Image description
 

দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলমানের বিপক্ষে সর্বদা অবস্থান নিয়ে ইসলামবিরোধী বিভিন্ন কর্মকাণ্ডে জড়িত ছিল পতিত আওয়ামী সরকার। আর তাদের এই কাজে প্রকাশ্য সহযোগী ছিলেন একশ্রেণির নামধারী আলেম।

সরকারের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ পদে নিয়োগ পাওয়াসহ নানা মহলের সুযোগ-সুবিধা নিয়ে মূল ধারার শীর্ষ আলেম সম্প্রদায়ের বিরুদ্ধে অবস্থান নিতেন তারা। সরকারের অন্যায় কর্মকাণ্ডের প্রতিবাদকারী ধর্মপ্রাণ মানুষের দমনপীড়নেও এসব সুবিধাভোগী আলেম তৎপর ছিলেন।

কথিত এসব আলেমের বিরুদ্ধে নানা অনিয়ম-দুর্নীতিতে জড়িত থাকার অভিযোগ রয়েছে। এসব আলেমের অনেককে ফ্যাসিস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের পুরোটা সময় সরব দেখা গেছে। কিন্তু গত ৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার গণঅভ্যুত্থান-পরবর্তী সুবিধাভোগী এসব আলেমের তৎপরতা থেমে গেছে।

উদ্ভূত পরিস্থিতিতে বেশ বিপাকে পড়েছেন তারা। সরকারি বিভিন্ন দায়িত্ব এবং রাজনৈতিক পদ থেকে বাদ পড়েছেন অনেকে। কয়েকজনের বিরুদ্ধে হত্যা মামলাও হয়েছে। জনরোষের ভয়ে অনেকটা আত্মগোপনে দিন কাটাচ্ছেন আওয়ামী সুবিধাভোগী আলেমের অনেকে।

তবে কেউ কেউ আবার অতীত কর্মকাণ্ড আড়াল করে বিভিন্ন মহলের সঙ্গে যোগসাজশ করে মূলধারায় ফেরার বা প্রাতিষ্ঠানিক পদ ধরে রাখার চেষ্টা করছেন। এতে ধর্মপ্রাণ মুসল্লিসহ সংশ্লিষ্ট মহলে চরম ক্ষোভ বিরাজ করছে। পতিত আওয়ামী সরকারের সুবিধাভোগী দুর্নীতিবাজ আলেমদের অবিলম্বে আইনের আওতায় আনার দাবি জানিয়েছেন তারা।

আওয়ামী সরকারের চরম নিপীড়নের শিকার ইসলামী ঐক্যজোটের মহাসচিব মুফতি সাখাওয়াত হোসাইন রাজী এ প্রসঙ্গে আমার দেশকে বলেন, বিগত ফ্যাসিবাদী সরকারের সময়ে নামধারী কিছু মৌলবি নানা সুযোগ-সুবিধা নিয়ে ইসলাম ও মুসলমানদের ব্যাপক ক্ষতি করেছেন। তাদের কারণে মাঠপর্যায়ে প্রকৃত আলেমরা একদিকে জুলুমের শিকার হয়েছেন, অন্যদিকে আলেম-ওলামা ও ইসলামি নেতৃত্বের প্রতি সাধারণ মানুষের আস্থা-বিশ্বাস ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। বাংলাদেশে ইসলামী আন্দোলন-সংগ্রামের সুন্দর ভবিষ্যৎ বাধাগ্রস্ত করেছেন তারা।

দেখে নেওয়া যাক নামধারী আলেম হিসেবে পরিচিত ফরীদ উদ্দীন মাসঊদ, মাওলানা রুহুল আমিন, মাওলানা মুহাম্মদ কাফীলুদ্দীন সরকার, আবু রেজা মুহাম্মদ নেজামউদ্দিন নদভী, মিছবাহুর রহমান চৌধুরী, মুফতি ফয়জুল্লাহ, আনাস মাদানী, আবুল হাসনাত আমিনী, মাওলানা শাহিনুর পাশা চৌধুরী, মাওলানা রহুল আমিন খান উজানবি, ড. আবুল কালাম আজাদ ও খেলাফত আন্দোলনের বিতর্কিত আলেমদের কে কী করেছেন, কী অবস্থায় আছেন :

