কর্মী খুন হওয়ার তথ্য পাওয়া গেছে।
মামলা পর্যালোচনা করে দেখা গেছে, নিজ দলের কোন্দল ও স্থানীয় আধিপত্যকে কেন্দ্র করে এসব খুন হয়। মামলার আসামিরাও নিজ দলের নেতা-কর্মী।
আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পরও স্থানীয় আধিপত্য বিস্তারকে কেন্দ্র করে খুনোখুনি বন্ধ হয়নি। গত বছরের ৫ আগস্টের পর নরসিংদী শহরসংলগ্ন শিলমান্দী, পাঁচদোনা ও মাধবদী এলাকায় আধিপত্য বিস্তারকে কেন্দ্র করে বিএনপির অঙ্গসংগঠনের তিনজন খুন হয়েছেন। তাঁদের একজন পাঁচদোনা ইউনিয়ন শ্রমিক দলের সাধারণ সম্পাদক আলম মিয়া। গত বছরের ১৮ ডিসেম্বর বিএনপি ও যুবদলের দুই নেতার সমর্থকদের সংঘর্ষের সময় গুলিবিদ্ধ হয়ে আলম নিহত হন।
গত ১৭ জানুয়ারি শেখেরচর-বাবুরহাট বাজারের নিয়ন্ত্রণ নিয়ে যুবদলের দুই নেতার সমর্থকদের সংঘর্ষে মঞ্জু মিয়া নামের এক তরুণ নিহত হন। যে দুই নেতার বিরোধের জেরে মঞ্জু নিহত হন, তাঁরা হলেন মেহেরপাড়া ইউনিয়ন যুবদলের সভাপতি ইফতেখার আলম (বাবলা) এবং ইউনিয়ন যুবদলের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক আকরাম হোসেন। একাধিকবার চেষ্টা করেও বক্তব্য নিতে এই দুই নেতার সঙ্গে যোগাযোগ স্থাপন করা সম্ভব হয়নি।
সর্বশেষ গত ১৫ জুন সন্ধ্যায় পলাশ বাসস্ট্যান্ডসংলগ্ন বিএডিসি এলাকায় বিএনপির দুই পক্ষের মধ্যে সংঘর্ষে দুজন গুলিবিদ্ধ হন। তাঁদের একজন ছাত্রদল কর্মী ইসমাইল হোসেন (২৬) চিকিৎসাধীন থাকা অবস্থায় ২১ জুন মারা যান।
স্থানীয় ব্যক্তিরা জানান, শিলমান্দী, পাঁচদোনা ও মাধবদী ব্যবসা-বাণিজ্যের কেন্দ্রস্থল। অন্যতম বড় পাইকারি হাট শেখেরচর বাবুরহাটের অবস্থানও এই অঞ্চলে। পুরোনো এই হাটের নিয়ন্ত্রণ ও আধিপত্য বিস্তার নিয়ে স্থানীয় প্রভাবশালীদের মধ্যে দ্বন্দ্ব আছে। ৫ আগস্টের পর এই অঞ্চলের নিয়ন্ত্রণ নিতেই বিএনপি ও এর অঙ্গসংগঠনের নেতা-কর্মীরা সংঘাতে জড়িয়ে পড়েছেন।
নরসিংদী জেলা বিএনপির সভাপতি খায়রুল কবির প্রথম আলোকে বলেন, প্রশাসনকে বলা হয়েছে, যাঁরাই জড়িত থাকুন না কেন, তাঁদের বিরুদ্ধে যেন ব্যবস্থা নেওয়া হয়। দলের কেউ জড়িত হলে সাংগঠনিক ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে।
গোষ্ঠীদ্বন্দ্বে বাড়ছে খুনোখুনি
নরসিংদী সদর ও রায়পুরার চরাঞ্চলের বিভিন্ন ইউনিয়নে পেছনে প্রধান কারণ আধিপত্য বিস্তার ও গোষ্ঠীগত দ্বন্দ্ব। সর্বশেষ ২৫ জুন রায়পুরার চান্দেরকান্দি ইউনিয়নের দাইরেরপাড় গ্রামে একজনকে কুপিয়ে হত্যার ঘটনা ঘটেছে। নিহত ব্যক্তির নাম জাহিদুল ইসলাম (৩৫)। তাঁর বাড়ি বাঁশগাড়ীর দিঘলীকান্দিতে।