মাওলানা ফরীদ উদ্দীন মাসঊদ

আওয়ামী সরকারের সবচেয়ে আস্থাভাজন ও কওমি অঙ্গনের বিতর্কিত আলেম ছিলেন মাওলানা ফরীদ উদ্দীন মাসঊদ। সরকারের সঙ্গে সুসম্পর্কের সুবাদে ইসলামিক ফাউন্ডেশনের বোর্ড অব গভর্নরসের গভর্নর এবং ঐতিহাসিক শোলাকিয়া ঈদগাহের ইমাম নিযুক্ত হন তিনি। কওমি সংশ্লিষ্ট জাতীয় দ্বীনি মাদরাসা শিক্ষাবোর্ড বাংলাদেশ ও ধর্মীয় দল বাংলাদেশ জমিয়তুল উলামার সভাপতি এবং ইকরা বাংলাদেশ নামের একটি প্রতিষ্ঠানের পরিচালকের পদও পান।

আওয়ামী আস্থাভাজনের জেরে বেশ দাপুটে ছিলেন তিনি। শাহবাগের বিতর্কিত গণজাগরণ মঞ্চে উপস্থিত হওয়ায় শাহবাগী আলেম হিসেবেও পরিচিতি পান ফরীদ উদ্দীন মাসঊদ। তার আরেকটি উল্লেখযোগ্য বিতর্কিত কাজ হলো- এক লাখ (কথিত) মুফতির স্বাক্ষর সংবলিত জঙ্গিবাদবিরোধী ফতোয়া। এই ফতোয়া ঘিরে আন্তর্জাতিক অঙ্গনসহ আওয়ামী সরকারের নানা সুযোগ-সুবিধা পেয়েছিলেন তিনি।

এ ছাড়া পোপের সঙ্গে সম্মেলনে অংশ নিয়ে মোনাজাত করা, ধর্মনিরপেক্ষতা ও জিহাদবিষয়ক কিছু বক্তব্যের সঙ্গে তিনি জোরালো দ্বিমত করে বিভিন্ন সময় কথা বলেছেন। দেশের মূলধারার আলেমদের বিরুদ্ধে অবস্থান করতেন তিনি। বিশেষ করে জামায়াতের বিরুদ্ধে তিনি সব সময় সোচ্চার ছিলেন।

কওমি মাদরাসার সরকারি স্বীকৃতি আদায়ে ভূমিকা রাখার অজুহাতে কওমি অঙ্গনকে ফ্যাসিস্ট সরকারের পক্ষে কাজে লাগানোর চেষ্টা করেছেন এই আলেম। ৫ আগস্ট গণঅভ্যুত্থান-পরবর্তী স্বাভাবিক দৃশ্যপট থেকে তিনি হারিয়ে গেছেন। সরকারি সব পদ থেকে বিতাড়িত হয়েছেন তিনি।

কিশোরগঞ্জের অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (সার্বিক) মিজাবে রহমত আমার দেশকে বলেন, ফরীদ উদ্দীন মাসঊদ শোলাকিয়ার ইমাম পদে নেই। ২ মার্চ জেলা প্রশাসক কার্যালয়ে এক সভায় শোলাকিয়ায় ঈদ জামাতের ইমাম মুফতি আবুল খায়ের মুহাম্মদ ছাইফুল্লাহকে পুনর্বহাল করা হয়। ১৫ বছর পর তিনি দায়িত্ব ফিরে পেলেন।

এদিকে ফরীদ উদ্দীন মাসঊদের একসময়ের এক সহকর্মী জানিয়েছে, প্রায় ছয় মাস ধরে অসুস্থ হয়ে হাসপাতাল আর বাসায় অবস্থান করছেন তিনি। কর্মক্ষেত্রে থাকেন অনুপস্থিত।

বক্তব্য জানতে তার ব্যক্তিগত মোবাইলে একাধিকবার কল করলেও তিনি রিসিভ করেননি। তার কর্মস্থল দ্বীনি মাদরাসা বোর্ডের মহাসচিব মুফতি মোহাম্মদ আলী ২৬ ফেব্রুয়ারি আমার দেশকে জানান, মুফতি ফরীদ উদ্দীন মাসঊদ দীর্ঘদিন ধরে অসুস্থ। তিনি বারিধারার বাসায় থাকেন। মাদরাসা বা কোনো প্রোগ্রামে তার অংশগ্রহণের মতো অবস্থা নেই।

গত ৫ আগস্ট মিরপুর সরকারি কলেজের এইচএসসি শিক্ষার্থী মোছা. রিতা আক্তার (১৭) নিহতের ঘটনায় ফরীদ উদ্দীন মাসঊদের বিরুদ্ধে মিরপুর থানায় একটি হত্যা মামলা হয়েছে বলে জানা গেছে। নির্যাতিত আলেম মুফতি ফখরুল ইসলাম বলেন, আলেম নির্যাতন ও তাদের জেলে পাঠানোর পেছনে ফরীদ উদ্দীন মাসঊদের হাত ছিল। মূলধারার আলেমদের বিরুদ্ধে সর্বদা অবস্থান নিতেন তিনি।

মাওলানা মুফতি মোহাম্মদ রুহুল আমীন

গণহত্যাকারী হাসিনাকে কওমি জননী উপাধি দেওয়া আলেমের নাম মাওলানা মুফতি মোহাম্মদ রুহুল আমিন। টুঙ্গিপাড়ার গওহরডাঙ্গা মাদরাসার এই মুহতামিম নৌকা প্রতীকে নির্বাচন করার চেষ্টা করেও সুযোগ পাননি। তবে শেখ হাসিনার আশীর্বাদে তাকে বানানো হয় বায়তুল মোকাররম জাতীয় মসজিদের খতিব ও ইসলামিক ফাউন্ডেশনের বোর্ড অব গভর্নরসের গভর্নর।

কওমি মাদরাসা বোর্ডের গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্বে ছিলেন এই আলেম। ২০১৮ সালে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে এক বক্তৃতায় শেখ হাসিনাকে ‘কওমি জননী’ আখ্যায়িত করে তীব্র সমালোচিত হন তিনি। ইসলামিক ফাউন্ডেশনের গভর্নর হিসেবে নিয়োগ বাণিজ্যসহ নানা দুর্নীতির অভিযোগ রয়েছে রুহুল আমিনের বিরুদ্ধে। ৫ আগস্ট গণঅভ্যুত্থান-পরবর্তী জনরোষের ভয়ে আত্মগোপনে চলে যান তিনি।

কিন্তু দেড় মাস আত্মগোপন থেকে ২০ সেপ্টেম্বর অনুগত মাদরাসা শিক্ষার্থীদের নিয়ে বায়তুল মোকাররমে জুমার নামাজে দায়িত্বরত খতিবের সঙ্গে সংঘাতে জড়ান তিনি। এ ঘটনার প্রায় এক মাস পর ১৭ অক্টোবর তাকে বাদ দিয়ে নতুন খতিব নিয়োগ দেয় সরকার। এরপর থেকে রুহুল আমিনকে আর ঢাকায় কোনো কর্মসূচিতে দেখা যায়নি। তবে তিনি বর্তমানে গওহরডাঙ্গায় নিজের মাদরাসায় কর্মরত আছেন বলে জানা গেছে। বক্তব্য জানতে রুহুল আমিনের ব্যক্তিগত মুঠোফোনে কল দিলে তা বন্ধ পাওয়া যায়। গওহরডাঙ্গা মাদরাসার ওয়েবসাইটে দেওয়া নম্বরটিও বন্ধ পাওয়া গেছে।

ড. কাফীলুদ্দীন সরকার সালেহী

দেশের অন্যতম একজন বিতর্কিত আলেম ড. মাওলানা কাফীলুদ্দীন সরকার সালেহী। শেখ হাসিনাকে ‘জান্নাতি মহিলা’ আখ্যায়িত করার পাশাপাশি শেখ মুজিব ও হাসিনাপ্রীতির কারণে পতিত আওয়ামী সরকারের আস্থাভাজন ছিলেন তিনি। মুজিবকে নিয়ে একটি বই লিখেছেন তিনি।