পুলিশ ও স্থানীয়রা বলছেন, চান্দেরকান্দি ইউনিয়নের আবিদ হাসান গোষ্ঠী ও আবদুল বাছেদ গোষ্ঠী দ্বন্দ্বের জেরে জাহিদুলকে হত্যা করা হয়েছে। এই দুই গোষ্ঠীর দ্বন্দ্বে ৬ মে রায়পুরার চান্দেরকান্দির নজরপুর গ্রামে প্রাণ গেছে সাইফুল ইসলাম নামের আরেক ব্যক্তির।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, প্রায় ২৫ বছর ধরে চান্দেরকান্দি ইউনিয়নের আবিদ হাসান গোষ্ঠী ও আবদুল বাছেদ গোষ্ঠীর মধ্যে দ্বন্দ্ব ও সংঘর্ষ চলছে। ঘটেছে হত্যাকাণ্ড। গত বছরের ৭ ডিসেম্বর এ দুই গোষ্ঠীর দ্বন্দ্বে ইউপি সদস্য মানিক মিয়া ও সাবেক সংরক্ষিত নারী ইউপি সদস্য কল্পনা বেগম নিহত হন।
আবিদ হাসান ও আবদুল বাছেদের বক্তব্য জানতে নানাভাবে চেষ্টা করেও তাঁদের সঙ্গে যোগাযোগ স্থাপন করা যায়নি। তাঁদের মুঠোফোনও বন্ধ পাওয়া গেছে।
স্থানীয় সূত্রগুলো বলছে, গত সাত বছরে চরাঞ্চলে আধিপত্য বিস্তার ও গোষ্ঠীদ্বন্দ্বে ৬৬ জন নিহত হয়েছেন। আর ৫ আগস্টের পর ১০ মাসে খুন হন ১৭ জন। দিন দিন এই গোষ্ঠীদ্বন্দ্ব প্রকট হচ্ছে। এর শেষ কোথায়, কেউ জানে না।
শেরেবাংলা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক জসিম উদ্দিনের বাড়ি রায়পুরা উপজেলার বাঁশগাড়ী ইউনিয়নে। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, চরের গোষ্ঠীদ্বন্দ্বগুলো নিজেদের স্বার্থে রাজনৈতিক নেতারা জিইয়ে রাখেন। এ ছাড়া চরাঞ্চলে আগ্নেয়াস্ত্র ঢুকে পড়েছে। আগে টেঁটা-বল্লম নিয়ে সংঘর্ষে লিপ্ত হতো, এখন ব্যবহার হচ্ছে আগ্নেয়াস্ত্র। এতে খুনোখুনি বেড়েছে।
সমন্বিত উদ্যোগ নেওয়ার তাগিদ
মেঘনা, শীতলক্ষ্যা, আড়িয়াল খাঁ, হাড়িধোয়া, পাহাড়িয়া নদী ও পুরাতন ব্রহ্মপুত্র নদের অববাহিকায় নরসিংদী জেলার অবস্থান। রাজধানীর ঢাকার জিরো পয়েন্ট থেকে নরসিংদী সদরের দূরত্ব ৫২ কিলোমিটার। নদীর তীরে এবং ঢাকার কাছে হওয়ায় শিল্প-বাণিজ্যে সমৃদ্ধশালী জেলা হিসেবে নরসিংদীর পরিচিতি রয়েছে। তবে স্বাধীনতার পর থেকে খুনোখুনির জন্য বারবার আলোচিত হয়েছে এ জেলার নাম।
পরিস্থিতির উন্নয়নে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী চেষ্টা করছে বলে জানান নরসিংদী জেলা পুলিশ সুপার আবদুল হান্নান।
নরসিংদী সরকারি মহিলা কলেজের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের বিভাগীয় প্রধান মুহাম্মদ সোহরাওয়ার্দীর বাড়ি জেলার বেলাব উপজেলায়। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, স্বাধীনতার পর থেকেই নরসিংদীতে খুনোখুনি চলছে। খুনের কারণগুলোও জানা। কিন্তু এসব খুনোখুনি বন্ধে প্রশাসনিক উদ্যোগ কম। অধিকাংশ ঘটনায় ভুক্তভোগীরা বিচার পান না। প্রশাসনিক উদ্যোগ, স্থানীয় জনপ্রতিনিধি ও রাজনৈতিক নেতাদের সম্পৃক্ত করে সমন্বিত উদ্যোগ নেওয়া গেলে হয়তো এমন খুনোখুনি কমে আসবে।