ঢাকা নেছারিয়া কামিল মাদরাসার এই প্রিন্সিপাল একাধিক মেয়াদে ইসলামিক ফাউন্ডেশনের বোর্ড অব গভর্নরসের গভর্নর ছিলেন। ইসলাম ও মূলধারার আলেম-ওলামাদের বিরুদ্ধে অবস্থান নেওয়া ছাড়াও বিভিন্ন দুর্নীতিতে জড়িত ছিলেন তিনি। বাংলাদেশ বেতার ও বিটিভিসহ অধিকাংশ মিডিয়ায় তার ব্যাপক পদচারণা ছিল। ৫ আগস্ট পরবর্তী জনরোষের ভয়ে তিনি নিজেকে গুটিয়ে রেখেছেন বলে সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন।

আবু রেজা মুহাম্মদ নেজামউদ্দিন নদভী

কওমি আলেম-ওলামা ও মাদরাসাগুলোকে আওয়ামী সরকারের নিয়ন্ত্রণে নিতে সবচেয়ে বেশি কাজ করেছেন আওয়ামী লীগের মনোনয়নে নির্বাচিত চট্টগ্রাম-১৫ আসনের সাবেক এমপি আবু রেজা মুহাম্মদ নেজামউদ্দিন নদভী। ইসলামিক ফাউন্ডেশনের বোর্ড অব গভর্নরসের গভর্নর হয়ে নানা দুর্নীতিতে জড়িত থাকার পাশাপাশি আওয়ামীবিরোধী আলেম-ওলামাদের নির্যাতনে তার ব্যাপক ভূমিকা ছিল। সংসদে দাঁড়িয়েও আওয়ামীবিরোধী আলেমদের জঙ্গি, জামায়াতি আখ্যায়িত করতেন।

হাটহাজারী ও পটিয়া মাদরাসায় গন্ডগোল লাগানোর ষড়যন্ত্র করতেন তিনি। ৫ আগস্ট-পরবর্তী আত্মগোপনে চলে যান তিনি। একপর্যায়ে গত ১৫ ডিসেম্বর রাতে ঢাকার উত্তরা এলাকা থেকে ডিবি পুলিশের হাতে গ্রেপ্তার হন তিনি।

এরপর বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে হামলার অভিযোগে সাতকানিয়া ও লোহাগাড়া থানায় করা পাঁচ মামলায় নদভীকে কারাগারে পাঠানো হয়। হাটহাজারী এলাকার নির্যাতিত আলেম মাওলানা আসাদুল্লাহ জানান, আওয়ামী সরকারের পক্ষ থেকে কওমি অঙ্গনকে নিয়ন্ত্রণের দায়িত্ব পেয়েছিলেন আবু রেজা নদভী। তিনি আওয়ামীবিরোধী আলেমদের নির্যাতন এবং মাদরাসা দখলে নানা তৎপরতা চালান।

মিছবাহুর রহমান চৌধুরী

একজন সাধারণ ধারার শিক্ষিত হয়েও আওয়ামী আমলে দেশের আলেম-ওলামা ও ধর্মীয় সেক্টরে ব্যাপক প্রভাব ছিল আলহাজ মিছবাহুর রহমান চৌধুরীর। ইসলামিক ফাউন্ডেশনের বোর্ড অব গভর্নরসের গভর্নর এবং বাংলাদেশ ইসলামী ঐক্যজোট নামে রাজনৈতিক দলের চেয়ারম্যান ছিলেন তিনি। ইসলামিক ফাউন্ডেশনে নিয়োগ-বাণিজ্য, বায়তুল মোকাররম মার্কেটে দোকান বরাদ্দে অনিয়মসহ নানা দুর্নীতিতে জড়িত থাকার অভিযোগ রয়েছে তার বিরুদ্ধে।

মাওলানা দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীর বিরুদ্ধে একটি বানোয়াট মামলার সাক্ষী এবং মামলার উসকানিদাতা ছিলেন তিনি। ফ্যাসিস্ট আওয়ামী সরকারের ইসলামবিরোধী কর্মকাণ্ডের প্রতিবাদ করায় হেফাজতে ইসলামসহ ধর্মভিত্তিক দলগুলোর সমালোচনা করতে দেখা গেছে তাকে। শেখ হাসিনার দেশত্যাগের সঙ্গে সঙ্গে মিছবাহুর রহমানও গা ঢাকা দেন। গত ৫ আগস্ট মিরপুরে এক শিক্ষার্থী হত্যা মামলার আসামি তিনি।

আবুল হাসনাত আমিনী ও মুফতি ফয়জুল্লাহ

দেশে ধর্মীয় ইস্যুতে এক সময় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখলেও একপর্যায়ে ফ্যাসিবাদী আওয়ামী সরকারের সঙ্গে আঁতাত করে মুফতি ফজলুল হক আমিনীর স্মৃতিবিজড়িত ইসলামী ঐক্যজোট। ব্যাপক আর্থিক সুবিধার বিনিময়ে দলটির তৎকালীন চেয়ারম্যান আবুল হাসনাত আমিনী, মহাসচিব মুফতি ফয়জুল্লাহ দলটিকে ভিন্ন দিকে নিয়ে যান।

একই সঙ্গে দলের ফ্যাসিবাদবিরোধীদের কোণঠাসা করা হয়। আওয়ামী সরকারের সর্বশেষ পাতানো নির্বাচনেও অংশ নেন দলটির অর্ধশত প্রার্থী। তাদের স্বার্থসংবলিত সিদ্ধান্ত মেনে না নেওয়ায় তৎকালীন সাংগঠনিক সম্পাদক মুফতি সাখাওয়াত হোসাইন রাজীসহ অনেককে গ্রেপ্তারসহ নানাভাবে জুলুম-নির্যাতনের শিকার হতে হয়। এ নিয়ে দলটিতে চাপা ক্ষোভের বহিঃপ্রকাশ ঘটে ৫ আগস্ট অভ্যুত্থানের পর। বিতর্কিত নেতাদের বাদ দিয়ে নতুন পথচলা শুরু করে দলটি।

জানা গেছে, ৫ আগস্টের পর ফ্যাসিস্ট সরকারের সুবিধাভোগী নেতা আবুল হাসনাত আমিনী ও মুফতি ফয়জুল্লাহ সম্পূর্ণ আত্মগোপনে চলে যান। তাদের এখন পর্যন্ত লালবাগ মাদরাসা এলাকায় দেখা যায়নি। আবুল হাসনাত আমিনী ঢাকায় এবং মুফতি ফয়জুল্লাহ চট্টগ্রামে নিজ গ্রাম এলাকায় আত্মগোপনে থাকতে পারেন বলে তার সংশ্লিষ্টরা ইঙ্গিত দিয়েছেন। তবে আত্মগোপনে থেকে তারা নতুন করে সক্রিয় হওয়ার চেষ্টা করছেন বলেও জানা গেছে। আবুল হাসনাত আমিনীর মোবাইল নম্বরটি আর ব্যবহৃত হচ্ছে না বলে জানা গেছে। আর মুফতি ফয়জুল্লাহকে কল দিলেও তিনি রিসিভ করেননি।

আনাস মাদানী

হেফাজতের প্রতিষ্ঠাতা আল্লামা শফীর ছেলে আনাস মাদানী হেফাজতকে এক সময় আওয়ামী সরকারের পক্ষে ব্যবহারের চেষ্টা করেন। এজন্য তিনি সরকার থেকে নানা সুযোগ-সুবিধাও পান বলে জোর গুঞ্জন ছিল। এ নিয়ে বিতর্কের একপর্যায়ে হেফাজত থেকে তাকে বাদ দেওয়া হয়। বিতাড়িত হন হাটহাজারী মাদরাসা থেকেও। তবে বর্তমানে তিনি বেফাকের পদ ধরে রাখাসহ আবার মূলধারায় ফেরার চেষ্টা করছেন বলে জানা গেছে।

একইভাবে ফ্যাসিবাদের দোসর হয়েও মূলধারায় ফিরতে তৎপরতা চালাচ্ছেন পটিয়া মাদরাসার মাওলানা উবায়দুল্লাহ হামজা, তেজগাঁও মাদরাসা থেকে বাদপড়া মাওলানা মুজিবুর রহমান এবং আম্বরশাহ মসজিদের খতিব হাফেজ মাজহারুল ইসলাম। এ ছাড়া কওমি মাদরাসা সংশ্লিষ্ট আল-হাইয়াতুল উলয়া লিল জামিয়াতিল কওমিয়া বাংলাদেশ এবং বেফাকে শীর্ষ কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে ফ্যাসিবাদী সরকারের পক্ষে অবস্থান নেওয়ার অভিযোগ আছে। এ নিয়ে সংশ্লিষ্ট মহলে অস্থিরতা বিরাজ করছে বলে জানা গেছে।

কওমি শিক্ষার্থীরা জানান, স্বৈরাচারী হাসিনার শাসনামলে সুবিধাভোগী প্রত্যেককে অতিসত্বর গ্রেপ্তার করে বিচারের কাঠগড়ায় দাঁড় করাতে হবে। হত্যাকাণ্ড ও জুলুম-নির্যাতনকে যারা সমর্থন দিয়েছিল তাদেরও প্রমাণসাপেক্ষে বিচারের মুখোমুখি করতে হবে।

শাহীনুর পাশা চৌধুরী

দীর্ঘদিন জমিয়তে উলামায়ে ইসলামের রাজনীতিতে ছিলেন মাওলানা শাহীনূর পাশা চৌধুরী। চারদলীয় জোটের প্রার্থী হিসেবে উপনির্বাচনে সুনামগঞ্জ-৩ আসন থেকে এমপি হন তিনি। সর্বশেষ বিতর্কিত দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে তৃণমূল বিএনপির প্রার্থী হিসেবে অংশ নিয়ে সমালোচিত হন। ৫ আগস্ট পরবর্তী পরিস্থিতিতে তিনি বাংলাদেশ খেলাফত মজলিসে যোগ দিয়ে দলটির নায়েবে আমিরের পদ পান।

এ বিষয়ে বাংলাদেশ খেলাফত মজলিসের মহাসচিব মাওলানা জালালুদ্দীন বলেন, শাহীনুর পাশা তাদের জানিয়েছেন, তিনি বাধ্য হয়েই ওই নির্বাচনে অংশ নেন। এটা ভুল সিদ্ধান্ত ছিল বলে তিনি স্বীকার করেছেন। এখন বাংলাদেশ খেলাফত মজলিসের আনুগত্য করার ঘোষণা দিয়েছেন তিনি।

মাওলানা রহুল আমিন খান উজানবি

আওয়ামী সরকারের শুভাকাঙ্ক্ষী ছিলেন মাওলানা রহুল আমিন খান উজানবি। আওয়ামী লীগ সরকারের প্রথম দফায় ইসলামিক ফাউন্ডেশনের বোর্ড অব গভর্নরসের গভর্নর ছিলেন। তিনি শেখ হাসিনাকে ‘এ যুগের রাবেয়া বসরী’আখ্যায়িত করে ব্যাপক বিতর্কিত হন। মাওলানা ফরীদ উদ্দীন মাসঊদের সঙ্গে তার ঘনিষ্ঠতা ছিল। ৫ আগস্ট-পরবর্তী তার জামেয়াতুস সাহাবা মাদরাসায় ভাঙচুর ও তাকে হেনস্তা করেন বিক্ষুব্ধ শিক্ষার্থী ও তরুণ আলেমরা।

শেখ হাসিনাকে রাবেয়া বসরী আখ্যায়িত করা প্রসঙ্গে মাওলানা রহুল আমিন খান উজানবি বলেন, আমি বলেছিলামÑ ‘ভারসাম্য হারিয়ে আপনি তাকে (শেখ হাসিনাকে) কাফের মনে করলে আমি বলব রাবেয়া বসরী।’মাদরাসা থেকে বিতাড়িত হওয়া প্রসঙ্গে তিনি বলেন, আওয়ামী সুবিধাভোগীরাই নতুন করে বিএনপির সুবিধা পেতে এই কাজ করেছে। বর্তমানে তিনি দক্ষিণখানের একটি মাদরাসায় শিক্ষকতা করেন বলে জানিয়েছেন।

ড. আবুল কালাম আজাদ

আওয়ামীপন্থি আলেমদের তালিকায় ছিলেন জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের ইসলামিক স্টাডিজ বিভাগের অধ্যাপক ড. আবুল কালাম আজাদ। বিভিন্ন মিডিয়ায় ফ্যাসিবাদের পক্ষের একজন আলোচক ছিলেন তিনি। বিভিন্ন সময় শেখ হাসিনা ও শেখ মুজিবের প্রশংসা করে আলোচনা-বক্তব্য দিয়ে পতিত সরকারের সুবিধা নিতে সক্ষম হন এই আলেম।

নিয়োগ পেয়েছিলেন ইসলামি আরবি বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রোভিসি পদে। এ সময় নানা অনিয়ম-দুর্নীতির অভিযোগ ওঠে তার বিরুদ্ধে। ৫ আগস্ট-পরবর্তী পরিস্থিতিতে আরবি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পদত্যাগ করেন তিনি। বর্তমানে তাকে আর কোনো কর্মসূচিতে দেখা যাচ্ছে না।

খেলাফত আন্দোলন

দীর্ঘদিন হেফাজতে ইসলামের ব্যানারে ইসলামবিরোধী ইস্যুতে সক্রিয় ছিল খেলাফত আন্দোলন। তবে একপর্যায়ে আওয়ামী সরকারের ডাকে সাড়া দিয়ে সর্বশেষ নির্বাচনে অংশ নেওয়ায় কোণঠাসা হয়ে আছেন দলটির (একাংশ) শীর্ষনেতারা।

এদের মধ্যে দলটির আমির মাওলানা আতাউল্লাহ হাফেজ্জি, মহাসচিব হাবিবুল্লাহ মিয়াজী, নায়েবে আমির মাওলানা মুজিবুর রহমান হামিদী, মাওলানা সুলতান মহিউদ্দিনের নাম উল্লেখযোগ্য। ৫ আগস্ট-পরবর্তী হেফাজতে ইসলামের কমিটি থেকে দলটির শীর্ষ কয়েকজন নেতাকে বাদ দেওয়া হয়েছে বলে সংগঠনটির একজন যুগ্ম মহাসচিব জানিয়েছেন।

এ ছাড়া তাদের আর হেফাজতের মিটিংয়ে ডাকাও হচ্ছে না। দলটির নায়েবে আমির মাওলানা মুজিবুর রহমান হামিদী বলেন, সরকার আমাদের নির্বাচনে যেতে বাধ্য করেছিল। আমরা ওই নির্বাচনে কোনো সুবিধাও পাইনি। হেফাজত থেকে তাদের বাদ দেওয়ার কোনো সিদ্ধান্তও তারা জানেন না। তবে হেফাজতের মিটিংয়ে তাদের এতদিন ডাকা না হলেও সম্প্রতি হেফাজত আমির তাদের নিয়ে বসার আহ্বান জানিয়েছেন।

হেফাজতে ইসলাম বাংলাদেশের একজন যুগ্ম মহাসচিব জানান, ৫ আগস্ট গণঅভ্যুত্থানের পরই হেফাজতে ফ্যাসিবাদবিরোধী শুদ্ধি অভিযান চালানো হয়। ৬ আগস্ট এক বৈঠকের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী, আওয়ামী সুবিধা নিয়ে ৭ জানুয়ারির নির্বাচনে অংশগ্রহণ করায় হেফাজতের কমিটি থেকে আতাউল্লাহ হাফেজ্জি (সিনিয়র নায়েবে আমির), হাবিবুল্লাহ মিয়াজী (যুগ্ম মহাসচিব), মুজিবুর রহমান হামিদী (যুগ্ম মহাসচিব) এবং জমিয়তে উলামায়ে ইসলামের নেতা মাওলানা শাহিনুর পাশাকে বাদ দেওয়া হয়েছে। তাদের আর হেফাজতের কোনো বৈঠকে ডাকা হয়নি। তিনি আরো জানান, বাংলাদেশ খেলাফত মজলিসে ফ্যাসিবাদের দোসর কয়েকজন ঢুকে পড়েছে। তাদের বিষয়েও হেফাজত সতর্ক রয়েছে।